সংশপ্তক ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী

করোনা চিকিৎসায় দামি ওষুধ গ্রহণ করতে রাজি হননি। তার কথা ছিল, 'প্রথমত করোনা চিকিৎসায় এত দামি ওষুধ দরকার নেই। দ্বিতীয়ত, যে ওষুধ কেনার সামর্থ্য সাধারণ মানুষের নেই, সেই ওষুধ আমি খাব না।' কোনো ডাক্তার তার মত পরিবর্তন করাতে পারেননি।

বারবার মৃত্যু তার কাছাকাছি এসেছে। প্রতিবারই মৃত্যুকে 'না' বলে অলৌকিকভাবে ফিরে এসেছেন। কিন্তু এবার আর পারলেন না। মৃত্যুর কাছে হেরে গেলেন সংশপ্তক ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। চলে গেলেন ১১ এপ্রিল রাত ১১টায়।

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বাংলাদেশের নায়ক, আইকন। সারাটা জীবন কাটিয়ে গেলেন কাউকে তোয়াক্কা না করে। জীবনকে ব্যয় করে গেলেন দেশের গরিব মানুষের জন্য। সৎ, নির্লোভ, নির্ভিক ৮১ বছরের চির তরুণ যাপন করে গেলেন সার্থক ও পরিপূর্ণ এক জীবন। অনুকরণীয়, অনুসরণীয় মানুষটির জীবনের কাহিনি মিথকেও হার মানায়।

যে হাসপাতাল নিজে গড়েছেন এ দেশের গরিব মানুষের জন্যে, তিনি চিকিৎসা নেবেন সেই হাসপাতালে, অন্য কোনো হাসপাতালে নয়। তাকে যেন চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেওয়ার কথা চিন্তা করা না হয়। জ্ঞান থাকাবস্থায় নির্দেশনা দিয়ে গেছেন।

একটু পেছন ফিরে দেখি।

তিনি কোভিড আক্রান্ত হলেন। গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে তার চিকিৎসা চলছিল। আরও ভালো চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেলের করোনা ইউনিটে নেওয়ার দাবি উঠেছিল। তার জন্য ভিআইপি রুমও প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। তিনি যেতে রাজি হননি। 'যে হাসপাতাল তৈরি করলাম, সেখানে যদি নিজে আস্থা না রাখি, সাধারণ মানুষ আস্থা রাখবেন না'—যুক্তি ছিল ডা. জাফরুল্লাহর।

করোনা চিকিৎসায় দামি ওষুধ গ্রহণ করতে রাজি হননি। তার কথা ছিল, 'প্রথমত করোনা চিকিৎসায় এত দামি ওষুধ দরকার নেই। দ্বিতীয়ত, যে ওষুধ কেনার সামর্থ্যসাধারণ মানুষের নেই, সেই ওষুধ আমি খাব না।' কোনো ডাক্তার তার মত পরিবর্তন করাতে পারেননি।

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর কিডনি রোগ যখন ধরা পড়ল, তার আমেরিকান ডাক্তার বন্ধুরা তাকে আমেরিকায় নিয়ে ট্রান্সপ্লান্ট করে দেওয়ার উদ্যোগ নিলেন। এতে তার কোনো অর্থ ব্যয়ের ব্যাপার ছিল না। তিনি রাজি হননি। কেন জানেন? বাংলাদেশে কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট আইন পরিবর্তনের জন্য তিনি আন্দোলন করছিলেন। কারণ বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী কাছের আত্মীয় ছাড়া কেউ কিডনি দান করতে পারেন না। এই আইন পরিবর্তন না করায় অনাত্মীয়কে আত্মীয়ের মিথ্যা পরিচয়ে কিডনি নিতে হয়। এতে গরিব মানুষ সেবা থেকে বঞ্চিত হয়। 'দেশের সাধারণ মানুষ কিডনি ট্রান্সপ্লান্টের সুযোগ পাবে না, আর আমি আমেরিকা থেকে করে আসব বা দেশে মিথ্যা কথা বলে করতে হবে, তা হয় না। আমি ট্রান্সপ্লান্ট করব না। ডায়ালাইসিস করব, যে সেবা গরিব মানুষকেও দিতে পারব।' এই হচ্ছেন আমাদের নায়ক ডা. জাফরুল্লাহ।

'দেশের সাধারণ মানুষ কিডনি ট্রান্সপ্লান্টের সুযোগ পাবে না, আর আমি আমেরিকা থেকে করে আসব বা দেশে মিথ্যা কথা বলে করতে হবে, তা হয় না। আমি ট্রান্সপ্লান্ট করব না। ডায়ালাইসিস করব, যে সেবা গরিব মানুষকেও দিতে পারব।'

বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী চট্টগ্রাম জেলার রাউজানে ১৯৪১ সালের ২৭ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। পিতামাতার ১০ ছেলেমেয়ের মধ্যে তিনি সবার বড়। তিনি ঢাকার বকশীবাজারের নবকুমার স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন এবং ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন।

তার জীবন বর্ণাঢ্য, বৈচিত্র্যময়, কিছুটা বিচিত্রও বটে। ১৯৬৪ সালে ঢাকা মেডিকেল থেকে এমবিবিএস পাস করে এফআরসিএস পড়তে গিয়েছিলেন লন্ডনে। তখন তার জীবনযাপন ছিল রাজকীয়। প্রাইভেট জেট চালানোর লাইসেন্স ছিল; দামি স্যুট, টাই, শার্ট, জুতা পরতেন। ৪ বছরের এফআরসিএস কোর্স শেষের দিকে। প্রাইমারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন, সপ্তাহখানেক পরেই ফাইনাল পরীক্ষা। এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ।

একজন সাধারণ চিন্তার মানুষ তখন কী করবেন? পরীক্ষা দেবেন, না মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করতে নেমে যাবেন? উত্তর হওয়ার কথা, পরীক্ষা দেবেন। তবে আমরা যাকে নিয়ে কথা বলছি, তিনি সাধারণ চিন্তার মানুষ ছিলেন না। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, পরীক্ষা দেবেন না। লন্ডনে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনে নেমে পড়লেন।

এমনই মানুষ ছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী।

একবার জানতে চেয়েছিলাম, ৪ বছর ধরে কঠিন প্রস্তুতি নিলেন এফআরসিএস পরীক্ষার জন্য, মাত্র সপ্তাহখানেক আগে সেই পরীক্ষা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত তিনি কী করে নিলেন?

স্বভাবসুলভ হাসি মুখে বলেছিলেন, 'দেশে পাকিস্তানিদের হত্যাযজ্ঞের কথা জানছিলাম। আন্দোলন-সংগ্রামের সঙ্গে সবসময় সম্পৃক্ত ছিলাম। তখন মনে হলো, এফআরসিএস পরীক্ষার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠন করা। দেশের মানুষের পাশে দাঁড়ানো। পরীক্ষা দেবো কি দেবো না, তা নিয়ে এত চিন্তা করতে হয়নি। মানুষ যখন শুনে অবাক হয় যে, "পরীক্ষা দিলেন না!", তখনই বরং আমার হাসি পায়, অবাক হই।'

লন্ডন শহরে প্রবাসী বাংলাদেশিদের সভা-সমাবেশ চলছে, তুলে ধরা হচ্ছে পাকিস্তানিদের গণহত্যার চিত্র। সেসব সমাবেশে যোগ দিচ্ছেন বিদেশিরাও। লন্ডনের প্রখ্যাত হাইড পার্কে এরকম একটি সমাবেশ চলছিল। সমাবেশের এক পর্যায়ে প্রকাশ্যে পাকিস্তানি পাসপোর্ট ছিঁড়ে ফেললেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী।

এই যে পাসপোর্ট ছিঁড়ে পাকিস্তানের নাগরিকত্ব বর্জন করলেন, এই সিদ্ধান্ত কি হঠাৎ করে, না চিন্তা-ভাবনা করে নিয়েছিলেন?

হাসতে হাসতে তিনি যা বলেছিলেন, তা ছিল এমন, 'পাসপোর্ট ছিঁড়ে ফেলা ছিল পাকিস্তানিদের গণহত্যার বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ। তোমরা আমাদের হত্যা করছ, আমি তোমার পাসপোর্ট ছিঁড়ে ফেললাম, নাগরিকত্ব বর্জন করলাম।'

১৯৭১ সালের মে মাসের শেষ দিকে পাসপোর্ট-নাগরিকত্বহীন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও ডা. মবিন কলকাতায় আসার উদ্যোগ নিলেন। ট্রাভেল পারমিট জোগাড় করে সিরিয়ান এয়ারলাইনসে রওনা দিলেন কলকাতার উদ্দেশে। ট্রানজিট দামেস্ক। বিপত্তি বাধল সেখানেই। দামেস্ক বিমানবন্দরে সিরিয়ার সহযোগিতা নিয়ে পাকিস্তান সরকার তাদের গ্রেপ্তার করতে চাইল। উড়োজাহাজের সব যাত্রী নেমে গেছেন, নামেননি শুধু তারা ২ জন। উড়োজাহাজের ভেতর আন্তর্জাতিক জোন, কাউকে গ্রেপ্তার করা যায় না।

বিমানবন্দরে উপস্থিত পাকিস্তানি একজন কর্নেল দাবি করছিলেন, 'আমাদের ২ জন নাগরিক উড়োজাহাজে আছে। তাদেরকে আমাদের হাতে তুলে দেন।' দীর্ঘ সময় দেন-দরবার চলে। অবশেষে পাকিস্তানি কর্নেলকে জানানো হয়, তারা পাকিস্তানি পাসপোর্ট নিয়ে ভ্রমণ করছেন না, ট্রাভেল পারমিট নিয়ে ভ্রমণ করছেন। তারা পাকিস্তানের নাগরিক নন। সে যাত্রায় পাকিস্তানিদের হাত থেকে বেঁচে গেলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও ডা. মবিন।

লন্ডন শহরে প্রবাসী বাংলাদেশিদের সভা-সমাবেশ চলছে, তুলে ধরা হচ্ছে পাকিস্তানিদের গণহত্যার চিত্র। সেসব সমাবেশে যোগ দিচ্ছেন বিদেশিরাও। লন্ডনের প্রখ্যাত হাইড পার্কে এরকম একটি সমাবেশ চলছিল। সমাবেশের এক পর্যায়ে প্রকাশ্যে পাকিস্তানি পাসপোর্ট ছিঁড়ে ফেললেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী।

মে মাসের শেষে তারা পৌঁছালেন আগরতলায় মুক্তিযুদ্ধের ২ নম্বর সেক্টরে। সেখানেই গড়ে তুললেন একটি হাসপাতাল। সেই হাসপাতালটিই স্বাধীন বাংলাদেশে জন্ম নিলো গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র নামে। যার আদি জন্ম ১৯৭১ সালে ভারতের মাটিতে, আগরতলার বিশ্রামগঞ্জে।

মুক্তিযুদ্ধের ২ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার খালেদ মোশাররফ এই অঞ্চলে অবস্থান করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করছিলেন। যুদ্ধে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য গড়ে তোলা হয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি। নাম দেওয়া হয়েছিল 'বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল'। ছন-বাঁশ দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছিল ৪৮০ শয্যার হাসপাতাল, অপারেশন থিয়েটার। যুদ্ধে গুরুতর আহত মুক্তিযোদ্ধাদের জটিল অপারেশনও করা হতো বাঁশের তৈরি এই হাসপাতালে।

হাসপাতালটি গড়ে তোলার অন্যতম উদ্যোক্তার নাম ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও তৎকালীন পাকিস্তানের একমাত্র কার্ডিয়াক সার্জন ডা. এম এ মবিন। প্যারামেডিক প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছিল একদল সেবাদানকারী। মানবাধিকার কর্মী ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামালও তাদের একজন।

১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে হাসপাতালটি গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়ার সময় নাম নিয়ে আপত্তি এলো প্রশাসনের পক্ষ থেকে। সেই সময় অন্য অনেক বিষয়ের মতো এটাও রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কান পর্যন্ত পৌঁছাল। ডা. জাফরুল্লাহ সচিবালয়ে গিয়ে দেখা করলেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সেদিনের কথোপকথনের ঘটনাটা শুনেছিলাম ডা. জাফরুল্লাহর মুখ থেকে। আংশিক লিখেছিলাম একবার।

'মুজিব ভাই, বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল করতে দেওয়া হচ্ছে না', জানালেন ডা. জাফরুল্লাহ।

'বাংলাদেশ নাম থাকলে কেমন সরকারি সরকারি মনে হয়। অন্য কোনো সুন্দর নাম ঠিক কর হাসপাতালের জন্য', বললেন বঙ্গবন্ধু।

অনেক তর্কের পর বঙ্গবন্ধু বললেন, 'তুই ৩টি নাম ঠিক করবি। আমি ৩টি নাম ঠিক করব। ২ জন বসে যে নামটি ভালো সেই নামে হাসপাতাল হবে।'

৩টি নাম ঠিক করে আবার বঙ্গবন্ধুর কাছে গেলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী।

বঙ্গবন্ধু জানতে চাইলেন, 'বল, কী নাম ঠিক করেছিস?'

ডা. জাফরুল্লাহ বলতে শুরু করলেন, 'এক. বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল, দুই. গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র...।'

তৃতীয় নামটি বলার সুযোগ না দিয়ে বঙ্গবন্ধু বললেন, 'গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র খুব সুন্দর নাম। এই নামেই হবে হাসপাতাল। এই হাসপাতালে শুধু চিকিৎসা হবে না। দেশটাকে গড়ে তুলতে হবে। স্বাস্থ্য, কৃষি,শিক্ষা সবকিছু নিয়ে কাজ করতে হবে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রকে।'

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী প্রায় অকেজো ২টি কিডনি নিয়ে বেঁচে ছিলেন। কোভিডে লিভারের ক্ষতি হয়েছিল। বর্তমানে তার রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা নেমে এসেছিল প্রায় শূন্যে। কোনো ওষুধই কাজ করছিল না। সপ্তাহে ৩ দিন ডায়ালাইসিস করতে হতো। মাঝেমধ্যেই অনিয়ম করতেন। অন্য কোনো কর্মসূচি থাকলে, শরীর একটু ভালো থাকলে সেদিন ডায়ালাইসিস করতেন না।

জোহরা বেগম, পাকিস্তান সরকারের যুগ্ম সচিব এম এ রব এবং ডা. লুৎফর রহমান সাভারে তাদের পারিবারিক সম্পত্তি থেকে ৫ একর জায়গা দিয়েছিলেন হাসপাতালের জন্য। বঙ্গবন্ধু আরও ২৩ একর জমি অধিগ্রহণ করে দিলেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রতিষ্ঠান 'বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল' পরিবর্তিত 'গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র' নামে যাত্রা শুরু করল ১৯৭২ সালে।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র গণমানুষের প্রতিষ্ঠান। নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে অনেক কথা হয়। প্রচলিত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন করেছিলেন। যে কাজ নারী 'পারে না' বলে ধারণা প্রতিষ্ঠিত, সেসব কাজে তিনি নারীদের সম্পৃক্ত করেছিলেন। ইলেকট্রিশিয়ান, কারপেন্টার, ওয়েল্ডার হিসেবে নারীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজে নিযুক্ত করেছিলেন। ড্রাইভার হিসেবে নারীদের গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রই প্রথম সামনে নিয়ে আসে। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের নারী ড্রাইভাররা বড় বড় জিপ চালাতে শুরু করেন ১৯৮২ সাল থেকে।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে কর্মী সংখ্যা প্রায় ২ হাজার ৫০০, এর মধ্যে অন্তত ৪০ শতাংশ নারী।

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী প্রায় অকেজো ২টি কিডনি নিয়ে বেঁচে ছিলেন। কোভিডে লিভারের ক্ষতি হয়েছিল। বর্তমানে তার রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা নেমে এসেছিল প্রায় শূন্যে। কোনো ওষুধই কাজ করছিল না। সপ্তাহে ৩ দিন ডায়ালাইসিস করতে হতো। মাঝেমধ্যেই অনিয়ম করতেন। অন্য কোনো কর্মসূচি থাকলে, শরীর একটু ভালো থাকলে সেদিন ডায়ালাইসিস করতেন না।

গত ৪-৫ বছরে প্রতিবারই দেখা করার সময় দিয়েছেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র নগর হাসপাতালের কিডনি ডায়ালাইসিস সেন্টারে। একবার ডায়ালাইসিস সম্পন্ন হতে ৪ ঘণ্টা সময় লাগে। অন্য রোগীরা ডায়ালাইসিসের সময় চুপচাপ শুয়ে থাকতেন। ডা. জাফরুল্লাহ ডায়ালাইসিসের সময় কথা বলতেন, কাজ করতেন, খাওয়া-দাওয়া করতেন। সহকর্মীদের কাজের নির্দেশনা দিতেন।

ঢাকা শহরসহ সারা দেশে কিডনি ডায়ালাইসিস যে কতটা ব্যয়বহুল ও দুষ্প্রাপ্য চিকিৎসা, অভিজ্ঞতা না থাকলে অনুধাবন করা কঠিন। সরকারি-বেসরকারি সব হাসপাতাল মিলিয়ে সারা বাংলাদেশে প্রতিদিন যত কিডনি রোগীর ডায়ালাইসিস হয়, এককভাবে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র তারচেয়ে বেশি সংখ্যক রোগীকে ডায়ালাইসিস সেবা দেয়।

গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে ১০০ শয্যার একটি সর্বাধুনিক কিডনি ডায়ালাইসিস সেন্টার গড়ে গেছেন। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলতেন, এটাই দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় এবং উন্নত যেকোনো দেশের সঙ্গে তুলনীয় কিডনি ডায়ালাইসিস সেন্টার। খরচ অবিশ্বাস্য রকমের কম।

মুক্তিযুদ্ধের পরে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান ওষুধ নীতি প্রণয়ন। স্বাধীন বাংলাদেশের ওষুধের বাজার ছিল বহুজাতিক কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে। অনেক অপ্রয়োজনীয় ওষুধসহ প্রায় সাড়ে ৪ হাজার ওষুধ ছিল বাজারে। কিছু তারা উৎপাদন করতেন, অধিকাংশই বিদেশ থেকে আমদানি করে আনতেন।

স্বাধীনতার পর থেকেই দেশীয় ওষুধ শিল্প গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা হয়েছিল। সমাজতান্ত্রিক দেশ থেকে কম দামে ওষুধ আমদানির প্রস্তাব বিবেচনায়ও নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।

গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে ১০০ শয্যার একটি সর্বাধুনিক কিডনি ডায়ালাইসিস সেন্টার গড়ে গেছেন। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলতেন, এটাই দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় এবং উন্নত যেকোনো দেশের সঙ্গে তুলনীয় কিডনি ডায়ালাইসিস সেন্টার। খরচ অবিশ্বাস্য রকমের কম।

দেশীয় ওষুধ শিল্প ও নীতির বিষয়টি বুঝিয়েছিলেন জিয়াউর রহমানকেও। জিয়াউর রহমান চেয়েছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ তার মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়ে ওষুধ নীতি নিয়ে কাজ করুক। জিয়াউর রহমান স্বাধীনতাবিরোধী শফিউল আযমদের সঙ্গে নেওয়ায় ৪ পৃষ্ঠার চিঠি লিখে মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানান ডা. জাফরুল্লাহ। পরবর্তীতে এরশাদকে বুঝিয়ে ওষুধ নীতি করাতে সক্ষম হন ১৯৮২ সালে। সাড়ে ৪ হাজার ওষুধ থেকে প্রায় ২ হাজার ৮০০ ওষুধ নিষিদ্ধ করা হয়।

দেশীয় ওষুধ শিল্পের যে বিকাশ, তা সেই বৈপ্লবিক ওষুধ নীতিরই সুফল। এখন ১৭ কোটি মানুষের চাহিদার ৯৫ শতাংশেরও বেশি ওষুধ বাংলাদেশ উৎপাদন করে। বাংলাদেশ ওষুধ রপ্তানিকারক দেশও।

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সমালোচনা করে বলা হয়, সামরিক শাসক জিয়া ও এরশাদের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক ছিল। সুসম্পর্ক থাকার বিষয়টি অসত্য নয়। সামরিক সরকারের সঙ্গে শুধু ডা. জাফরুল্লাহর সুসম্পর্ক ছিল, আর কারও ছিল না?

এই সম্পর্ক কাজে লাগিয়ে ডা. জাফরুল্লাহ নিজের জন্য সামান্যতম কোনো সুবিধা নিয়েছেন, এমন কথা কেউ বলতে পারেন না। দেশের জন্য, প্রতিষ্ঠানের জন্য করেছেন অনেক কিছু।

অনেকেই বলে থাকেন, এমনকি কোনো কোনো পত্রিকা লিখেও এভাবে যে, 'ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর "মালিকানাধীন" গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র'। সঠিক তথ্যটি হলো, ডা. জাফরুল্লাহ গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা, কিন্তু মালিক নন। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কোনো সম্পদের ওপর তার কোনো অধিকার নেই। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের মালিক কোনো ব্যক্তি নন।

প্রশ্ন করেছিলাম গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সম্পদের পরিমাণ কত?

'হবে কয়েক হাজার কোটি টাকার', নির্বিকারভাবে উত্তর দিলেন।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের এত টাকার সম্পদ,আপনার কখনো মনে হয় না এখান থেকে নিজের কিছু পাওয়ার ছিল?

'না, না আমি টাকা-সম্পদ দিয়ে কী করব। দেশের মানুষের জন্যে আরও অনেক কিছু করার ছিল।'

শুনেছি আপনি লন্ডনে থাকা অবস্থায় ব্র্যান্ডের জামা-কাপড় পরতেন। আর আপনার গায়ের শার্টটি তো ছিঁড়ে গেছে। কতদিন আগে কেনা শার্ট এটা?

'১৪-১৫ বছর আগের। শার্ট ছেঁড়ে নাই, একটা বোতাম ছিঁড়ে গেছে (হাত দিয়ে টানতে টানতে বললেন)। আমার ৩০ বছর আগের শার্টও আছে। না ছিঁড়লে ফেলব কেন? লন্ডনে আমি সবচেয়ে দামি ব্র্যান্ডের স্যুট-টাই, জামা-জুতা পরতাম। দামি গাড়ি চালাতাম। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী আমার গাড়ি ছাড়া অন্য কারও গাড়িতে উঠতে চাইত না। পরে চিন্তা করে দেখালাম, এসব অর্থহীন। শুধু শুধু এসবের পেছনে টাকা খরচ করার মানে হয় না। স্বাধীনতার পর থেকেই আমার চিন্তায় এই পরিবর্তন এলো।'

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সবকিছুর মালিক বাংলাদেশের জনগণ। একজন রোগী বা অন্য ১০ জন মানুষের গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ওপর যে অধিকার, ডা. জাফরুল্লাহর অধিকারও তারচেয়ে বেশি ছিল না।

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার 'স্বাধীনতা দিবস পদক ও পুরস্কার', আন্তর্জাতিক অঙ্গনের প্রসিদ্ধ ম্যাগসেসেসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও সম্মানজনক পুরস্কার পেয়েছেন।

তিনি চকচকে ঝকঝকে করে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র গড়ে তোলেননি। ব্যবস্থাপনাও সেই অর্থে অত্যাধুনিক নয়। নামমাত্র মূল্য নিয়ে গরিব মানুষদের সেবা দেওয়া প্রতিষ্ঠান পাঁচ তারকা মানের করে গড়ে তোলা সম্ভব নয়,প্রয়োজনও হয়তো নেই।

অনেকেই বলে থাকেন, এমনকি কোনো কোনো পত্রিকা লিখেও এভাবে যে, 'ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর "মালিকানাধীন" গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র'। সঠিক তথ্যটি হলো, ডা. জাফরুল্লাহ গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা, কিন্তু মালিক নন। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কোনো সম্পদের ওপর তার কোনো অধিকার নেই। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের মালিক কোনো ব্যক্তি নন।

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী অসম্ভব পরিশ্রমী, কিন্তু জীবনযাপন, কাজ ও কথায় অগোছালো একটি ব্যাপার দৃশ্যমানভাবেই বোঝা যেত। সারা জীবনই যা ভালো মনে করেছেন, তা করেছেন ও বলেছেন। কখনো এর পরিণতি চিন্তা করেননি।

দুয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করলে কিছুটা হয়তো বোঝা যাবে—

ক. জিয়াউর রহমান মন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব দিয়ে ডা. জাফরুল্লাহকে বলেছিলেন, 'আপনি আপনার মতো করে স্বাধীনভাবে কাজ করবেন, যা করতে চান। আপনাকে ব্ল্যাংক চেক দেবো।'

উত্তরে ডা. জাফরুল্লাহ হাসতে হাসতে বলেছিলেন, 'তা হয় না। যারা ব্ল্যাংক চেক দেয়, তাদের ব্যাংকে টাকা নেই।'

খ. আইয়ুব খান বিরোধী আন্দোলন চলছিল। তৎকালীন গভর্নর আযম খান ঢাকা মেডিকেলে আসলেন শিক্ষার্থীদের এটা বোঝাতে যে কেন তাদের আন্দোলন করা উচিত নয়। গভর্নরের পথ আটকে হাত বাড়িয়ে দিলেন ডা. জাফরুল্লাহ। হাত ধরে বললেন, 'আপনি শিক্ষার্থীদের আন্দোলন বাদ দিয়ে পড়াশোনায় মন দিতে বলছেন। আর আমাদের ছাত্র সংসদের ভিপি আহমদ জামান ও জিএস বদরুদ্দোজা ওয়ারেন্ট নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। তা কি আপনি জানেন?'

গভর্নরের হাত ছাড়লেন না কয়েক মিনিট। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা আতঙ্কিত হয়ে উঠলেন। জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে পালাতে বললেন। তিনি পালাননি। পরবর্তীতে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজের জিএস নির্বাচিত হয়েছিলেন।

গ. মেডিকেল কলেজের ছাত্র থাকাবস্থায় শিক্ষকের দুর্নীতির বিরুদ্ধে তথ্য-প্রমাণসহ সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন তিনি।

ঘ. গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার অন্যতম পূর্বশর্ত ধূমপান করা যাবে না। ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়া আণবিক শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান এবং তার চাকরির মেয়াদ শেষ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়ার প্রত্যাশা অনুযায়ী চাকরির মেয়াদ বাড়ালেন না। ড. ওয়াজেদ মিয়া দেখা করলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত হতে চান। সমস্যা হলো ধূমপান। ড. ওয়াজেদ মিয়া প্রচুর ধূমপান করতেন। এক মাস সময় নিয়ে পরিপূর্ণভাবে ধূমপান ছেড়ে দিয়ে বিজ্ঞান উপদেষ্টা হিসেবে তিনি যুক্ত হন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সঙ্গে।

মুক্তিযুদ্ধের প্রতিষ্ঠান ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর গণস্বাস্থ্য। শারীরিকভাবে তিনি নেই। তবে তার গড়া প্রতিষ্ঠান আছে, থাকবে। জনগণের ভালোবাসায় বেঁচে থাকবেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। জনগণই তাদের প্রয়োজনে টিকিয়ে রাখবে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র।

[email protected]

Comments