মে দিবস

চা বাগানের অস্থায়ী শ্রমিকরা মজুরি বৈষম্যের শিকার

চা বাগানের অস্থায়ী শ্রমিকরা মজুরি বৈষম্যের শিকার
কাজে যাচ্ছেন ২ জন চা শ্রমিক। ছবি: স্টার

চা বাগানের স্থায়ী ও অস্থায়ী শ্রমিকরা সমান মজুরি পাওয়ার কথা থাকলেও কম মজুরি পাচ্ছেন অস্থায়ী শ্রমিকরা। সম্প্রতি মৌলভীবাজারের কয়েকটি চা বাগান পরিদর্শন করে শ্রমিকদের মধ্যে মজুরির বৈষম্যের কথা জানা যায়। শ্রমিক নেতা ও অস্থায়ী চা শ্রমিকরা জানান, স্থায়ী শ্রমিকদের চেয়ে কম মজুরি পান তারা।

শ্রীমঙ্গলের ভাড়াউড়া চা বাগানের বাগান পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি নুর মহম্মদ বলেন, কিছু অস্থায়ী চা শ্রমিক এখনও স্থায়ী চা শ্রমিকদের সমান মজুরি পান না।

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সোনাছড়া চা বাগান ইউনিটের সভাপতি কার্তিক নায়েক জানান, মজুরি চুক্তি অনুযায়ী অস্থায়ী শ্রমিকরাও স্থায়ী শ্রমিকদের সমান মজুরি পাবেন। কিন্তু অস্থায়ী চা শ্রমিকদের অধিকাংশই এখন দৈনিক ১২০ টাকা এর চেয়েও কম মজুরি পাচ্ছেন। অন্যদিকে স্থায়ী চা শ্রমিকরা পাচ্ছেন ১৭০ টাকা।

চা বাগানের অস্থায়ী শ্রমিকরা মজুরি বৈষম্যের শিকার
চা-বাগানে একাগ্র মনে কাজ করছেন একজন চা শ্রমিক। ছবি: মিন্টু দেশোয়ারা

তিনি বলেন, যেখানে রাবার শ্রমিকরা মজুরি পাচ্ছেন ১১০ টাকা সেখানে কিছু চা শ্রমিক দৈনিক মজুরি পান ৭০, ৭৫ ও ৮০ টাকা।

একটি চা বাগানের অস্থায়ী শ্রমিক ব্রিটিশ রায় বলেন, স্থায়ী চা শ্রমিকের সমান কাজ করলেও আমি ৫০ টাকা কম মজুরি পায়।

বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ মৌলভীবাজার শাখার সাধারণ সম্পাদক রজত বিশ্বাস বলেন, শ্রমিকের রক্তঝরা সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত মহান মে দিবসের ১৩৭ বছর পরও চা-শ্রমিকদের শোষণ নির্যাতন এতটুকু কমেনি। এমনকি আইনের মাধ্যমে স্বীকৃত অধিকার হতেও চা-শ্রমিকদের বঞ্চিত করা হচ্ছে। সমান কাজে সমান মজুরি দেওয়ার আইন থাকলেও চা-শ্রমিকদের আজও ক্লাস/ক্যাটাগরির নামে 'এ' 'বি' ও 'সি' করে যথাক্রমে ১৭০টাকা, ১৬৯ টাকা ও ১৬৮ টাকা দৈনিক মজুরি দেওয়া হচ্ছে।

অথচ 'বি' ও 'সি' ক্লাস বাগানের শ্রমিকদের কাজের পরিমাণ তুলনামূলক বেশি থাকে। এ ছাড়া সমান কাজ করলেও ক্যাজুয়াল শ্রমিকদের মজুরি অনেক ক্ষেত্রে কম দেওয়া হয়। আবার পুরুষ শ্রমিকদের স্ত্রীকে তাদের উপর নির্ভরশীল বিবেচনা করে রেশন দেওয়া হলেও নারী শ্রমিকের বেকার স্বামীকে নির্ভরশীল বিবেচনা করা হয় না। তাদের রেশনও দেওয়া হয় না। যুগ যুগ ধরে চা-শ্রমিকদের সঙ্গে এই অন্যায় চলে আসছে।

মহান মে দিবসের চেতনায় শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে চা শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম গড়ে তোলার বিকল্প নেই, যোগ করেন তিনি।

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের বালিশিরা ভ্যালি ইউনিটের সাংগঠনিক সম্পাদক কর্ণ তাঁতি বলেন, 'স্থায়ী চা শ্রমিকরা সব কাজেই পান ১৭০ টাকা। অস্থায়ী চা শ্রমিকরা শুধু পাতা তোলার জন্য ১৭০ টাকা আর অন্য কাজের জন্য ১২০ টাকা বা এর কম পান। আমরা বারবার প্রতিবাদ করেও কোনো লাভ হয়নি।'

চা শ্রমিক গবেষক এবং সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্টের (সেড) পরিচালক ফিলিপ গাইন বলেন, বাংলাদেশের চা শ্রমিকরা, যাদের বেশিরভাগই অবাঙালি এবং পাঁচ প্রজন্ম ধরে চা বাগানের সঙ্গে আবদ্ধ, তাদের মর্যাদাপূর্ণ জীবন নেই। বাংলাদেশের সংবিধান নাগরিকদের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা এবং চিকিৎসাসহ জীবনের মৌলিক চাহিদার গ্যারান্টি দেয়। চা বাগানের মালিক এবং সরকারি কর্তৃপক্ষ উভয়েরই চা শ্রমিকদের চাহিদা পূরণের দায়িত্ব রয়েছে।

চা শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়নের ক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কা সেরা উদাহরণ হতে পারে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি পঙ্কজ কন্দ বলেন, উইডিসাইড বা পেসটিসাইডে কাজ করা অস্থায়ী শ্রমিকদের এখনও দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা। মজুরি বৈষম্য সম্পর্কে বাংলাদেশ টি অ্যাসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি তাহসিন আহমেদ চৌধুরীকে চিঠি দিয়েছিলাম বসার জন্য। কিন্তু উনি পাত্তা দেননি।

এই বিষয়ে জানতে চাইলে তাহসিন আহমেদ চৌধুরী কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

চা বাগানের অস্থায়ী শ্রমিকরা মজুরি বৈষম্যের শিকার
স্টার ফাইল ছবি

চা বাগান মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ টি অ্যাসোসিয়েশনের সিলেট চ্যাপ্টারের চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ শিবলী বলেন, চা বাগানের প্রধান কাজ প্লাকিং। অস্থায়ী চা শ্রমিক যারা প্লাকিংয়ে কাজ করে তাদের স্থায়ী চা শ্রমিকদের সমান মজুরি দেওয়া হয়। কিন্তু যারা ৮ ঘণ্টার কম চুক্তিভিত্তে কাজ করেন বা দুই শিফটে কাজ করেন তাদের কম মজুরি দেওয়া হয়।

বাংলাদেশ টি অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান এম শাহ আলম বলেন, 'কোনো অস্থায়ী চা শ্রমিক কম মজুরি পাচ্ছেন তা আমি জানি না। তবে শ্রম আইনে ও আমাদের চুক্তিতেই স্থায়ী ও অস্থায়ী চা শ্রমিকদের সমান মজুরির বিধান রয়েছে। মজুরি বৈষম্য নিয়ে আমরা কোনো অভিযোগ পাইনি।'

বাংলাদেশ চা শিল্প ২০১৯-এর পরিসংখ্যানের সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে বর্তমানে মোট ১৬৬টি চা বাগান রয়েছে। এসব বাগানে ১ লাখ ৩ হাজার ৭৪৭ জন স্থায়ী শ্রমিক এবং ৩৬ হাজার ৪৩৭ জন অস্থায়ী শ্রমিক রয়েছে। দেশের মোট চা জনসংখ্যা, অর্থাৎ যারা স্থায়ী ও অস্থায়ী শ্রমিকদের আয়ের উপর নির্ভরশীল, তাদের সংখ্যা ৪ লাখ ৭২ লাখ ১২৫।

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি পঙ্কজ কন্দ বলেন, চা বাগানে অস্থায়ী চা শ্রমিকের সরকারি সংখ্যা ৩৬ হাজার হলেও এখন তা ৫০ হাজারের বেশি বলে ধারণা করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ চা বোর্ডের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মো. আশরাফুল ইসলাম, বলেন, আমাদের চা বাগানের স্থায়ী ও অস্থায়ী উভয় চা শ্রমিকদের সমান মজুরি দেওয়া হয়। মজুরিতে কোনো বৈষম্য করা হলে খতিয়ে দেখতে হবে।

Comments

The Daily Star  | English
remittance earning of Bangladesh

Remittance rises 30% in July

Migrants sent home $2.47 billion in the first month of the current fiscal year

6h ago