‘হেফাজত’ মানে আইনি সুরক্ষা অথচ র‌্যাব হেফাজতে সুলতানার মৃত্যুর অভিযোগ কেন

দিনাজপুরে ইয়াসমিন নামের একজন কিশোরীকে ১৯৯৫ সালের ২৪ আগস্ট পুলিশী হেফাজতে ধর্ষণ ও হত্যা করা হয়েছিল। ধর্ষণ করে তার মরদেহ রাস্তায় ফেলে যায় পুলিশ। সেদিন প্রতিবাদে-বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল সারা দেশের মানুষ।

জঘন্যতম বর্বরোচিত এই ঘটনার পর থেকে এই দিনটি 'নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস' হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। ইয়াসমিন হত্যা মামলায় ২০০৭ সালে ৩ পুলিশ সদস্যকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল।

কিশোরী ইয়াসমিন নিহত হওয়ার পর ২৭ বছর পার হয়ে গেছে। দেশ ও সমাজ আধুনিক হয়েছে, দেশে নানান উন্নয়ন হচ্ছে, কিন্তু এখনো একজন অভিযুক্ত নারী আসামিকে রিমান্ডে নিয়ে শারীরিক ও যৌন নির্যাতন করার এবং মৃত্যুর ঘটনা ঘটেই যাচ্ছে।

একজন নারী অভিযুক্ত আসামি যখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে নিরাপদে থাকতে পারেন না, সেখানে কীভাবে দাবি করবো যে আমরা সভ্য জাতি? দেশে মডেল থানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, নারীর সুরক্ষায় অসংখ্য আইন আছে, অথচ এরপরেও 'অভিযুক্ত নারী আসামি' নিগৃহীত।

সম্প্রতি নওগাঁয় র‌্যাব হেফাজতে অসুস্থ হয়ে পড়েন ভূমি অফিসের অফিস সহকারী সুলতানা জেসমিন। পরবর্তীতে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। গত ২২ মার্চ সকালে র‌্যাব প্রতারণার অভিযোগে তাকে আটক করে। ২৩ মার্চ বিকেলে তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়।

র‌্যাবের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সুলতানার বিরুদ্ধে আর্থিক প্রতারণা ও ব্যাংক হিসাবে অস্বাভাবিক লেনদেনের অভিযোগ পেয়েছে তারা। গণমাধ্যম থেকে আরও জানা যায়, সুলতানাকে আটকের বিষয়ে স্থানীয় পুলিশকে র‌্যাব কোনো তথ্য জানায়নি।

নওগাঁর সহকারী কমিশনার (ভূমি) বলেছেন, 'সুলতানা এক বছর ধরে আমার অধীনে কাজ করেছেন। তার বিরুদ্ধে কোনো দুর্নীতির অভিযোগ শুনিনি।' তাহলে র‌্যাব হঠাৎ কোথা থেকে প্রতারণার অভিযোগ পেলো এবং এরপর কীভাবে সেই অভিযোগ ডিজিটাল আইনের অধীনে চলে গেল?

নির্যাতনের কারণে অসুস্থ হয়ে সুলতানার মৃত্যু হয়েছে বলে পরিবার দাবি করলেও র‌্যাব তা অস্বীকার করেছে। তবে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক জানিয়েছেন, হাসপাতালে ভর্তির সময় সুলতানার মাথার ডান পাশে আঘাতের চিহ্ন ছিল। মাথার ভেতরে রক্তক্ষরণ হয়েছে বলে সিটিস্ক্যান রিপোর্টে উঠে আসে।

পরিবারের অভিযোগ, চিকিৎসকের বক্তব্য ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে বোঝা যাচ্ছে যে তাকে আটক ও জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্রে যথাযথ প্রক্রিয়া মানা হয়নি।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রায়ই নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যুর অভিযোগ উঠছে। অভিযোগগুলোর প্রতি যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় না বলে, এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।

এর আগে ২০২১ সালে বরিশালের উজিরপুর উপজেলায় হত্যা মামলায় গ্রেপ্তারকৃত অভিযুক্ত এক নারী জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে অভিযোগ করেন, ২ দিনের পুলিশ রিমান্ডে থাকাকালে তিনি যৌন ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। বিচারক নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন অনুযায়ী ওই নারীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে নির্যাতনের চিহ্ন ও নির্যাতনের সম্ভাব্য সময় উল্লেখ করে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রতিবেদন দিতে শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালককে নির্দেশ দেন। ওই অভিযুক্ত নারী আসামির শরীরের বিভিন্ন স্থানে শক্ত কিছু দিয়ে পেটানো হয়েছে বলে চিকিৎসক তারা রিপোর্টে মন্তব্য করেন।

জাতিসংঘের নির্যাতন বিরোধী সনদে সইকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এই নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনটি প্রণয়ন করে। এই আইন অনুযায়ী কেউ নির্যাতনের শিকার হলে আদালতে অভিযোগ করতে পারেন। শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন প্রমাণিত হলে শাস্তি হিসেবে নূন্যতম ৫ বছরের কারাদণ্ড অথবা ৫০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। এ ছাড়া, নির্যাতনের কারণে মারা গেলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা অর্থদণ্ড হতে পারে।

আদালতের নির্দেশনার বিপরীতে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ বা রিমান্ডের সময় নির্যাতন করা হচ্ছে প্রায়শই। এই ধারাটি যেন একটি স্বাভাবিক ও অলিখিতভাবে স্বীকৃত বিষয় হয়ে গেছে। ফৌজদারি কার্যবিধির (সিআরপিসি) ১৬৭ ধারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে রিমান্ডের সময় নির্যাতনের অনুমোদন দেয়।

এই বিধানের বিরুদ্ধে ২০০৩ সালের ৭ এপ্রিল হাইকোর্ট ১৫ দফার একটি নির্দেশনা দেন। তৎকালীন সরকার একই বছরের ২ আগস্ট হাইকোর্টের এই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করে। দীর্ঘ ১৩ বছর পর ২০১৬ সালের ২৪ মে পুলিশ হেফাজতে নিয়ে নির্যাতনের বিষয়ে কিছু নির্দেশিকার মাধ্যমে হাইকোর্টের নির্দেশকে বহাল রেখে রায় দেন সর্বোচ্চ আদালত। কিন্তু এরপরেও বিভিন্ন ঘটনায় বোঝা যাচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রতিনিয়তই এসব নির্দেশনা উপেক্ষা করছে।

নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩ মুখবন্ধে মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে যে আমাদের সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদে নির্যাতন এবং নিষ্ঠুর, অমানবিক, লাঞ্ছনাকর ব্যবহার ও দণ্ড মৌলিকভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশে কোনো ব্যক্তিকে নির্যাতন, নিষ্ঠুর ও অমানবিক শাস্তি দেওয়া যাবে না, এমনকি সেরকম কোনো আচরণও করা যাবে না।

আইনটির মুখবন্ধে আরও আছে যে বাংলাদেশ জাতিসংঘের ১৯৮৪ সালে গৃহীত নির্যাতন এবং অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক, লাঞ্ছনাকর ব্যবহার বা নির্যাতনবিরোধী সনদের একজন অংশীজন রাষ্ট্র। অর্থাৎ আমাদের সংবিধান এবং জাতিসংঘের এই সনদের বাস্তবায়নের জন্য নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩ প্রণয়ন করা হয়েছে।

বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতন প্রতিরোধে এই আইনটি ২০১৩ সালে প্রণয়ন করা হলেও, এর প্রয়োগ তেমন নেই। এই আইনের অধীনে ভুক্তভোগীরা নিরাপত্তা হেফাজতে শারীরিক, এমনকি মানসিক নির্যাতনেরও বিচার চাইতে পারেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এ আইন সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা কম। কারণ এই আইন নিয়ে তেমন কোনো প্রচার প্রচারণা নেই।

২০১৮ সালে স্টার উইকেন্ডের একটি প্রতিবেদনে রিমান্ডে নির্যাতনের অনেক প্রমাণ তুলে ধরে বলা হয়েছিল, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিয়মিতই এ চর্চা চালায়। নওগাঁর অভিযুক্ত নারীর ওপর নিপীড়নের অভিযোগ ও মৃত্যু প্রমাণ করে যে অভিযুক্ত নারীর জন্য রিমান্ড একটি নরক হতে পারে।

আটকের পর পুলিশী হেফাজতে থাকার সময় নারীদের কীভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়, তা নিয়ে এর আগে বহুজন বহু প্রশ্ন করেছেন। নারী সংগঠনগুলো মনে করে, জিজ্ঞাসাবাদ ও পাহারার সময় নারী পুলিশ সদস্য থাকা বাধ্যতামূলক করা উচিৎ। অভিযুক্ত নারীকে অনেক ধরণের বাজে মন্তব্য শুনতে হয়। তারা বলেন, একজন নারীকে যখন রিমান্ডে নেওয়া হয়, তখন সেখানে আইনশৃঙ্খলা কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে একজন নারী সদস্য থাকতে হবে এবং এ কথা আইনেও বলা আছে। নারী আসামির সঙ্গে সার্বক্ষণিক নারী পুলিশ বাধ্যতামূলক করা উচিৎ।

নারী নেত্রী খুশি কবীর গণমাধ্যমকে বলেছেন, 'একজন নারী যখন রিমান্ডে থাকবেন, আর যে ঘরে তাকে রাখা হবে সেখানে আলাদা টয়লেটের ব্যবস্থা থাকবে। অথচ অনেকের কাছ থেকে আমি শুনতে পাই, এ ব্যবস্থা রাখা হয় না।'

আমরা আশা করছি র‌্যাব নিজেদের ভাবমূর্তি বজায় রাখার জন্য দ্রুত এ ব্যাপারে একটি পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করবে। প্রয়োজনে আইনজীবী, শিক্ষক, জেন্ডার বিশেষজ্ঞ, নারী অধিকার কর্মী ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধি রেখে একটি কমিটি গঠন করবে। অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হলে দোষীদের শাস্তির আওতায় নিয়ে আসতে হবে।

র‌্যাব হেফাজতে মৃত সুলতানার সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন তলব করেছেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে কারা ওই নারীকে আটক করেছিলেন এবং কাদের হেফাজতে থাকা অবস্থায় তার মৃত্যু হয়েছে, তাদের নাম পদবিসহ তথ্য চেয়েছেন। যদিও রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আদালতকে জানিয়েছেন, এখন পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি। ভুক্তভোগীর পরিবার কোনো মামলা করেনি। তখন হাইকোর্ট উল্টো বলেছেন, কেন তারা মামলা করবেন? রাষ্ট্রের কি দায়িত্ব নেই? দেশ জুড়ে এই ইস্যুটি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। হাইকোর্ট স্পষ্টভাবে বলেছেন, 'আমরা দেখতে চাচ্ছি এ ঘটনার সঙ্গে আইনের কোনো গাফিলতি আছে কি না।'

দেশের সব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাকে অবশ্যই সাংবিধানিক নির্দেশনা ও আদালতের নির্দেশনা মেনে চলতে হবে এবং হেফাজতে নির্যাতন বন্ধ করতে হবে। অভিযোগ মাথায় নিয়ে যারা থানায় যান, তারা কিন্তু সবাই অপরাধী নন। আর অপরাধী হলেও, ভালো আচরণ পাওয়ার অধিকার তার আছে। হেফাজতে যাওয়া মানে আইনি সুরক্ষায় থাকা, সেখানে যদি আইনি সুবিচার না পায়, নির্যাতিত হয়, নিহত হয়—তাহলে ভরসার জায়গা নষ্ট হয়ে যায়।

তবে অপ্রিয় বাস্তবতা হচ্ছে, ২৭ বছর আগে ইয়াসমিনের ঘটনা নিয়ে মানুষ যতোটা জেগে উঠেছিল, আজকাল আর তেমনটা হয় না। হয় আমরা গা সওয়া হয়ে গেছি অথবা ভীতু হয়ে গেছি।

শাহানা হুদা রঞ্জনা, যোগাযোগকর্মী

[email protected]

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Life insurers mired in irregularities

One-fourth of the life insurance firms in the country are plagued with financial irregularities and mismanagement that have put the entire industry in danger.

7h ago