বাংলাদেশ ও বিশ্বব্যাংকের ৫০ বছরের সম্পর্ক উৎপাদন ও রূপান্তরের

প্রাথমিকভাবে, প্রকল্প তহবিলের ফলপ্রসূ ব্যবহার ছাড়া এসব ঋণের ক্ষেত্রে তেমন কোনো শর্ত ছিল না। ১৯৮০ সালের শুরুর দিকে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশে আমদানি ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু নীতিগত শর্ত যুক্ত করতে শুরু করে, যা পরবর্তীতে কাঠামোগত সমন্বয় ঋণে রূপ নেয়।

স্বাধীনতার পর যখন পুনর্বাসন ও পুনর্গঠনের জন্য সাহায্যের প্রয়োজন ছিল, তখন বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে বাংলাদেশের বেশ কিছুটা সময় লেগেছিল। এ ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল ১৯৭১ সালের আগ পর্যন্ত নেওয়া বৈদেশিক ঋণের বোঝা পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে ভাগাভাগি করা। বিষয়টি সমাধান করতে কিছুটা সময় লেগেছিল।

সেটি নিষ্পত্তি হওয়ার পর বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশে বেশ বড় পরিসরে কাজ শুরু করে। ১৯৭৩ সাল থেকে বিশ্বব্যাংক অবকাঠামো, শিল্প, খাদ্য উৎপাদন ও পরিবার পরিকল্পনার মতো ক্ষেত্রে বাজেট সহায়তা, আমদানি অর্থায়ন ও নির্দিষ্ট প্রকল্পের জন্য ঋণ প্রদান শুরু করে। এ ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল আমদানিতে অর্থায়ন। পরবর্তী এক দশকে বাংলাদেশ এ ধরনের ১৩টি ঋণ পেয়েছে।

প্রাথমিকভাবে, প্রকল্প তহবিলের ফলপ্রসূ ব্যবহার ছাড়া এসব ঋণের ক্ষেত্রে তেমন কোনো শর্ত ছিল না। ১৯৮০ সালের শুরুর দিকে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশে আমদানি ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু নীতিগত শর্ত যুক্ত করতে শুরু করে, যা পরবর্তীতে কাঠামোগত সমন্বয় ঋণে রূপ নেয়। এই সময়টাতেই বিশ্বব্যাংক উন্নয়নশীল দেশগুলোতে কাঠামোগত সমন্বয়ে পরামর্শ দিতে শুরু করে। বিশেষ করে ১৯৬০ ও ১৯৭০ এর দশকে প্রকল্প ঋণ নিয়ে তাদের সন্তোষজনক অভিজ্ঞতা বিশ্বব্যাংককে নিশ্চিত করে যে উন্নয়নশীল দেশগুলোর নীতি কাঠামোতে কিছু পরিবর্তন প্রয়োজন। এগুলো ছাড়া উন্নয়নের লক্ষ্য অপূর্ণ থেকে যাবে।

এই সমন্বয়ের জন্য তারা ঋণের সঙ্গে নীতিগত শর্ত দিতে শুরু করে। শর্তের মধ্যে বেসরকারিকরণ, আমদানি উদারীকরণ, ভর্তুকি অপসারণ বা কমানোর মতো মূল্য সংস্কার, কর আদায় বৃদ্ধি, আর্থিক খাতের সংস্কার, উন্নত আর্থিক ব্যবস্থাপনাসহ বিস্তৃত ক্ষেত্র রয়েছে।

অনেক বাংলাদেশি বিশ্বাস করেন, বিশ্বব্যাংকের আরোপিত এসব শর্তের অনেকগুলো বা অধিকাংশই দেশের জন্য অনুপযুক্ত এবং কিছু ক্ষেত্রে ক্ষতিকর। তারা মনে করেন, দাতাদের ওপর নির্ভরশীলতা এবং শর্ত মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানানোর অক্ষমতা বা প্রবণতার কারণে সরকার শর্ত মেনে নেয়।

কিছু ক্ষেত্রে সঠিক হলেও, এ আশঙ্কা ব্যাপকভাবে ভুল প্রমাণিত হয়েছে। ৩টি বিষয় উল্লেখ করি। প্রথমত, এখন পর্যন্ত সব সরকারই প্রায়শই দাতাদের শর্ত নিয়ে ঢিলেমি করেছে। তারা তাদের নিজস্ব গতিতে সংস্কার করেছে। দ্বিতীয়ত, দাতাদের শর্তগুলো প্রায়শই সরকারের নীতিগত অভিপ্রায়কেই প্রতিফলিত করেছে। উদাহরণস্বরূপ, বিশ্বব্যাংক সরকারের সঙ্গে ক্রমাগত সংলাপের মাধ্যমেই এ বিষয়ে সমঝোতায় পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছিল যে কোন খাতে নীতিগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বা কোন খাতে সংস্কার করা হবে। এর মধ্যে কয়েকটি অন্তর্ভুক্ত করা হয় ঋণের অর্থ ছাড়ের শর্তে।

সাবেক অর্থমন্ত্রী মোহাম্মদ সাইদুজ্জামানের একটি মন্তব্যে এই বিষয়টি প্রতিফলিত হয়। তিনি দাতাদের সঙ্গে কাজ করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে অভিজ্ঞ বাংলাদেশি নীতি নির্ধারকদের একজন ছিলেন। ২০০৪ সালে সিপিডি ভলিউম 'রিভিজিটিং ফরেন এইড: অ্যা রিভিউ অব বাংলাদেশস ডেভেলপমেন্ট ২০০৩' এ প্রকাশিত 'এইড অ্যান্ড পলিসি রিফরমস ইন বাংলাদেশ' প্রবন্ধে ১৯৮০'র দশকে বিশ্বব্যাংকের সহজ ঋণদান উইং আইডিএ সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, 'প্রকৃতপক্ষে, অনেক ক্ষেত্রেই আইডিএ সদস্যরা নীতিভিত্তিক আমদানি ঋণকে ন্যায্যতা দিতে সরকারের গৃহীত উদ্যোগগুলোকেই গ্রহণ করে।' তার এই মন্তব্য থেকে দৃঢ় ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে সরকারের নেওয়া অনেক নীতিগত ব্যবস্থাই পরবর্তীতে দাতাদের সমর্থন পায়।

তৃতীয় বিষয়টি বিশ্বব্যাংক প্রদত্ত নীতি সংস্কারের প্রভাব সম্পর্কে। বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে বাংলাদেশে সবচেয়ে বিতর্কিত যে ব্যবস্থাটি নেওয়া হয়েছে তা হলো আদমজী জুট মিল বন্ধ করা। ১৯৭০ ও ১৯৮০র দশকে বিশ্বব্যাংক রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন পাট শিল্পের আধুনিকায়নে সহায়তা করার জন্য বেশ কিছু ঋণ দেয়। তবে, এর ফলাফল সন্তোষজনক ছিল না। তখন বিশ্বব্যাংক এই সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে কিছু পাটকল বেসরকারিকরণ এবং বাকিগুলো বন্ধ করে দেওয়া বাংলাদেশের জন্য ভালো হবে।

এর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হচ্ছে আদমজী জুট মিল। ২০০২ সালে মিলটি বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং এর ফলে ২৬ হাজার মানুষ চাকরি হারান। বাংলাদেশের অনেক মানুষ এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেন এবং বিশ্বব্যাংককে এই অভিযোগে অভিযুক্ত করেন যে তারা দেশকে শিল্পহীন করতে চাইছে। পরবর্তীকালে আদমজী জুট মিলের জমিতে একটি রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল তৈরি করা হয়। আমার কাছে ২০১৯ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত যে তথ্য আছে সে অনুযায়ী, সেখানে ৫৫ হাজারের বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। আদমজী জুট মিল বন্ধ হওয়ায় যত মানুষ চাকরি হারিয়েছিলেন, তার প্রায় দ্বিগুণ মানুষের চাকরির ব্যবস্থা হয় এই রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে। একটি গতিশীল অর্থনীতির জন্য অলাভজনক খাত থেকে কার্যক্রম সরিয়ে নিতে হয় প্রতিশ্রুতিশীল কাজের দিকে। বিশ্বব্যাংকের আদমজী জুট মিল বন্ধ করার পরামর্শ অর্থনীতির এই গুরুত্বপূর্ণ পাঠের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল এবং আদমজী ইপিজেডের বাস্তবতা তা প্রমাণও করেছে।

বিশ্বব্যাংক গ্রুপ দেশের অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্মসূচির উন্নয়নেও সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। একটি উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তরমূলক এজেন্ডার জন্য বিশ্বব্যাংক গ্রুপের ভূমিকার একটি ভালো উদাহরণ এই সহায়তা। ২০০৭ সালে বিশ্বব্যাংক গ্রুপের একটি শাখা ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি) একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যেখানে তারা দেশে বেশ কয়েকটি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশে আরও সংগঠিত ও পরিবেশবান্ধব শিল্পায়নের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে। আন্তর্জাতিক অনুশীলনের ওপর ভিত্তি করে এই উদ্যোগ বাস্তবায়নে বিভিন্ন ধরণের পাবলিক-প্রাইভেট মডেল গ্রহণের পক্ষেও তারা যুক্তি দেয়।

সরকার এসব যুক্তি গ্রহণ এবং উচ্চাভিলাষী অর্থনৈতিক অঞ্চলের কর্মসূচি হাতে নেওয়ার পর আইএফসি অর্থনৈতিক অঞ্চল আইন এবং সংশ্লিষ্ট বিধি ও প্রবিধানের খসড়া তৈরিতে সহায়তা করে। সেইসঙ্গে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা ও প্রতিষ্ঠান নির্মাণে সহায়তা করে। পরবর্তীতে বিশ্বব্যাংক অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে অবকাঠামো নির্মাণের জন্য ঋণ দেয়। এখন এই অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে বিদেশি বিনিয়োগকে আকৃষ্ট করার গ্যারান্টি নিয়ে বিশ্বব্যাংক গ্রুপের আরেকটি সংস্থা মাল্টিল্যাটারাল ইনভেস্টমেন্ট গ্যারান্টি এজেন্সি (এমআইজিএ) কথা বলছে। বিশ্বব্যাংক গ্রুপ কীভাবে জ্ঞান, প্রযুক্তি ও ঋণসহ বিস্তৃত পরিসরে একটি দেশের উন্নয়নে সমর্থন দিতে পারে তার একটি ভালো উদাহরণ এটি।

আগামীতে দেশি হোক আর বিদেশি—বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরির ওপর জোর দেওয়া হবে। বিনিয়োগের পরিবেশ উন্নত করা, বেসরকারি বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং বেসরকারি বিনিয়োগ ঝুঁকিমুক্ত করার মতো নানান বিষয় এর সঙ্গে জড়িত। সেক্ষেত্রে আইএফসি এবং এমআইজিএ এর আরও সম্পৃক্ততা আমরা দেখতে পাব।

এক কথায় বলতে গেলে, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্বব্যাংক গ্রুপের মধ্যে সম্পর্ক অনেকাংশে ফলপ্রসূ। বাংলাদেশের নীতি নির্ধারক এবং উন্নয়ন সহযোগীদের মধ্যে নিশ্চয়ই এতগুলো বছরে অনেক বিতর্ক হয়েছে। কখনো কখনো এসব বিতর্ক রূপ নিয়েছে তীব্র আকারে। তবে, উভয় পক্ষেরই সমাধানে পৌঁছানোর জন্য একটি বাস্তবসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে।

আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, এই ২ পক্ষ প্রায়শই একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য একটি পথ তৈরির চেষ্টা করেছে। তারা একে অপরের অবস্থান ও সীমাবদ্ধতা বোঝার চেষ্টা করেছে। যখন সেই পথ তৈরি হলো, তখন আলোচনাগুলো হয়ে উঠলো ফলপ্রসূ, ইতিবাচক এবং কখনো কখনো বদলে দেওয়ার হাতিয়ার।

Comments

The Daily Star  | English

Khaleda returns home after 6 days in hospital

Thousands of party activists, along with senior BNP leaders, are escorting Khaleda's convoy back to her Gulshan residence

25m ago