পদ্মার বুকে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিচে এলজিইডির পাকা রাস্তা
প্রমত্তা পদ্মার উত্তাল ঢেউ নিয়ন্ত্রণ করে শতবর্ষ আগে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার পাকশিতে নির্মাণ করে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ, এর মাধ্যমেই দেশের দক্ষিণবঙ্গের সঙ্গে উত্তরাঞ্চল ও ঢাকার মধ্যে রেল যোগাযোগ স্থাপিত হয়।
কালের বিবর্তনে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে পদ্মার সেই উত্তাল রূপ এখন আর নেই, নদীর বেশিরভাগ অংশ শুকিয়ে চর পড়ে গেছে, তবে শতবর্ষ পুরোনো সেই হার্ডিঞ্জ ব্রিজ দিয়ে এখনো চলাচল করছে ট্রেন।
এবার দেশের গুরুত্বপূর্ণ রেলসেতু হার্ডিঞ্জ ব্রিজের ঠিক নিচে মরা পদ্মার বুক চিরে জমে থাকা বালুচরের ওপর পাকা রাস্তা নির্মাণে প্রকল্প হাতে নিয়েছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ (এলজিইডি), যা নিয়ে ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে ব্যাপক সমালোচনা।
রেল কর্তৃপক্ষের বাধায় স্থানীয় প্রশাসন আপাতত রাস্তা নির্মাণ কাজ বন্ধ রাখলেও এখনো সরে আসেনি চলমান প্রকল্প থেকে। তাদের দাবি, নদীর জায়গা রেলের নয় সরকারের। প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যবস্থা নিতে কাগজপত্র যাচাই করে পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
নদীর বুকে সরকারি প্রকল্প করে রাস্তা নির্মাণ ও পাকা স্থাপনা নির্মাণের কঠোর সমালোচনা করেছেন স্থানীয় সুশীল সমাজ ও পরিবেশবাদীরা। এর মাধ্যমে সরকারি অর্থের অপচয় করে নদীর ক্ষতিসাধনের পাশাপাশি দেশের গুরুত্বপূর্ণ রেল স্থাপনা হুমকির মুখে পড়ার আশঙ্কা করছেন তারা।
সরেজমিনে শুক্রবার পাকশি হার্ডিঞ্জ ব্রিজ এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, পদ্মা নদীর হার্ডিঞ্জ ব্রিজের তলদেশ দিয়ে ব্রিজের ১ নম্বর পিলার থেকে ৩ নম্বর পিলার পর্যন্ত এলাকায় ইটের সোলিং বিছিয়ে রাস্তার লে আউট করা হয়েছে। প্রকল্পের কাজ করার জন্য নদীর বুকে জমা করা হয়েছে ইট ও বালুর স্তূপ।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ (এলজিইডি) সূত্রে জানা যায়, ঘাট উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় পদ্মা নদীর বামনগ্রাম ঘাট সংস্কার করা এবং ঘাটের উন্নয়নে ১৫ লাখ টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্পের কাজ শুরু করা হয়।
ঈশ্বরদী উপজেলা প্রকৌশলী এনামুল কবির দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'জেলা প্রশাসন থেকে ঘাট উন্নয়ন প্রকল্পের কিছু অর্থ বরাদ্দ হয়েছে। পরবর্তীতে উপজেলা সমন্বয় কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক পদ্মা নদীর ঈশ্বরদী উপজেলার সাড়া ইউনিয়নের সাড়া রানখরিয়া তারিয়া মহল ও পাকশি ইউনিয়নের বামনগ্রাম নৌকা পারাপারের ঘাট উন্নয়নের জন্য পৃথক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়।'
এরমধ্যে বামনগ্রাম নৌকা পারাপারের ঘাট সংস্কার, যাত্রী ছাউনি নির্মাণ ও ঘাটে চলাচলের জন্য একটি রাস্তা নির্মাণের জন্য টেন্ডার আহ্বান করা হয়।
লটারির মাধ্যমে উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মিলন হোসেন মো. তন্ময়ের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ১৫ লাখ টাকার এ প্রকল্পের কাজ পায়। ৩০ জুনের মধ্যে প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়নের বাধ্যবাধকতা থাকায় গত সপ্তাহে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রাস্তার লে আউট করে কাজ শুরুর উদ্যোগ নেয়।
প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের জন্য সরকারি সব নিয়মনীতি মেনেই কাজ শুরু করা হয়েছে, এ পর্যায়ে কেউ কোনো অভিযোগ না দিলেও কাজ শুরুর পর রেল বিভাগ প্রকল্পের কাজ নিয়ে আপত্তি জানানোয় আপাতত প্রকল্পের কাজ বন্ধ রয়েছে বলে জানান উপজেলা প্রকৌশলী।
তবে কাজ বন্ধ রাখলেও এখনই এ প্রকল্প থেকে সরে আসছে না সংশ্লিষ্ট দপ্তর। এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা ও কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে পরবর্তীতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান কর্মকর্তারা।
রেল বিভাগ জানায়, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ দেশের একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। এর নিচে নদীর মধ্যে ইট-বালু দিয়ে রাস্তা নির্মাণ করলে শতবর্ষ পুরোনো গুরুত্বপূর্ণ এ রেল সেতু ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। উপরন্তু রেল কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতীত রেলের জায়গায় এ ধরনের প্রকল্প নেওয়ার কোনো বৈধতা নেই।
রেলওয়ের পাকশি বিভাগীয় ম্যানেজার (ডিআরএম) শাহ সুফি নুর মোহাম্মদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পাকশি হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিচে রাস্তা নির্মাণ করা হচ্ছে এমন খবর পাওয়ার পর বৃহস্পতিবার ঘটনাস্থলে গিয়ে কাজ বন্ধ রাখতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানানো হয়।'
হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিরাপত্তার স্বার্থে ব্রিজের নিচে লোহার পাত দিয়ে সিল করে দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
রেল বিভাগের অনুমতি না নিয়ে কীভাবে রেলের জায়গায় এ ধরনের প্রকল্পের কাজ শুরু করা হয়েছে তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন শাহ সুফি নুর মোহাম্মদ।
এ বিষয়ে ঈশ্বরদী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুবির কুমার দাস ডেইলি স্টারকে বলেন, 'হার্ডিঞ্জ ব্রিজ একটি জাতীয় সম্পদ। ব্রিজটি রেল বিভাগের হলেও নদীর জায়গা সরকারের।'
প্রকল্পটি যখন গ্রহণ করা হয় তখন তিনি এখানে কর্মরত ছিলেন না বলে প্রকল্পের সব কিছু জানেন না বলেন তিনি।
ইউএনও জানান, রেল বিভাগের আপত্তির ফলে ইতোমধ্যে প্রকল্পের কাজ বন্ধ রাখতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং প্রকল্পের স্থানের জায়গা ও সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে নিয়মানুযায়ী পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
এদিকে, হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিচে নদীর বুকে এ ধরনের উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়ার কঠোর সমালোচনা করে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) পাবনা জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল হামিদ খান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সারাদেশে যখন নদী দখল ও দূষণের বিরুদ্ধে সচেতন হচ্ছে মানুষ, জোরদার হচ্ছে আন্দোলন, তখন সরকারি প্রকল্প নিয়ে নদী ধ্বংসের কাজ শুরু করেছে এলজিইডি।'
নদীর বুকে ইট-বালু দিয়ে রাস্তা নির্মাণ করে নদীর সৌন্দর্য ও নদীর প্রবাহ নষ্ট করার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট স্থাপনা কেন্দ্রিক নদী দখলের সুযোগ সৃষ্টি হবে, যা পদ্মা নদীর জন্য আবারও একটি হুমকির কারণ হবে বলে জানান তিনি।
প্রকৃতি ও পরিবেশের স্বার্থে নদী ধ্বংসকারী এ ধরনের প্রকল্পের কাজ থেকে সরে আসার আহ্বান জানান আব্দুল হামিদ খান।
এ বিষয়ে উপজেলা প্রকৌশলী এনামুল কবির ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পদ্মা নদীর রামগর ঘাট একটি পুরনো নৌকার ঘাট, এখনো মানুষ এ পথে নৌকা নিয়ে চলাচল করে। এ ছাড়া, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ এলাকায় নদীতে প্রতিদিন অসংখ্য দেশি-বিদেশি মানুষ বেড়াতে আসে সৌন্দর্য উপভোগ করতে, তাদের চলাচলের জন্য একটি পাকা রাস্তা অত্যন্ত জরুরি। আর এজন্যই উপজেলা সমন্বয় কমিটির সভায় এ প্রকল্পের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।'
এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে নদীর কোনো ক্ষতি হবে না বলেও দাবি করেন তিনি।
নদীপাড়ের বাসিন্দা পাকশির একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আমিরুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শুষ্ক মৌসুমে নদীতে তেমন পানি না থাকলেও বর্ষা মৌসুমে নদী পানিতে ভরে উঠবে, সেসময় এ রাস্তা পানিতে তলিয়ে নষ্ট হয়ে পুরো টাকাই জলে যাবে।'
পাবনা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি প্রবীণ শিক্ষাবিদ অধ্যাপক শিবজিত নাগ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নদীর বুকে এ ধরনের কোনো প্রকল্পের কথা শুনেই আশ্চর্য হতে হয়। সরকারি অর্থ ব্যয় করে কীভাবে এ ধরনের প্রকল্প নেওয়া হয়েছে তা ক্ষতিয়ে দেখতে হবে।'
আসন্ন জুন ফাইনালকে সামনে রেখে প্রকল্পের অর্থ ব্যয় করার জন্য অপ্রয়োজনীয় ও নদী ধ্বংসকারী প্রকল্প গ্রহণ না করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান তিনি।
প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা এলজিইডির প্রকৌশলী এনামুল কবির বলেন, 'উপজেলা সমন্বয় কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে, পরবর্তীতে উপজেলা সমন্বয় কমিটির সভায় সার্বিক বিষয় উপস্থাপন করা হবে। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'
Comments