মহানায়ক যখন ‘খলনায়কের’ ভূমিকায়

মহানায়ক যখন ‘খলনায়কের’ ভূমিকায়
ছবি: সংগৃহীত

বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে মহানায়ক বলতে আমরা বুঝি উত্তম কুমারকেই। তবে নায়ক বা প্রোটাগনিস্ট চরিত্রের বাইরেও বৈচিত্র‍্যময় নানা চরিত্রে অভিনয় করেছেন উত্তম। বাদ যায়নি খলচরিত্রও।

শুরুটা ষাটের দশকের প্রথম ভাগে। হরিদাস ভট্টাচার্যের 'শেষ অঙ্ক' (১৯৬৩) সিনেমায়। হলিউড সিনেমা থেকে অণুপ্রাণিত এই সিনেমায় শুরু থেকেই উত্তম কুমারের চরিত্রের প্রতি সহানুভূতি তৈরি হতে থাকে দর্শকের। প্রথম স্ত্রীকে হারানো শুধাংশু গুপ্ত (উত্তম) তখন দ্বিতীয় বিয়ে করতে যাচ্ছেন। বিয়ের আসর থেকে শুরু হয় নানা ঝামেলা। 

কিন্তু আগাগোড়াই যাকে দর্শক নায়ক মনে করে এলেন, ছবির ক্লাইমেক্সে প্রকাশ হয়ে পড়ে তারই ভিন্ন রূপ। ছবিটি আজ থেকে ৬০ বছর আগের। সে সময়ের হিসেবে এমন গ্রে ক্যারেক্টার দর্শকের কাছে ছিলো অপ্রত্যাশিত। সেই চমক সিনেমাটিকে অনন্য এক থ্রিলারে পরিণত করে। উত্তমের নায়ক পরিচয়ের বাইরে নতুন পরিচয় তৈরি হয়। 

প্রায় একদশক পরের কথা। ১৯৭২ সালে সলিল দত্তের 'স্ত্রী' সিনেমায় আবারও খলচরিত্রে উত্তম। বলা ভালো তার চরিত্রটি অ্যান্টি হিরোর। নাম মাধব দত্ত। 'কাহারবা নয়, দাদরা বাজাও' এর মতো গানে তার অভিব্যক্তি দর্শকের চোখে লেগে আছে আজও। চরিত্রে লাম্পট্য থাকলেও স্ত্রীর পরকীয়া সম্পর্কে জানতে পেরে উন্মাদপ্রায় হয়ে ওঠেন মাধব। টিয়াপাখিকে গলা টিপে মেরে ফেলা, স্ত্রীর মৃত প্রেমিককে গুলি করে মারার চেষ্টা করা আর শেষে উন্মাদ হয়ে আত্মসংহার- উত্তম অবিশ্বাস্য দক্ষতা দেখান চরিত্রচিত্রণে। 
   
তবে সবকিছুকে ছাড়িয়ে যায় মধ্য সত্তরের 'বাঘবন্দি খেলা' (১৯৭৫) চলচ্চিত্রে। পীযূষ বসু পরিচালিত এই সিনেমায় ভবেশ বাঁড়ুজ্জে (উত্তম) একজন লম্পট, দুর্নীতিপ্রবণ ব্যক্তি। নির্বাচনে দাঁড়াবার অভিপ্রায় নিয়ে ছেলের নামে সব সম্পদ লিখে দিয়ে নিজেকে কলঙ্কমুক্ত রাখতে চায় সে। সিনেমায় ফ্ল্যাশব্যাকে আসে ভবেশের অতীত। ১২ টুকরো মাংস নিয়ে এসে শুধুমাত্র নিজে খেতে চাওয়া, স্ত্রী ২ সন্তানকে ৪ টুকরো দেওয়ায় হুলস্থূল করা; 'আয় আয় আসমানি কবুতর' গানে গুণি অভিনেত্রী সুলতা চৌধুরীর সঙ্গে লম্পট-মদ্যপ ভবেশ তথা উত্তমের জীবন্ত এক্সপ্রেশন! ছবির ক্লাইম্যাক্সে আরেকবার উত্তম দেখান চমক। এই সিনেমায় অ্যান্টিহিরো নন,  বরং পুরোদস্তুর ভিলেন হিসেবেই আত্মপ্রকাশ ঘটে উত্তমের। সব মিলিয়ে মাস্টারপিসে পরিণত হয় 'বাঘবন্দী খেলা।' 

পরের বছর আবারও পীযূষ বসুর সিনেমাতেই খলচরিত্রে এলেন উত্তম। জন্ম পরিচয়হীন বিলাস (উত্তম) লব্ধপ্রতিষ্ঠিত হলেও ভালোবাসার মানুষকে সে পায় না। ঘটনাচক্রে পা বাড়ায় অন্ধকারে, হয়ে ওঠে দীনদয়াল সেন- দিনের আলোয় যিনি এক মহান সমাজসেবক, সেই তিনিই রাতের আঁধারে স্মাগলারদের শিরোমণি। সর্প হয়ে দংশন করে ওঝা হয়ে ঝাড়ার খুব ভালো উদাহরণ এই চরিত্রটি। একদিকে পুলিশ অফিসারকে তদন্তে সাহায্য করা, অপরদিকে তার জন্যই ফাঁদ পাতা- অ্যান্টিহিরোর চরিত্রে উত্তম অনবদ্য অভিনয় করেন এই চলচ্চিত্রে। 

উত্তম সবশেষ খলচরিত্র করেন তার নিজের পরিচালিত চলচ্চিত্রে। 'কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী' (১৯৮১) সিনেমাটি তিনি ও পীযূষ বসু যৌথভাবে পরিচালনা করেন। ছবি মুক্তির আগে দুজনই পরলোকগত হন। 

এই সিনেমায় উত্তম একজন রাজার চরিত্রে অভিনয় করেন, যার নাম রাজশেখর রায়। এক বাইজির প্রতি লালায়িত হন রাজা। একপর্যায়ে বাইজির প্রেমিককে হত্যা করেন। বেপরোয়া রাজার চরিত্রে দারুণ সাবলীল ছিলেন উত্তম। এক পাপ থেকে যে আরও অনেক পাপ তৈরি হয়- সে সত্যই ফুটে ওঠে এই চরিত্রটির কর্মকাণ্ডে, যার শেষ হয় আত্মসমর্পণে। 

উত্তম কুমারের রূপায়িত খলচরিত্রগুলোয় সিগমন্ড ফ্রয়েডের 'ইড' (Id)-এর প্রাবল্য লক্ষ করা যায়। সব চরিত্রই বেপরোয়া। নিজস্ব কামনা চরিতার্থ করাই তাদের উদ্দেশ্য। সেখানে চলে না নৈতিকতার কোনো হিসেব। বহ্নিশিখা ছাড়া অন্য কোনোটিতে চরিত্রের খল হয়ে ওঠার পেছনে কোনো প্রতিঘাত নেই। বিশেষত বাঘবন্দি খেলার চরিত্রটি ভিলেন হিসেবে প্রবাদপ্রতিম৷ সহানুভূতির লেশমাত্র নেই সেখানে। 

৬০ দশক থেকেই উত্তম বৈচিত্র‍্যময় নানা চরিত্রে কাজ করছিলেন। খল অভিনয়ে খুব অল্প কাজ করলেও সেই কাজগুলো বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকার মতো। মহানায়ক যে শুধু নায়ক হিসেবে নন, বরং অভিনেতা হিসেবেও দুর্দান্ত; উত্তমের খলচরিত্রের অভিনয়গুলো তারই প্রমাণ। মহানায়ক তাই খলনায়ক হিসেবেও মহামহিম। 
 

Comments

The Daily Star  | English

Pilots faked flying records

CAAB inquiry finds, regulator yet to take action

10h ago