মান্টো: যে নাম সর্বকালে আত্মোপলব্ধির

তাইতো নিজের মৃত্যুর এক বছর আগে মান্টো লিখেছিলেন, ‘এখানে সমাধিতলে শুয়ে আছে মান্টো। আর তার বুকে সমাহিত হয়ে আছে গল্প লেখার সমস্ত কৌশল।’ কিংবা ফিরে যাই মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে মান্টোর এপিটাফে। যেখানে লেখা ছিল, ‘কে বেশি ভালো গল্প লিখতে পারে? খোদা নাকি মান্টো?’
সাদত হাসান মান্টো
সাদত হাসান মান্টো। ছবি: সংগৃহীত

'মান্টো', দুই অক্ষরের এই একটি নামই সর্বকাল, সর্বস্থানে বটবৃক্ষের মতো গভীরভাবে প্রোথিত। দেশভাগের তীব্র যন্ত্রণা, সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ততা, ধর্মান্ধতা আর উগ্রবাদে নির্মিত এক ভয়াবহ সমাজে আমরা যখন  নিজেদেরই অবচেতন মনে হারিয়ে ফেলি, তখন মান্টো যেন আত্মোপলব্ধির মতো করেই ফিরে আসেন আমাদের মাঝে। তিনি ফিরে আসেন আলোকবর্তিকা হয়ে। মান্টো বলে যান 'যে সময়ে আমরা বেঁচে আছি তার সঙ্গে যদি আপনার পরিচয় না থাকে তবে আমার গল্প পড়ুন। যদি আমার গল্প সহ্য করতে না পারেন তবে বুঝতে পারবেন সময়টা দুর্বিষহ এবং প্রতিকূলে।'

মান্টো কখনো বিপ্লবী, কখনো হন নিষিদ্ধ, কখনো সাম্প্রদায়িকতার নিষিক্ত বিষবাষ্পের বিরুদ্ধে দীপ্ত পদক্ষেপে বলে যান তার আত্মকথন। মান্টোর প্রতিটি বাক্য দেশভাগের অসীম যন্ত্রণায় চোখে চোখ রেখে দৃঢ় কণ্ঠে বলত ইতিহাস আর বর্তমানের নিষ্ঠুরতম সত্যটি। যে আঙ্গুল বারবার টর্নেডোর মতো আঘাত হানতো সমস্ত শাসক ও শোষকের প্রতি। জীবন কখনোই অনুকূলে ছিল না মান্টোর। কিন্তু তারপরও তিনি দেখিয়েছেন জীবনের আলোকোজ্জ্বল পথেও কতখানি আঁধার থাকে, কতখানি পূর্ণতার মাঝে পাওয়া যায় গভীরতম শূন্যতা।

সাদত হাসান মান্টোকে কখনো পড়তে হয়েছিল শাসক শ্রেণির চক্ষুশূলে। কেবল জন্মভূমি ভারতেই তার বিরুদ্ধে অশ্লীলতার অভিযোগে মামলা হয়েছিল তিন-তিনবার। মান্টোর লেখা 'খোল দো' গল্প প্রকাশের দায়ে বাধ্যতামূলকভাবে উর্দু মাসিক সাহিত্য পত্রিকা 'নাকুশ'-এর প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল ৬ মাসের জন্য। 'ঠান্ডা গোস্ত' প্রকাশের জন্য জরিমানা করা হয়েছিল 'জাবেদ সাময়িকী'কে। তার লেখা 'আউর দরমিয়ান'-এর ছাপা নিষিদ্ধ করা হলে কোনো পত্রিকাই মান্টোর পরবর্তী কিস্তিগুলো ছাপতে রাজি হয়নি। ১৯৫০ সালের আগস্টে 'বিটার ফ্রুট' গল্পের জন্যে অশ্লীলতার অভিযোগে তাকে অভিযুক্ত হয়ে যেতে হয়েছিল লাহোর আদালতের আঙ্গিনা অব্দি।

চরম আর্থিক দুরবস্থার কারণে ভালো আইনজীবীও নিয়োগ করতে পারেননি মান্টো। এগিয়ে এসেছিলেন তরুণ আইনজীবী শেখ খুরশিদ আলম। তিনিসহ তিন জন তরুণ আইনজীবী মান্টোর পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। মান্টোর জীবন ছিল আজীবন অবরুদ্ধের মতো। তাকে মুছে ফেলতে চেয়েছিল শাসকেরা। কিন্তু মান্টো হয়ে উঠলেন সর্বকালের। কেবল শাসকশ্রেণি আর ধর্মান্ধ সমাজই নয়, বরং প্রগতিশীল সমাজ, প্রগতিশীল লেখকেরা একপ্রকার নিষিদ্ধ করে ফেলেছিল তাকে। সেই মান্টো কভু মাথা নোয়াননি।

মান্টো কখনোই বিশেষ পক্ষপাতী ছিলেন না বলে তাকে বারেবারে হতে হয়েছিল বিছিন্ন। তার সিয়াহ হাশিয়ে বইয়ের ভূমিকা লেখার প্রসঙ্গে যাই। মান্টো হাসান আসকারিকে বলেছিলেন সিয়াহ হাশিয়ে বইয়ের ভূমিকা লিখতে। হাসান আসকারিও মান্টোর কথা মতো ঠিক করলেন মান্টোর বইয়ের ভূমিকা লিখলেন। তখন আসকারি সদ্য দায়িত্ব পেয়েছেন পাকিস্তানের পরিচয় কেমন হবে সেই পরিকল্পনার উপদেষ্টা হিসেবে। এদিকে হাসান আসকারি ছিলেন লেখক সংঘের বিরুদ্ধে। অন্যদিকে লেখক সংঘের দুই সাহিত্যিক ও কবি আহমদ নাদিম কাজমি ও সরদার জাফরি মান্টোকে বললেন হাসান আসকারিকে দিয়ে তিনি যেন তার বইয়ের ভূমিকা না লেখান। কিন্তু সেই অনুরোধের কোনো জবাব দিলেন না মান্টো। যার পরিপ্রেক্ষিতে এতদিন সুসম্পর্ক থাকা প্রগতিশীল লেখকদের সঙ্গেও চূড়ান্ত বিচ্ছেদ হয়ে গেল মান্টোর। তিনি হয়ে গেলেন বন্ধুহীন। প্রিয় বন্ধু ইসমত চুগতাইকে গভীর আক্ষেপে চিঠিতে লিখেছিলেন, 'আমি ফিরে যেতে চাই বোম্বাইতে। দেখো যদি ব্যবস্থা করা যায়।' কিন্তু মান্টো জানতেন না ততদিনে তার বোম্বাইতে ফেরার পথও বন্ধ হয়ে গেছে।

যে মান্টোকে আজ বলা হয় উর্দু সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ গল্পকার, সেই মান্টো স্কুলের ক্লাসের উর্দু পরীক্ষায় কখনো উত্তীর্ণ হতে পারেননি। আবার সেই মান্টোই হিন্দু মহাসভা কলেজ থেকে টানা দু'বার এফএ পরীক্ষায় ফেল করেছিলেন। যে মান্টোকে বলা হয় উপমহাদেশের সবচেয়ে নির্মম গল্পকার, সে মান্টোর উপরেই এসেছিল ভয়ঙ্কর নির্মমতা।

তাইতো নিজের মৃত্যুর এক বছর আগে মান্টো লিখেছিলেন, 'এখানে সমাধিতলে শুয়ে আছে মান্টো। আর তার বুকে সমাহিত হয়ে আছে গল্প লেখার সমস্ত কৌশল।' কিংবা ফিরে যাই মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে মান্টোর এপিটাফে। যেখানে লেখা ছিল, 'কে বেশি ভালো গল্প লিখতে পারে? খোদা নাকি মান্টো?'

মান্টোর মাথায় যখন নতুন গল্প লেখার ভাবনা আসত তখন তিনি সারারাত ধরে ভাবতেন কীভাবে গল্পের শুরুটা হবে। ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে খবরের কাগজের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত চলত পড়া। যদি মিলে যায় গল্পের নতুন বিষয়। কখনো স্ত্রীর সঙ্গে বিনাকারণে ঝগড়া। তাতেও যদি মেলে গল্পের খোঁজ। আর শেষ অবলম্বন খানিকটা ভিন্ন। রাস্তায় নেমে প্রথমে একটি পান কিনে চোখ বুজবেন মান্টো। অতঃপর জীবন দেখতে দেখতে গল্প লেখার রসদের খোঁজ। আত্মোপলব্ধির প্রকৃষ্ট উদাহরণ বুঝি একেই বলে!

বলে রাখা ভালো যে মান্টোর জীবনে গল্পের রসদের অভাব হয়নি। কিন্তু তা প্রকৃত কিংবা সত্য ঘটনা না হলে ছুঁড়ে ফেলে দিতেন মান্টো। যদি তা না করতেন তবে বোম্বাইয়ের ফিল্মিস্তানে কাটানো প্রথম জীবনেই চলচ্চিত্রের অভিনেতা, প্রযোজকদের নিয়ে শয়ে শয়ে গল্প ফাঁদতে পারতেন মান্টো। কিন্তু সচেতনভাবেই তা এড়িয়ে গেছেন মান্টো। তাইতো তার গল্পে পাওয়া যায় না অবাস্তব কোনো চরিত্র। জীবনকে পূর্ণ বাস্তবতায় মান্টো তুলে এনেছেন গল্পের ভাষায়। তাইতো টোবা টেক সিং গল্পে আমরা দেখি বিষান সিং নামের এক অমুসলিম পাগলের নির্মম চিত্র। দেশভাগের দুই তিন বছর পরে দুই দেশের সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পাগলদেরও ভাগাভাগি হবে। অর্থাৎ অমুসলিম পাগলদের ভারত এবং মুসলিম পাগলদের পাঠানো হবে পাকিস্তানে। লাহোরের মানসিক হাসপাতালে থাকা পাগল বিষান সিং বাকি সহবন্দীদের সাথে এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করছে কী করে নিজ গ্রামে ফেরা যায়। যেহেতু সে অমুসলিম তাই ভারতে চলে যেতে হবে তাকে। কিন্তু বিষান সিং ফিরে যেতে চায় পাকিস্তানে তার প্রিয় গ্রাম টোবা টেক সিং এ।

দেশহীন নাগরিকের সেই নির্মম আখ্যান মান্টো লিখেছেন এমন ভাবেই। 'সূর্য উঠবার কিছুক্ষণ আগে, তখনো ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা বিষান সিংয়ের গলা চিরে একটা তীব্র বিলাপ বেরিয়ে এলো। কর্মচারীরা, কর্তারা, সবাই ছুটে এলো উর্ধ্বশ্বাসে। দেখতে পেলো, যে লোকটা গত পনেরো বছর দিনরাত ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে কাটিয়েছে, সে পড়ে আছে জমির ওপর, উপুড় হয়ে। তার পেছনে কাঁটাতারের বেড়া, সেদিকে ভারতবর্ষ। সামনে ঐরকমই আরেকটা কাঁটাতারের বেড়া, তার ওপাশে পাকিস্তান। মাঝখানে, যে জায়গাটা কোনো দেশেরই নয়, সেখানে পড়ে আছে বিষণ সিং বা টোবা টেক সিং-এর মৃতদেহ।'

মান্টো নিজেও কি সেই বিষান সিংয়ের বাইরে? সেই আত্মোপলব্ধির বাইরে? সাতচল্লিশে নির্মম দেশভাগ হয়ে গেল। ততদিনে ভারতে ও পাকিস্তানে চলল হিন্দু মুসলমানের মধ্যে তীব্র সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। যার শিকার হলেন মান্টো। প্রভাবশালী অভিনেতা অশোক কুমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও তার আশ্চর্য নীরবতা প্রচণ্ড আঘাত করেছিল মান্টোকে। যেই ফিল্মিস্থান ছিল মান্টোর চিরচেনা জগত সেই চিরচেনা মানুষগুলো অচেনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

ঠিক এমন সময়ে সেই 'সিয়াহ হাশিয়ে' লিখছেন মান্টো। যেখানে তিনি তুলে ধরলেন কোথায় আছেন তিনি, কেমন আছেন! তখন সদ্য গুছিয়ে উঠছে পাকিস্তানের লাহোরের চলচ্চিত্র জগত।

যে মান্টো একসময় স্বপ্ন দেখতেন তিনি ভগত সিংহের মতো ইংরেজ তাড়াচ্ছেন। অন্যদিকে দিনভর অমৃতসরের রাস্তায় রাস্তায় ঘোরা আর দুচোখ জুড়ে স্বাধীনতার স্বপ্ন। মান্টোর পকেটে সিগারেট, রোদের মধ্যে এপার থেকে ওপাড়, বিরাম নেই তার মান্টোর সিগারেট ফুঁকছেন আর ইংরেজ তাড়িয়ে বিপ্লবের স্বপ্নে কাতর হচ্ছেন সেই মান্টোই এখন বাধ্য হয়ে মাতৃভূমি ছেড়ে পালাতে চাইছেন অচেনা ভূমি পাকিস্তানে। তার চতুর্দিকের চেনা জগত আজ অচেনা। একপ্রকার বাধ্য হয়েই বোম্বে ছেড়ে লাহোর চলে গেলেন মান্টো। যাওয়ার সময় যে জিনিস দেখে চোখে জল এলো মান্টোর। কেউ আসেনি তাকে বিদায় জানাতে একমাত্র বন্ধু অভিনেতা শ্যাম ছাড়া।

লাহোরে আসার পরেও দুর্ভাগ্য পিছু ছাড়েনি মান্টোর। এতদিনের চিরচেনা মাতৃভূমি ছেড়ে নতুন দেশের নতুন জগতে হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে পারলেন না মান্টো। অচেনা দেশ, অচেনা ভূমি। চাকরি নেই তার। উপার্জনের একমাত্র উপায় পত্রিকায় গল্প লেখা। প্রত্যহ বিকেল হলেই বেরিয়ে পড়ে পত্রিকা অফিসে গিয়ে বলতেন 'টাকা দিন, লিখে শোধ করে দেবো।' একজন লেখক কিংবা গল্পকারের জন্য এটি উচ্চারণ যে কতোটা নিষ্ঠুর তা বলার অপেক্ষা রাখে না। যে মান্টো একসময় গল্পের জন্য স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া করতে দ্বিধা করতেন না। যে মান্টো খবরের কাগজের আদ্যোপান্ত খুঁজে বেড়াতেন কাহিনীর খোঁজে। সেই মান্টোর গল্পের রসদ চুকেছে বটে কিন্তু তা রীতিমতো বাধ্য হয়ে।

মদ আর বাজার খরচের টাকার জন্য দুশ্চিন্তিত লেখক মান্টো সদ্য দেখা দাঙ্গার গল্প লিখে দেন কাঁপা কাঁপা হাতে। সেই গল্প কখনো কেবল এক লাইন, বেশি হলে পৃষ্ঠা দেড়েক। এভাবে লেখা ৩২টা গল্প নিয়ে প্রকাশিত হয়ছিল সিয়াহ হাশিয়ে বা কালো সীমানা।

মাত্র ৪২ বছরের জীবন পরিধি ছিল মান্টোর। জীবনের ২২তম বছরে ভিক্টর হুগোর বিখ্যাত 'The last Day of a Condemned Man' এর উর্দু অনুবাদ 'সারগুজাস্‌ত-ই-আসির' এর মধ্য দিয়ে সাহিত্যে হাতেখড়ি মান্টোর। পরের ২০ বছরে ২২টি ছোটগল্পের বই, তিনটি স্মৃতিকথা, একটি উপন্যাসের জন্ম মান্টোর হাতে। নিজের জীবনের সমস্ত সাক্ষ্য আর আত্মোপলব্ধি নিজের গল্পের চরিত্রের মধ্য দিয়েই ঢেলে সাজিয়েছেন মান্টো।

কিন্তু সৃষ্টিকর্মের সংখ্যা আর পরিসংখ্যানের বিচারে যদি মান্টোকে মাপা হয় তবে তা হবে সবচেয়ে বড় ভুল। তাইতো কৃষণ চন্দরের গলায় বলতে হয় 'উর্দু সাহিত্যে অনেক ভালো গল্পকারের জন্ম হয়েছে; কিন্তু মান্টো দ্বিতীয়বার জন্ম নেবে না, আর তার স্থান কেউ পূরণ করতে পারবে না। মান্টোর বিদ্রোহ আধুনিক সভ্যতার পাপের বিরুদ্ধে। তার এই প্রচ্ছন্ন বিদ্রোহের মাঝে আমরা খুঁজে পাই মান্টোর ক্ষোভ, ঘৃণা আর ভালোবাসা।'

কিংবদন্তি গল্পকার সাদত হাসান মান্টোর ১১১তম জন্মদিনে তার প্রতি জানাই শ্রদ্ধা।

সূত্র-

Manto Naama/ Jagdish Chander Wadhawan

The Life and Works of Saadat Hasan Manto/ Tahira Naqvi

[email protected]

Comments