ভবিষ্যৎ নেতা হতে কাতারে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭ পরামর্শ

দোহায় কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ কমপ্লেক্স মিলনায়তনে শিক্ষার্থীদের সামনে বক্তৃতাকালে তিনি এসব পরামর্শ দেন।
দোহায় কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য আয়োজিত অধিবেশনে বক্তব্য দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছবি: বাসস

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ মঙ্গলবার কাতারের শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নেতা হওয়ার জন্য তার জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে অর্জিত ৭টি পরামর্শ তুলে ধরেছেন।

দোহায় কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ কমপ্লেক্স মিলনায়তনে শিক্ষার্থীদের সামনে বক্তৃতাকালে তিনি এসব পরামর্শ দেন।

তিনি 'বাংলাদেশ: আ ডেভেলপমেন্ট মডেল: লার্নিং ফ্রম শেখ হাসিনা' প্রতিপাদ্যের ওপর বক্তৃতা করেন।

তিনি বলেন, 'আমি আমার জীবনের অভিজ্ঞতা ও সংগ্রাম থেকে ভবিষ্যৎ নেতাদের জন্য কয়েকটি পরামর্শ দিতে চাই। প্রথম-উপযুক্ত মূল্য উপস্থাপন করুন, দ্বিতীয়-আপনার দৃষ্টিভঙ্গিতে মনোনিবেশ করুন, তৃতীয়-আপনার দৃষ্টিভঙ্গি উপলব্ধি করার জন্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করুন, চতুর্থ-উদাহরণ দিয়ে নেতৃত্ব দিন এবং পরিবর্তনকারী নির্মাতা হোন, পঞ্চম-আপনার মানুষ ও দলকে বিশ্বাস করুন, ষষ্ঠ-আপনার মাতৃআত্মাকে আহ্বান করুন এবং সপ্তম-নতুন ও ভবিষ্যতকে আলিঙ্গন করুন।'

বাংলাদেশের ইতিহাস ও সাম্প্রতিক উন্নয়নের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেন, বাংলাদেশ ভূখণ্ড একসময় ঐশ্বর্য ও সমৃদ্ধির দেশ ছিল। ১৯৪৭ সালে অবিভক্ত ভারত বিভক্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত ঔপনিবেশিক শাসকরা এটিকে নির্মমভাবে শোষণ ও লুণ্ঠন করেছিল এবং তারপরে পাকিস্তানিরা।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, দুর্ভিক্ষ, চরম দারিদ্র্য, অনাহার, অপুষ্টি, মৃত্যু ইত্যাদির ব্যাপকতা এই ভূখণ্ডে সাধারণ জনগণের প্রতি শাসকদের প্রতিশ্রুতিহীনতার কারণে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল।

তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দীর্ঘ ২৩ বছরের সংগ্রাম ও ৯ মাসের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালে স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জন্ম হয়।

শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তার সরকারের প্রথম শাসনামলে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক রূপান্তরের জন্য একটি দৃঢ় ভিত্তি গড়ে তুলতে সক্ষম হয়।

তিনি বলেন, ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে তার দল পুনরায় ক্ষমতায় আসার পর এবং এরপর পরপর আরও দুই মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর গত সাড়ে ১৪ বছর তারা বাংলাদেশকে তার বাবার স্বপ্নের সুখী ও সমৃদ্ধ 'সোনার বাংলাদেশ' এর জন্য প্রস্তুত করেছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, '২০১৫ সালে বাংলাদেশ নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয় এবং আমরা ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশ ও ২০৪১ সালের মধ্যে উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার স্বপ্ন দেখি। এরই মধ্যে আমরা স্বল্পোন্নত দেশ থেকে ২০২৬ সালের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছি।'

তিনি বলেন, বাংলাদেশ প্রায় সব আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে প্রশংসনীয় অগ্রগতি অর্জন করেছে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষা ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজ এবং নারীর ক্ষমতায়নের মতো কয়েকটি ক্ষেত্রের উন্নয়নের ওপর আলোকপাত করেছে।

তিনি বলেন, 'বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৩৫তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ, যার জিডিপি হচ্ছে ৪৬০ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০০৫-২০০৬ সালে জিডিপির আকার ছিল মাত্র ৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০০৬ সালে মাথাপিছু আয় ছিল ৫৪৩ মার্কিন ডলার, যা ২০২২ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৮২৪ মার্কিন ডলারে। ২০০৫-২০০৬ সালে মাথাপিছু দারিদ্র্যের হার ছিল ৪১ দশমিক ৫ শতাংশ, যেখানে বর্তমান দারিদ্র্যের হার ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ এবং চরম দারিদ্র্যের হার ৫ দশমিক ৬ শতাংশে নেমে এসেছে।'

২০০৫-২০০৬ অর্থবছরে দেশের জাতীয় বাজেটের আকার ছিল ৬১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে বাজেটের আকার দাঁড়ায় ৬ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকায়। ২০০৫-২০০৬ অর্থবছরে রপ্তানি আয় ছিল ১০ দশমিক ৫২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যেখানে ২০২১-২০২২ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে।

তিনি আরও বলেন, গত দেড় দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতি গড়ে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং মহামারি আঘাত হানার আগে ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ছিল ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'আমরা খাদ্য-নিরাপত্তা, বিনামূল্যে ও সাশ্রয়ী মূল্যের আবাসন, কমিউনিটি স্বাস্থ্যসেবা, বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, আর্থিক অন্তর্ভুক্তি, ডিজিটাল সেবা, বিদ্যুতের সহজলভ্যতা, দুর্যোগ প্রস্তুতি এবং জলবায়ু অভিযোজনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছি।'

এ ছাড়া, গৃহহীন পরিবারগুলোর জন্য বিনামূল্যে গৃহ নির্মাণে বাস্তবায়নাধীন আশ্রয়ণ প্রকল্প, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য ১৮ হাজারের বেশি কমিউনিটি ক্লিনিক ও পল্লী স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপন, সমাজের দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সহায়তায় সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী সম্প্রসারণ এবং শিক্ষা খাতে উন্নয়নের ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।

তিনি বলেন, 'আমরা জ্ঞানভিত্তিক স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে চাই। স্মার্ট বাংলাদেশে থাকবে স্মার্ট সরকার, স্মার্ট অর্থনীতি, স্মার্ট জনগোষ্ঠী, স্মার্ট সমাজ এবং স্মার্ট জনশক্তি। মানুষকে ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহারে দক্ষ করে তোলা হবে, যেন তারা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে অবদান রাখতে পারে।'

নারী শিক্ষা প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, 'আমার সরকার নারী শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। এক দশকের প্রচেষ্টার পরে আমরা এখন লিঙ্গ বৈষম্য হ্রাসে দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ অবস্থানে আছি… প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় আমাদের মেয়েদের পক্ষে লিঙ্গ সমতা রয়েছে।'

নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, 'নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে আমরা বিশ্বের শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে রয়েছি। বাংলাদেশ সম্ভবত একমাত্র দেশ যেখানে প্রধানমন্ত্রী, সংসদের স্পিকার, বিরোধী দলীয় নেতা এবং সংসদ উপনেতা সবাই নারী। স্থানীয় সরকারের ক্ষেত্রে নারীদের জন্য ৩৩ শতাংশ সংরক্ষিত আসন রয়েছে। আমি আমাদের যোগ্য নারীদের সর্বত্র শীর্ষ নেতৃত্বের পদে বসিয়ে সমস্ত কাচের আবরণ ভেঙে দেওয়ার বিষয়টিকে তুলে ধরেছি।'

প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'আজকের বাংলাদেশ একটি পরিবর্তিত বাংলাদেশ। একে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অপুষ্টি, নিরক্ষরতা ইত্যাদি দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে। দেশে আমাদের কষ্টার্জিত উন্নয়ন অলৌকিক কিছু নয়। এটা আমাদের নারী ও পুরুষের সম্মিলিত কাজ। আমি শুধু তাদের কাঙ্ক্ষিত পথে পরিচালিত করার চেষ্টা করেছি। তবে আজকের অবস্থানে পৌঁছানো সহজ যাত্রা ছিল না। আমাকে সারাজীবন প্রচুর অগ্নিপরীক্ষা ও নিপীড়নের সম্মুখীন হতে হয়েছে।'

অগ্নিপরীক্ষা ও নিপীড়নের কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, 'আমি শুধু আমার দেশবাসীর ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য সংগ্রাম চালিয়ে গেছি। যতদিন বেঁচে থাকব ততদিন এটা চালিয়ে যাব, ইনশাআল্লাহ। আমার স্বপ্ন আমাদের ব-দ্বীপকে আবারও সমৃদ্ধির দেশে পরিণত করা।'

কাতারের আমির তামিম বিন হামাদ আল থানির আমন্ত্রণে কাতার ইকোনমিক ফোরাম-২০২৩ এ যোগ দিতে ৩ দিনের সরকারি সফরে সোমবার দোহায় পৌঁছান শেখ হাসিনা।

Comments

The Daily Star  | English

Road Surface Melting: Bargain bitumen failing to bear extreme heat

As the country is baking in heatwave, road surfaces in several districts have melted due to what experts say is the use of bitumen that cannot withstand this extreme heat.

12h ago