মঙ্গল শোভাযাত্রা বন্ধে আইনি নোটিশ: সংস্কৃতির অভিমুখে ধর্ম

আবর্জনা থাকবেই। তা দূর করতে হবে। প্রসঙ্গ হলো, দূর করার জন্য আমরা কতটা সক্রিয়?

বৈশাখ আসবে আর তার বিরুদ্ধাচরণ হবে না, এটা ঠিক মানা যায় না। তাই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, 'এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ। তাপসনিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে, বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক।।'

আবর্জনা থাকবেই। তা দূর করতে হবে। প্রসঙ্গ হলো, দূর করার জন্য আমরা কতটা সক্রিয়? আমাদের সদিচ্ছা কতখানি? প্রতিবার বৈশাখ আসলেই একটা আস্ফালন দেখতে হয়। তা নতুন নয়, চিরাচরিত স্ক্রিপ্ট। 'অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা'—এর পাশাপাশি পহেলা বৈশাখ হারাম, মঙ্গল শোভাযাত্রা হারামসহ বিভিন্ন সংবাদ আসতে থাকে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ভরে যায় এসব সংবাদে। সবাই নিজেদের মতো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বোঝা যায় ব্যক্তি মনের চিন্তা, ভাবনা। বোঝা যায়, এই সময়ে এসেও ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, তার পাশাপাশি রাষ্ট্রও ধর্মান্ধ আচরণ করছে।

কেন এই বিভাজন? সংস্কৃতির বিরোধ থেকে মুক্তিযুদ্ধ সূচনা; তারপরে দেশ স্বাধীন। তাও কেন এত বিরুদ্ধাচরণ? কেন তারা ক্ষোভে ফেটে পড়ে? কেন তাদের প্রশ্রয় দেওয়া হয়? তা জানতে হলে জানতে হবে ইতিহাস।

'বিংশের প্রথমভাগে ১৯২০-এর দশকে এক পরিসংখ্যানে দ্যাখা গ্যালো—যথেষ্ট পরিমাণ মুসলমান ভূস্বামী শ্রেণির সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু মুসলমান সম্প্রদায় ততোদিনে এক ধরনের নতুন ইসলামী মূল্যবোধের সাথে পরিচিত হতে শুরু করেছে। এর নাম আলেম সমাজ। ...আমরা জানি, ১৯০৩ সালে লর্ড কার্জন বাংলাকে ভাগ করার সিদ্ধান্ত নেন, কারণ—বাংলা ছিল রাজনৈতিকভাবে সবচে অগ্রসর এলাকা। বাংলা এবং বাংলার হিন্দুরাই ভারতের রাজনৈতিক জাগরণে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল। প্রদেশটি যদি বিভক্ত হয়, তাহলে হিন্দুরা দুর্বল হবে এবং তাতে করে বাংলায় হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে স্থায়ী বিভাজন রচিত হবে। কাজেই ১৯০৫ সালে যখন বঙ্গভঙ্গ হয়, তখন হিন্দুরা এর প্রকাশ্যে বিরোধিতা করেন। ব্রিটিশ সরকার অনুভব করে—বাংলার হিন্দুদের রাজনৈতিক চেতনা এতো প্রবল যে—বিপ্লবী কর্মকাণ্ড মোকাবিলার ক্ষেত্রে কোনো হিন্দু কর্মকর্তাকেই পুরোপুরি আর বিশ্বাস করা যাচ্ছে না। তাই পুলিশের গোয়েন্দা শাখা পরিচালনার জন্য যুক্ত প্রদেশ থেকে কিছু মুসলমান কর্মকর্তাকে বঙ্গে প্রেরণ করা হয়। ১৯২৬ সালের পূর্বে মসজিদের সামনে বাদ্যবাদন নিয়ে হিন্দু-মুসলিম নেতাদের কখনও বিচলিত হতে হয়নি। কিন্তু এখন তা বিরাট মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ালো। একে কেন্দ্র করে জেগে উঠলো সাম্প্রদায়িক চেতনা। মসজিদের সামনে বাজনা বাজানো যাবে না, ঢোল বাজিয়ে কোনো শোভাযাত্রা করা যাবে না—এই পটভূমিতে শুধু বাংলা ক্যানো, পুরো ভারতবর্ষ সচকিত হয়ে উঠলো।' (যুদ্ধ, নীরা লাহিড়ী, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ,প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০২০, পৃষ্ঠা–২০৫, ২০৬)

এই অংশটুকু থেকে বোঝা যায়, বিভাজন রেখাটা আজকের নয়। ব্রিটিশ পিরিয়ড থেকেই চলছে। ব্রিটিশরা অর্থনৈতিক কারণে তা চাইলেও এখন তা সবার মগজে-মননে। গোটা জাতি যত বেশি বিভাজিত হবে, ততই রাষ্ট্রের সুবিধা। রাষ্ট্র তখন ইচ্ছেমতো দরকষাকষি করতে পারে। ব্রিটিশদের শেখানো বুলি আমাদের রাষ্ট্রে এখনো চলমান।

যেকোনো জাতিকে দুর্বল করতে হলে জাতির সংস্কৃতি ও শিক্ষায় আঘাত করতে হবে। এই কারণে দেশ স্বাধীন হওয়ার এত বছর পরও আমাদের পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তিত হয়ে যায়। আমাদের সংস্কৃতির শিকড় উপড়ে ফেলতে চায় উগ্রবাদীরা। তাদের এইধরনের আচরণ করবে তা মানা যায়, কিন্তু রাষ্ট্র কেন নিশ্চুপ থাকবে?

২০২৩ সালের ৯ এপ্রিল। মঙ্গল শোভাযাত্রা বন্ধে আইনি নোটিশ দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. মাহমুদুল হাসান। এই আইনি নোটিশ সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব, ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব, ঢাকার জেলা প্রশাসক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিনকে পাঠানো হয়েছে। নোটিশ পাওয়ার পর 'অসাংবিধানিক, বেআইনি ও কৃত্রিম উদ্ভাবিত' মঙ্গল শোভাযাত্রা বন্ধে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করা হয়েছে। অন্যথায় এই বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে হাইকোর্টে রিট দায়ের করা হবে বলেও নোটিশে উল্লেখ করা হয়।

নোটিশে বলা হয়েছে, 'মঙ্গল শোভাযাত্রা' নামে একটি কৃত্রিম কার্যকলাপ বাঙালি সংস্কৃতি পহেলা বৈশাখের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। মূলত এই কৃত্রিম উদ্ভাবিত মঙ্গল শোভাযাত্রার সঙ্গে পহেলা বৈশাখের কোনো সম্পর্ক নেই। 'মঙ্গল' শব্দটি একটি ধর্মীয় সংশ্লিষ্ট শব্দ। সব ধর্মের লোকজন তাদের সৃষ্টিকর্তার কাছে 'মঙ্গল' প্রার্থনা করে থাকেন। এখন এই মঙ্গল শোভাযাত্রার সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের দৈত্য আকৃতির পাখি, মাছ ও বিভিন্ন প্রাণীর ভাস্কর্য প্রদর্শনের মাধ্যমে মুসলিম জনগণের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা হচ্ছে যা বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২-ক এর সরাসরি লঙ্ঘন। এটা দণ্ডবিধির ২৯৫-ক ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধও।

মঙ্গল শোভাযাত্রা যে প্রতিবাদের প্রতীক, তা বোঝার মতো জ্ঞান নিশ্চয় তার হয়নি। এই নোটিশ পড়ে আমার বিস্ময় জাগছে না। ২০২২ সালেও আইনজীবী মো. মাহমুদুল হাসান এই ধরনের নোটিশ দিয়েছিলেন। ভবিষ্যতেও পাঠাবেন, তাই আশা করা যায়। এই নোটিশ থেকে ব্যক্তি মো. মাহমুদুল হাসান সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। মো. মাহমুদুল হাসানের কাছ থেকে আশা করার কিছু নেই।

আমাদের আশা ছিল রাষ্ট্রের কাছে। রাষ্ট্র কি তা পূরণ করছে? রাষ্ট্র কি শিশু-কিশোরদের সাংস্কৃতিভাবে গড়ে তোলার জন্য ভূমিকা রাখছে?

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় উৎসবমুখর পরিবেশে বাংলা নববর্ষ উদযাপন করবে। সব মাধ্যমিক স্কুল ও কলেজে জাতীয় সংগীত ও এসো হে বৈশাখ গান পরিবেশনের মাধ্যমে বাংলা নববর্ষ উদযাপন করবে। নববর্ষে উদযাপনের অংশ হিসেবে শিক্ষার্থীদের নিয়ে নববর্ষের সকালে আবশ্যিকভাবে র‍্যালি করতে হবে।

একই নির্দেশনা আছে মাদ্রাসাগুলোর জন্যও। দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তা পালন করলেও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ কি তা পালন করে? আজ পর্যন্ত কখনো করেছে? আলিয়া মাদ্রাসা পহেলা বৈশাখ পালন করেছে এবং মঙ্গল শোভাযাত্রার র‍্যালি করেছে,এমন নজির নেই। দুএকটা মাদ্রাসা হয়তো পহেলা বৈশাখের দিনে ইসলামিক আলোচনা করে, কিন্তু পহেলা বৈশাখ উদযাপন বলতে যা বোঝানো হয় বা র‍্যালি করা—তা কখনো করা হয় না। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ভূমিকা কী? তবে কি আমরা ধরে নেব,রাষ্ট্র তার নিজস্ব অবকাঠামোয় 'সংস্কৃতি' বিষয়টি ধারণ করে না?

সারা বছর শিক্ষার্থীদের মনন তৈরির জন্য রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কী উদ্যোগ নেওয়া হয়? দেশে সাংস্কৃতিক আন্দোলন ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগগুলো কী?

গোটা বছর মিলে একবার পহেলা বৈশাখ উদযাপন করলেই কি শিশুর মননে বাঙালি সংস্কৃতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা জন্মাবে? সরকারি পর্যায়ে একবার নির্দেশনা দিয়ে যেখানে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাংলা নববর্ষ উদযাপন করানো যায় না, সেখানে কীভাবে আশা করা যায় সবাই সংস্কৃতিপ্রেমী হবে? বা বাঙালি সংস্কৃতি ধারণ করবে? সে বাঙালি, বাংলাদেশি হওয়ার আগে তো ধার্মিক হয়ে বসে আছে।

প্রতি বছর মঙ্গল শোভাযাত্রার সময় দেখা যায়, শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারীর চেয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার লোকজনই বেশি। তাহলে প্রশ্ন জাগে কেন রাষ্ট্র এই নিরাপত্তা দিতে পারেনি? এর উত্তর সবারই জানা।

রাষ্ট্রের একপক্ষীয় আচরণ তা আরও স্পষ্ট করে রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো আদৌ কি অসাম্প্রদায়িক? ৫৬০ মডেল মসজিদের পাশাপাশি ৫৬০ মন্দির, প্যাগোডা বা গির্জা নির্মাণের প্রস্তাব কখনো আসে না। কখনো প্রস্তাব আসে না ৫৬০ সাংস্কৃতিক বিকাশ কেন্দ্র সারা দেশে নির্মাণ করা হবে, যেখানে নাট্যচর্চা, যাত্রাপালার পাশাপাশি সব ধরনের সাংস্কৃতিক আয়োজন বা পরিসর থাকবে। তবে কীভাবে আশা করবো এই দেশের মানুষ সাংস্কৃতিক বাতাবরণে ভাসবে?

সংস্কৃতিকে যেভাবে ধর্মের বিপরীতে দাঁড় করানো হয়েছে, তাতে প্রশাসন থেকে শুরু করে সরকার ছিল নীরব। আইনজীবী মো. মাহমুদুল হাসানের মতো চিন্তার অসংখ্য মানুষ তৈরিতে সহায়তা করেছে। এটা একদিনে পরিবর্তন অসম্ভব। পরিবর্তনের জন্য যে ধরনের গণজোয়ার প্রয়োজন, সেই জায়গায় সাধারণ মানুষের আগ্রহ থাকলেও রাষ্ট্র ব্যস্ত তার ভোটব্যাংক বাঁচাতে। তাই সেই ভোটব্যাংক রক্ষায় রাষ্ট্র দরকষাকষি করবে, আমাদের কষ্ট তীব্র থেকে তীব্রতর হবে। এরপরও আমরা আশা করবো, প্রতিবাদ করবো, প্রতিরোধ করবো। আমাদের প্রচেষ্টা থাকবে চলমান। আমরা হারবো না।

বিনয় দত্ত; কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক

[email protected]

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments

The Daily Star  | English
Impact of esports on Bangladeshi society

From fringe hobby to national pride

For years, gaming in Bangladesh was seen as a waste of time -- often dismissed as a frivolous activity or a distraction from more “serious” pursuits. Traditional societal norms placed little value on gaming, perceiving it as an endeavour devoid of any real-world benefits.

16h ago