‘পোড়া ঘরের দিকেই চেয়ে থাকি, দিন কেটে যায়…’

কুনিপাড়া বস্তিতে আগুন
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের জরিপে জানা গেছে, কুনিপাড়া বস্তিতে আগুনের ঘটনায় ঘর হারিয়েছে ২২২টি পরিবার। ছবি: শাহীন মোল্লা/স্টার

স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে ২৮ বছর আগে ঢাকায় এসেছিলেন ফরিদা বেগম (৬০)। কষ্টের উপার্জিত টাকায় একটু একটু করে কিনেছিলেন আসবাবপত্র, সাজিয়ে তুলেছিলেন নিজের সংসার। সব পুড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেও এখনো আসবাবপত্রের ছাই হাতড়ে বেড়াচ্ছেন তিনি।

রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকার কুনিপাড়ায় রোলিং মিল বস্তিতে দুই মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে থাকতেন ফরিদা। পাশেই ফুটপাতে পিঠা বিক্রি করেন তিনি। তার বড় মেয়ে ও ছেলের বিয়ে দিয়েছেন। পাশাপাশি তিনটি ঘরে নাতি-নাতনিদের নিয়ে থাকতেন তিনি।

তবে এক রাতের মধ্যে সব হারিয়ে ফুটপাতে ঠাঁই মিললো ১২ সদস্যের এই পরিবারটির।

গত সোমবার রাত ৮টার দিকে বস্তিতে আগুন লাগে। ফরিদা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি কষ্ট করে তিলে তিলে একেকটা জিনিস গড়েছিলাম। একটা ছোট ফ্রিজ ছিল, একটা টিভি ছিল, খাট-শোকেস ছিল। সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। পরনের কাপড়টা ছাড়া এখন আর কিছুই নাই।'

ফরিদার এক মেয়ে গার্মেন্টসে চাকরি করেন। ছেলে পিকআপ ও কার্ভাডভ্যানচালক হিসেবে কাজ করেন। কাছেই কোনো একটা বাসা ভাড়া নিতে চেষ্টা করেছিলেন তারা।

'মাসের এই মাঝামাঝিতে কোনো বাসা ভাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। যেগুলো পাচ্ছি অনেক বেশি ভাড়া চাচ্ছে। যে এক রুমের বাসা ৩ হাজার টাকা ভাড়া ছিল সেগুলো এখন ৫-৬ হাজার টাকা ভাড়া চায়। এত টাকা এখন পাই কোথায়?'

আগুনে সব পুড়ে যাওয়ার পর ৪ দিন ধরে ছেলে ও মেয়ের ঘরের নাতি-নাতনিসহ ফুটপাতে থাকছেন তিনি। গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে তারা যখন ঘুমাচ্ছিলেন তখন হঠাৎ বৃষ্টি নামে।

কুনিপাড়া বস্তিতে আগুন
কুনিপাড়া বস্তিতে আগুন লাগার পর কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা থেকে পাওয়া টুকটাক মালপত্র নিয়ে নতুন বাসায় যাচ্ছেন সুমন মিয়া। ছবি: শাহীন মোল্লা/স্টার

'বৃষ্টির মধ্যে ছোট বাচ্চাগুলোকে নিয়ে বিপদে পড়ে গেলাম। আশেপাশে কারো ছাদে বা কোনো ছাউনির নিচে গিয়ে যে আশ্রয় নেব সেই উপায়ও নেই। সবার বাড়িঘরই তো শেষ হয়ে গেছে। গাদাগাদি করে একটা ছাউনির নিচে কয়েকজন দাঁড়িয়ে থাকলাম,' বলেন তিনি।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের জরিপ অনুযায়ী, কুনিপাড়া বস্তিতে আগুনের ঘটনায় ঘর হারিয়েছে ২২২টি পরিবার।

ব্র্যাকের অরবান ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম অর্গানাইজার শফিউদ্দিন সুমন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা ঘটনার পরদিন ঘটনাস্থলে গিয়ে জরিপ করে যে তালিকা করেছি সেখানে ২২২টি পরিবার পাওয়া গেছে। আমরা সেখানে যাওয়ার আগে যদি চলে গেছে কি না সে ব্যাপারে নিশ্চিত নই।'

ঘর হারানো অধিকাংশ পরিবারই এখন খোলা আকাশের নিচে দিন কাটাচ্ছে। অনেকেই খালি হাতে গ্রামের বাড়িতে চলে গেছেন। কেউ কেউ ধার-দেনা করে অতিরিক্ত ভাড়ায় বাসা নিয়েছেন।

কী খাচ্ছেন জানতে চাইলে ফরিদা বলেন, 'একটা এনজিও থেকে বালতি, পাতিল, ৩টা প্লেট, গ্লাস আর কিছু চাল, ডাল, তেল- রান্নার জন্য যা লাগে তা দিয়ে গেছে। কিন্তু রান্নার চুলাই তো নাই। শুরুর ২ দিন অনেকে খাবার এনে দিয়ে গেছে। এখন বাইরে থেকে কিনেই খেতে হচ্ছে।'

গত শুক্রবার দুপুরে সরেজমিনে কুনিপাড়া বস্তিতে গেলে জিনিসবোঝাই ২টি রিকশা দেখা যায়। বিভিন্ন সংস্থা থেকে পাওয়া টুকটাক মালপত্র নিয়ে নতুন বাসায় সুমন মিয়া (৩২)।

তিনি বলেন, 'আমি জাকির ম্যানেজারের বাসার (আগুনের সূত্রপাত যে ভবনে) দোতলায় ভাড়া থাকতাম। আমার এক ছেলে, স্ত্রী ও মা আছে। ৩ দিন ধরে রাস্তায়ই আছি। কালকে বৃষ্টিতে বাচ্চাটার খুব কষ্ট হলো। আমার মায়েরও বয়স হয়েছে। এভাবে তো আর থাকা সম্ভব না। তাই ৫ হাজার টাকা দিয়ে টিনশেড এক রুম ভাড়া করলাম।'

'ওই রুমের ভাড়া ছিল ৩ হাজার টাকা। কিন্তু এখন ধার করে হলেও উঠতেই হবে। শুধু উঠলে তো হবে না। ঘরে তো জিনিস লাগবে। হাঁড়ি পাতিল, চুলা, বিছানাপত্র যেগুলো ছাড়া চলবেই না সেসব কিনতেই ১০-১২ হাজার টাকা খরচ হয়ে যাবে।'

'আপাতত একটা পাটি কিনতে পারছি। এটায় আজকে থাকবো। এরপর ধারের খোঁজ করবো আর কেনাকাটায় বের হবো,' বলেন তিনি।

আগুনের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের অস্থায়ী কোনো থাকার জায়গা করে দেওয়া হবে কি না জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ২৪নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. সফিউল্লাহ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যেদিন আগুন লাগে সেদিনই আমি সেখানে যাই। ক্ষতিগ্রস্তদের খাবার দাবারও বিতরণ করেছি। আমরা চেয়েছিলাম স্কুল বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান খুলে দিতে যাতে সেখানে তারা থাকতে পারে। কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি। স্কুলে ক্লাস চলছে। এটি করলে স্কুলের কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হবে।'

এদিকে এখনো বস্তিতেই নতুন করে ঘর বাধার স্বপ্ন দেখছেন বাসিন্দারা। ধ্বংসস্তূপের মধ্যে সেখানে হেঁটে হেঁটে চারদিক তদারকি করছেন ফরিদা।

তিনি বলেন, '১৩ বছর ধরে আমি এই ঘরে ছিলাম। এখন স্মৃতি সব ছাই। পোড়া ঘরের দিকেই চেয়ে থাকি, দিন কেটে যায়…। শুনছি, ৬ মাসেও নাকি নতুন ঘর তোলা সম্ভব না। কিন্তু মায়া পড়ে গেছে। তাই এখানেই থাকি সারাক্ষণ, হাঁটি।'

Comments

The Daily Star  | English

Rawhide market disappoints again as prices drop below govt-fixed rates

The Ministry of Commerce had increased the price of cowhide in Dhaka by Tk 5-10 per square foot, setting the official rate at Tk 60-65

56m ago