র‌্যাব হেফাজতে মৃত্যু

সুলতানার মাথায় আঘাতের কারণ অজানা

সুলতানা জেসমিন

নওগাঁর একটি ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয়ের অফিস সহকারী সুলতানা জেসমিন গত শুক্রবার র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) হেফাজতে মারা যান। তিনি মাথায় আঘাত পেয়েছিলেন এবং তার মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়েছিল। তবে, এই আঘাত বা রক্তক্ষরণের কারণ এখনো অজানা।

রাজশাহী মেডিকেল কলেজের (রামেক) ফরেনসিক চিকিৎসকরা সুলতানার মৃত্যুর একদিন পর ময়নাতদন্ত করেছেন। এ নিয়ে মানবাধিকার সংগঠনগুলো সমালোচনা করেছে এবং প্রশ্ন করেছেন হাইকোর্ট।

ময়নাতদন্তের জন্য গঠিত ৩ সদস্যের বোর্ডের নেতৃত্বে ছিলেন সহযোগী অধ্যাপক কফিল উদ্দিন। দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'সুলতানা জেসমিনের মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ ছাড়াও মাথায় আঘাত লেগেছে।'

ময়নাতদন্ত দলটি হিস্টোপ্যাথলজিকাল রিপোর্টের জন্য সুলতানার হৃদপিণ্ডের নমুনা রামেকের প্যাথলজি বিভাগে পাঠিয়েছে।

কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রধান কফিল উদ্দিন বলেন, 'রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর সুলতানার মৃত্যুর চূড়ান্ত কারণ জানা যাবে।'

নওগাঁ পৌরসভার চন্ডিপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিসের অফিস সহকারী সুলতানা (৩৮) গত ২২ মার্চ বাড়ি থেকে হেঁটে অফিসে যাওয়ার সময় র‌্যাব-৫ এর একটি টহল দল তাকে তুলে নিয়ে যায়।

পরবর্তীতে তাকে নওগাঁ সদর হাসপাতাল ও রামেক হাসপাতালে নেওয়া হয়। গত ২৪ মার্চ রামেক হাসপাতালে তিনি মারা যান বলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।

তার মৃত্যু সনদে মৃত্যুর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে 'মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণের কারণে হৃদক্রিয়া বন্ধ' এবং মৃত্যুর সময় সকাল ১০টা।

তুলে নেওয়ার পরের দিন গত ২৩ মার্চ সুলতানার বিরুদ্ধে রাজশাহীর রাজপাড়া থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে।

'অচেতন' অবস্থায় নেওয়া হয়েছে রামেক হাসপাতালে

রামেক হাসপাতালের সুপারিন্টেনডেন্ট ডা. জাহিদ নেওয়াজ জানান, সুলতানাকে ২২ মার্চ দুপুর ১টা ১৫ মিনিটে নওগাঁ সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

এর অর্থ, সুলতানাকে তুলে নেওয়ার ১ ঘণ্টা ২৫ মিনিটের মধ্যে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।

ডা. জাহিদ নেওয়াজ জানান, তখন তার মাথা ঘোরা, বমি ভাব, বমি ও শারীরিক দুর্বলতার মতো উপসর্গ ছিল। বিকাল ৩টা ৫ মিনিটে শ্বাসকষ্টের সমস্যা দেখা দিলে তার অবস্থার অবনতি হতে শুরু করে।

এরপর বিকেল ৩টা ৫৫ মিনিটে নওগাঁ সদর হাসপাতালের চিকিৎসকরা সুলতানাকে রামেক হাসপাতাল বা বগুড়ার জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করেন এবং সন্ধ্যা ৭টায় রামেক হাসপাতালে নেওয়ার জন্য তাকে নওগাঁ সদর হাসপাতাল থেকে বের করা হয়।

হাসপাতালের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সুলতানাকে রামেক হাসপাতালে ভর্তি করার সময় র‌্যাব কর্মকর্তারা বলেছিলেন যে পড়ে গিয়ে তার মাথায় আঘাত লেগেছে।

রামেক হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এফএম শামীম আহমেদ জানান, ২২ মার্চ রাত ৯টা ২০ মিনিটে অজ্ঞান অবস্থায় সুলতানাকে নিয়ে আসেন র‌্যাব কর্মকর্তারা।

তিনি বলেন, 'সুলতানা অজ্ঞান ছিলেন এবং তাকে দ্রুত নিউরোলজি ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে তাকে নিবিড় পরিচর্যা ইউনিটে (আইসিইউ) স্থানান্তর করা হয়, কারণ ক্রমাগত তার অবস্থার অবনতি হচ্ছিল। আমরা সিটি স্ক্যান করি এবং তার মাথায় একাধিক ইন্ট্রাক্রানিয়াল রক্তপাত দেখতে পাই।'

তিনি জানান, চিকিৎসকরা সুলতানার মাথায় একটি বাহ্যিক আঘাতও দেখতে পেয়েছেন। ২৩ মার্চ থেকে তার স্বাস্থ্যের খুব দ্রুত অবনতি হয়।

২৪ মার্চ সকাল ১০টায় আইসিইউতে মারা যান সুলতানা।

এর আগে গত ২৬ মার্চ রামেক হাসপাতাল পরিচালক দ্য ডেইলি স্টারকে জানিয়েছিলেন যে সুলতানাকে ২৩ মার্চ রামেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। এ বিষয়ে তিনি বলেন, 'আমি ভুল বলেছিলাম, সেটা সংশোধন করে দিচ্ছি। সুলতানাকে ২৩ মার্চ নয়, ২২ মার্চ ভর্তি করা হয়েছে।'

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলা

সুলতানার মৃত্যুর একদিন আগে রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে স্থানীয় সরকার পরিচালক এনামুল হক বাদী হয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলাটি করেন।

মামলার দ্বিতীয় আসামি সুলতানা এবং প্রধান আসামি চাঁদপুরের আল আমিন (৩২)। মামলার নথি বলছে, ২২ মার্চ সকাল ১১টা ৫০ মিনিটে তাকে তুলে নেওয়া হয়।

এনামুলের ফেসবুক আইডি হ্যাক করে মানুষকে চাকরির প্রলোভন দিতে তা ব্যবহার করার অভিযোগে এই ২ জনকে আসামি করা হয়।

উপ-সহকারী পরিচালক মো. মাসুদের নেতৃত্বে র‌্যাব-৫ এর একটি টহল দল সুলতানাকে আটক করার সময় এনামুল সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

মামলায় এনামুল বলেন, তিনি মো. জামাল নামে তার সহকারী কেরানির কাছ থেকে জানতে পারেন যে আসামি গত ১৯ মার্চ রাজশাহী নগরীতে তার কার্যালয়ের সামনে কয়েকজনের সঙ্গে প্রতারণা করেন।

তিনি আরও বলেছেন, ২২ মার্চ তিনি সরকারি সফরে নওগাঁ গিয়েছিলেন।

যাওয়ার পথে তিনি নওগাঁ বাসস্ট্যান্ডে র‌্যাব-৫ এর টহল দলের সঙ্গে দেখা করেন এবং তাদের জানান যে তার ফেসবুক আইডি ব্যবহার করে প্রতারণা করা হচ্ছে।

গতকাল তার কার্যালয়ে দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে এনামুল দাবি করেন, তিনি র‌্যাব টিমকে জানিয়েছেন যে বরিশালের জনৈক শেখ আরিফ তাকে সুলতানার ব্যাংক অ্যাকাউন্টের কথা বলেছেন।

আর এনামুলের হ্যাক হওয়া আইডি থেকে আরিফকে ওই ব্যাংক অ্যাকাউন্টে সরকারি চাকরি পাওয়ার জন্য টাকা দিতে বলা হয়।

র‌্যাব টিম এনামুলকে সঙ্গে রাজশাহীর মুক্তির মোড়ে সুলতানাকে শনাক্ত করে।

এতে আরও বলা হয়, এনামুল, র‌্যাব কর্মকর্তা ও স্থানীয়দের সামনে র‌্যাব সদস্যরা জানতে চাইলে সুলতানা স্বীকার করেন যে তিনি এ ধরনের প্রতারণার সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

র‌্যাব সুলতানার স্মার্টফোনও জব্দ করেছে, যেখানে তার সোনালী ব্যাংক অ্যাকাউন্টে লেনদেনের প্রমাণ পাওয়া গেছে।

'অজানা স্থানে নিয়ে যাওয়া'

মামলায় বলা হয়েছে, সুলতানাকে মুক্তির মোড়ে র‌্যাব সদস্যরা জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। কিন্তু, তার পরিবারের সদস্যরা বলছেন, সুলতানাকে ঘটনাস্থল থেকে তুলে নিয়ে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়।

'সকাল সাড়ে ৯টা থেকে সকাল ১০টার মধ্যে সুলতানাকে গ্রেপ্তারের কথা শুনেছি' উল্লেখ করে তার চাচা নওগাঁর সাবেক কাউন্সিলর নাজমুল হক মন্টু বলেন, 'বুধবার (২২ মার্চ) সকালে সুলতানা অফিসে যাওয়ার সময় মুক্তির মোড় এলাকায় র‌্যাব সদস্যদের বহনকারী একটি সাদা মাইক্রোবাস তাকে আটকে দেয়। বিভিন্ন ক্যাম্পে খুঁজেও আমরা তাকে পাইনি। দুপুরের দিকে আমরা শুনি তাকে নওগাঁ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।'

তিনি জানান, দুপুরে সুলতানাকে দেখতে নওগাঁ হাসপাতালে গেলে বিছানার ২ পাশে ২ জন নারী র‌্যাব সদস্যকে ইউনিফর্মে দেখতে পান।

সুলতানা যখন অজ্ঞান হয়ে পড়েন এবং শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন, তখন সাদা পোশাকে র‌্যাব সদস্যরা তাকে ঘিরে রেখেছিলেন।

গতকাল মন্টু বলেন, 'সুলতানা একবার চোখ খুলেছিল, কিন্তু র‌্যাব সদস্যদের দেখে আবার অজ্ঞান হয়ে যায়।'

মন্টু ওই ২ নারী র‌্যাব কর্মকর্তাকে সুলতানার বিছানার পাশে থাকার কারণ জানতে চান। তখন তারা এ বিষয়ে তাদের ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে কথা বলতে বলেন। সাদা পোশাকে এক র‌্যাব সদস্য তাকে একটি ছবি দেখিয়ে বলেন যে ছবির মানুষটি এনামুল নামে একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং সুলতানা এনামুলের ফেসবুক আইডি ব্যবহার করে অনেক মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন।

মন্টু বলেন, 'একা থাকার সাহস পাইনি বলে কিছুক্ষণ পর আমি হাসপাতাল ছেড়ে বের হয়ে যাই।'

মন্টু জানান, নওগাঁ শহরের চালকদেব জনকল্যাণ মহল্লায় এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে। বিবাহবিচ্ছেদের পর সুলতানা ওই এলাকায় তার একমাত্র ছেলেকে নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকতেন।

গতকাল সোমবার সরেজমিনে দেখা যায়, তার বাসাটি খালি পড়ে আছে। এমনকি বাসার মালিককেও পাওয়া যায়নি।

প্রতিবেশীদের কেউ কথা বলতে রাজি হয়নি। নাজমুল হক মন্টু সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে কিছুটা দূরবর্তী জায়গায় নিয়ে যান।

তিনি দাবি করেন, ২২ মার্চ বিকেলে র‌্যাবের এক কর্মকর্তা তাকে ফোন করে আবারও নওগাঁ হাসপাতালে সুলতানাকে দেখতে যেতে বলেন।

মন্টু সুলতানার শ্যালক আমিনুল ইসলামকে হাসপাতালে পাঠান এবং নিজে মাগরিবের নামাজের পর সেখানে যাওয়ার কথা জানান।

আমিনুল নওগাঁ সদর হাসপাতালে পৌঁছা মাত্রই সুলতানা ও আমিনুলকে সঙ্গে নিয়ে র‌্যাব সদস্যরা রামেক হাসপাতালের দিকে রওনা দেন। মন্টু বলেন, 'তারা দেখানোর চেষ্টা করছিল যে সুলতানার স্বজনদের উপস্থিতিতেই চিকিৎসা চলছে।'

তিনি আরও দাবি করেন, সুলতানার মৃত্যুর পর থেকে সাদা পোশাকে র‌্যাব সদস্যরা সার্বক্ষণিক তাদের এলাকা পাহারা দিচ্ছে।

র‌্যাবের বক্তব্য

র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে তারা ওই নারীকে গ্রেপ্তার করেছেন।

তিনি বলেন, 'আমরা ওই নারীর অ্যাকাউন্ট থেকে প্রায় ২০ লাখ টাকা লেনদেনের প্রমাণ পেয়েছি।'

তিনি বলেন, 'গ্রেপ্তারের পরপরই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং আমরা তাকে নওগাঁ হাসপাতালে নিয়ে যাই। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। গ্রেপ্তারের পর তাকে র‌্যাব ক্যাম্পেও নেওয়া হয়নি।'

তিনি দাবি করেন, পরিবারের পর্যবেক্ষণেই তাকে হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।

এরপরও র‌্যাবের কোনো সদস্য কোনো অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থাকলে আমরা যথাযথ তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেব।

Comments