ঈদ ব্যক্তিগত নয়, সামাজিক বিষয়

ঈদ ব্যক্তিগত নয়, সামাজিক বিষয়

বাংলায় কোনো ধর্মীয় উৎসব একক কোনো সম্প্রদায়ের থাকেনি। ধর্মীয় উৎসব ছিল পারস্পরিক সংযুক্তির স্মারক। মানুষ স্বমহিমায় নিজ নিজ ধর্মীয় উৎসব পালন করেছে অন্যদের দূরে না সরিয়ে। এ অভ্যাসের ভেতরে সহঅবস্থানের সংগতি ছিল। এ অঞ্চলের মানুষ নানাধর্ম গ্রহণ করেছে, কিন্তু বিভক্ত হয়নি। এর পেছনে কাজ করেছে অনার্য সংস্কৃতির আপন করার অদম্য শক্তি। 

ক্ষীতিমোহন সেন তার বৃহৎবঙ্গ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, অনার্যদের ছিল আপন করার বিশেষ গুণ। অনার্যরা গ্রহণ করেছে, প্রত্যাখ্যান নয়। অনার্যরা ছিলেন গ্রহণোমুক্ত। 

মানুষ একই সঙ্গে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক শিক্ষা গ্রহণ করে। ধর্ম শেখায় ধর্মীয় মূল্যবোধ আর সংস্কৃতি শিক্ষায় শেকড় ও ঐতিহ্যের মর্মবাণী। ধর্মীয় ও সংস্কৃতির মিশেলে নির্মিত হয় জনপরিচয়। এ বাংলায় কোনো ধর্ম অবিকৃত থাকেনি, মিশেছে তার সাংস্কৃতিক উপাদানের সঙ্গে। এতে করে ধর্মের অভিযোজন বেড়েছে। মানুষের কাছে অধিকতর গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। সাংস্কৃতিক সংকরায়নে গড়ে উঠেছে পলল বাংলা মন। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ভারত তীর্থ কবিতায় লিখেছেন-

. . . হেথায় আর্য, হেথা অনার্য, হেথায় দ্রাবিড় চীন
শক-হুন-দল পাঠান-মোঘল একদেহে হল লীন. . .

অসমী রায় তার প্রখ্যাত গ্রন্থ 'দ্য ইসলামিক সিনক্রিটিক ট্র্যাডিশন ইন বেঙ্গল'-এ উল্লেখ করেছেন-মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামের রূপ বাংলায় এসে অবিকৃত থাকেনি, উনিশ শতকের সংস্কারকেরা দাবি করেছেন, বাংলায় ঐতিহাসিকভাবে ধর্মের যে বিকাশ ঘটেছে তা মধ্যপ্রাচ্যের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। অর্থাৎ ধর্মীয় চর্চার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সাংস্কৃতিক উপাদান। বাঙালি সংস্কৃতির মৌলচরিত্র সংকর ও সংযুক্তিমূলত। এটি মূলভিত্তি। ধর্মীয় পরিচয় ঘিরে 'আলাদাকরণ' প্রবণতা বাঙালি সংস্কৃতির সারবত্তার ভেতর নেই।

কিন্তু বাস্তবতা হলো সমাজ আজ সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই। ইতিহাসের দীর্ঘপরিক্রমায় নানা অসঙ্গতি ও বিভক্তি যুক্ত হয়েছে। ধর্মে ধর্মে বিভক্তি বেড়েছে, বেড়েছে অনৈক্য। কেবল ধর্মে ধর্মে নয় বরং ধর্মের ভেতরেও বেড়েছে বিভক্তি। ধর্ম সংযুক্তির স্মারক না হয়ে বিযুক্তির উপলক্ষ্য হয়ে উঠছে। ধর্মের ধারণ করার শক্তিকে ক্ষীণ করা হচ্ছে। ধর্মের বাহ্যিক বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা হচ্ছে প্রদর্শনবাদ হয়ে উঠেছে এক প্রাধান্যশীল ধারা।

ম্যাক্স স্টিলের 'ইসলামিক সারমনস অ্যান্ড পাবলিক পায়েটি ইন বাংলাদেশ: দ্য পোয়েটিক প্রিচিং' গ্রন্থের মূল বিষয় বাংলাদেশের ওয়াজ। যেখানে তিনি দেখিয়েছেন ইসলামিক প্রিচারগণ কীভাব ওয়াজকে সুর ও ছন্দ মিলিয়ে এক পারফরর্মিং আর্টে পরিণত করলেন। গান, আবৃত্তি, সূর, ছন্দ, কণ্ঠের উঠা-নামা, বাচনিক যোগাযোগ, শরীরভাষা, ওয়াজের স্থানের ডেকোরেশন ও প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে ওয়াজ ভিন্নমাত্রা অর্জন করেছে। তিনি এখানে ওয়াজের শ্রবণ নান্দনিকতা নিয়ে আলোচনা করেন। কীভাবে ওয়াজের পারফরমেন্সভিত্তিক উপস্থাপন শ্রবণগহ্বরে সুরের মূর্ছনা তৈরি ও শ্রোতা-দর্শকদের সংযুক্ত করে তা তুলে ধরেন। ধর্মের মর্মবাণী অনুশীলনের চেয়ে তথ্য বিচ্ছুরণের আনুষ্ঠানিকতা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। 

ধর্মীয় বিষয়ে উদার ব্যাখ্যার চেয়ে সংকোচনবাদী ব্যাখ্যা গুরুত্ব পাচ্ছে। শ্রেষ্ঠত্বের বাসনা, কে কার চেয়ে শ্রেষ্ঠ, কে কার চেয়ে বড় তা অগ্রগণ্য বিষয় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ধর্মের রিচ্যুয়াল বা আচারমূলক দৃষ্টিভঙ্গির চেয়ে ট্রান্সমিশন বা সঞ্চালনমূলক দৃষ্টিভঙ্গি শক্তিশালী হয়ে উঠেছে।

যোগাযোগ তাত্ত্বিক জেমস ডব্লিউ ক্যারে তার 'কমিউনিকেশন এজ কালচার' গ্রন্থে এ ধারণা তুলে ধরেন। তিনি উল্লেখ করেছেন, যোগাযোগের সঞ্চালনমূলক দৃষ্টিভঙ্গিতে স্থান ও মানুষের মধ্যে দূরত্ব ঘুঁচিয়ে আনতে তথ্য আদান-প্রদান করা হয়। আর যোগাযোগের আচারমূলক দৃষ্টিভঙ্গিতে সমাজকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে পরিব্যাপন করা হয় তথ্য। ধর্মচর্চা ক্ষেত্রে তথ্য আত্তীকরণের চেয়ে ছড়িয়ে দেওয়ার ওপর অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। প্রযুক্তির কারণে তা আরও গতিশীল হচ্ছে। এ তথ্য বিচ্ছুরণের পেছনে কাজ করছে বিশেষ রাজনৈতিক অর্থনীতি।

প্রযুক্তি-সংযোগ, প্রকাশোন্মুক্ততা, শ্রেষ্ঠত্বের অনুভব এবং রাজনীতির মিশেলে ধর্মীয় মনের জটিল রসায়ন গড়ে উঠছে। এ জটিলতা আরও প্রকাশিত হচ্ছে ধর্মীয় উৎসব ঘিরে। কারণ, উৎসব বা আনন্দ উপভোগের জন্য সমতা বা সামর্থ্য গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। ধর্মীয় উৎসব বা আয়োজনে সমাজের বিদ্যমান অসমতা ও অনার্য ধরা পড়ে সহজে। উৎসবের আয়নার সমাজের বিদ্যমান ক্ষয় ও ক্ষরণ দেখা যায়।

পুঁজিবাদী সমাজ মানে পুঁজির কেন্দ্রিকরণ, ভোগবাদিতা, সুখ ও বিলাস। তবে তা সবার জন্য প্রযোজ্য নয়, যাদের সামর্থ্য রয়েছে কেবল তাদের জন্য। জোসেফ স্টিলিজ তার 'গ্রেট ডিভাইড' গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন- সবার জন্য সমান সুযোগের কথা বলা হয় কিন্তু সমান সুযোগ কেবল তাদের জন্য যারা তা অ্যাফোর্ড করতে পারে। একটি অন্যায্য সমাজে পিছিয়ে পড়া মানুষের পক্ষে সমতার স্বাদ ভোগ করা সম্ভব নয়। উৎসব প্রসঙ্গে ফিরে আসি, ঈদুল আজহা মুসলমানদের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব। ঈদুল আজহার মর্মবাণী হলো ত্যাগ স্বীকার। ত্যাগ স্বীকারের মানসিকতা মানুষকে পরিশীলিত করে। এ ত্যাগ স্রষ্টার প্রতি, সৃষ্টির প্রতি, প্রাণ-প্রকৃতির প্রতি।

মানুষ ত্যাগের চেয়ে ভোগে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। ঈদুল আজহাকে ঘিরে মজুদের মানসিকতা প্রবল হচ্ছে। ফ্রিজ বিক্রি বেড়ে যাচ্ছে। প্রথম আলোয় প্রকাশিত সংবাদে দেখা গেছে, কোরবানির ঈদে ৩০ শতাংশ ফ্রিজ বিক্রি হয়। কেবল তা নয় ওজনে গরু বিক্রি হচ্ছে। গরু সাজানো হচ্ছে আকর্ষণীয় স্টাইলে। এমনকি গরুর নামকরণ করা হচ্ছে বিশেষ কায়দায়। নামকরণে মধ্যে পবিত্রতা, ধর্মীয় অনুভব, হাস্যরস বা বিশালত্ব তুলে ধরা হচ্ছে। এর পেছনে কাজ করছে মূলত ক্রেতা আকর্ষণ, বিক্রি ও বাড়তি অর্থ আয়। ঈদুল আজহাকে ঘিরে গরু হয়ে উঠছে বিশেষ নিউজ আইটেম। 

ঈদুল আজহায় দুস্থ ও অসহায়দের হাতে দুটুকরো মাংস তুলে দেওয়ার অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা না করে মাংস মজুদ করতে তৎপর হয়ে উঠে। এ মজুতকরণের মধ্যে দিয়ে জনমনস্তত্ত্বের এক ভঙ্গুর দিক পরিস্ফুটিত হয়। আনন্দ বা উদযাপনে সবাই সংযুক্ত হলে না পারলে তা উপভোগ করা যায় না। মনে রাখতে হবে, ঈদ ব্যক্তিগত বিষয় নয়, ঈদ সামাজিক বিষয়। এখন ঈদের সামাজিক উদযাপনে ব্যক্তি পর্যায়ে চলে গেছে। ঈদের সামাজিক রূপ ফিরিয়ে আনতে হবে। ত্যাগের মহিমা প্রজ্বলিত করতে হবে। বাঙালির সংস্কৃতির সংযুক্তির ঘণ্টা বাঁজাতে হবে নতুন উদ্যমে। ঈদের আনন্দ হোক সবার।

Comments

The Daily Star  | English

Yunus meets Chinese ambassador to review China visit, outline next steps

Both sides expressed a shared commitment to transforming discussions into actionable projects across a range of sectors

5h ago