পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধযোগ্য, প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ

দেশে প্রতিদিন ৫০ জন মানুষ পানিতে ডুবে মারা যাচ্ছে, যার মধ্যে ৪০ জনই শিশু। প্রতি বছর প্রায় ১৯ হাজার মানুষ পানিতে ডুবে মারা যাচ্ছে। এভাবে মারা যাওয়াকে স্বাভাবিক হিসেবে ধরে নেওয়ার কোনো কারণ নেই। ডুবে মারা যাওয়া প্রতিটি ঘটনাই প্রতিরোধযোগ্য। এজন্য প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ।

দেশে প্রতিদিন ৫০ জন মানুষ পানিতে ডুবে মারা যাচ্ছে, যার মধ্যে ৪০ জনই শিশু। প্রতি বছর প্রায় ১৯ হাজার মানুষ পানিতে ডুবে মারা যাচ্ছে। এভাবে মারা যাওয়াকে স্বাভাবিক হিসেবে ধরে নেওয়ার কোনো কারণ নেই। ডুবে মারা যাওয়া প্রতিটি ঘটনাই প্রতিরোধযোগ্য। এজন্য প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ।

'পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধে জাতীয় নীতিমালা কার্যকরের আহ্বান' শীর্ষক এক সেমিনারে এমন মন্তব্যই করেছেন সরকারি, বেসরকারি ও বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার প্রতিনিধিরা।

আজ সোমবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে বিশ্ব ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে সেমিনারটির আয়োজন করে সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি)।

সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব ড. মো. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার। বিশেষ অতিথি ছিলেন ইউনিসেফ বাংলাদেশের চাইল্ড প্রোটেকশন বিভাগের প্রধান নাটালি ম্যাককুয়ালি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বাংলাদেশ কার্যালয়ের নন কমিউনিকেবল অ্যান্ড মেন্টাল হেলথের প্রধান ড. সাধনা ভাগওয়াত, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক ও সংক্রামক রোগ বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন, জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন, বাংলাদেশ শিশু একাডেমির মহাপরিচালক আনজীর লিটন।

সেমিনারে স্বাগত বক্তব্যে সিআইপিআরবি নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. একেএম ফজলুর রহমান বলেন, পানিতে ডুবে মৃত্যু একটি নীরব মহামারি। ২০২১ সালে বিশ্বব্যাপী পানিতে ডুবে মৃত্যুকে প্রতিরোধযোগ্য হিসেবে তুলে ধরতে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ২৫ জুলাইকে বিশ্ব পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধ দিবস হিসেবে ঘোষণা করে।

সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিআইপিআরবির ইন্টারন্যাশনাল ড্রাউনিং প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ ডিভিশনের পরিচালক ড. আমিনুর রহমান। প্রবন্ধে পানিতে ডুবে মৃত্যু সংশ্লিষ্ট বিষয়ে এবং পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু রোধে সিআইপিআরবির নানা কর্মসূচি সম্পর্কে জানান।

সেমিনারে ইউনিসেফ বাংলাদেশের চাইল্ড প্রোটেকশন বিভাগের প্রধান নাটালি ম্যাককুয়ালির পক্ষে ইউনিসেফের প্রতিনিধি বলেন, 'ইউনিসেফের চাইল্ড প্রোটেকশন বিভাগের অধীনে যে সকল প্রকল্প রয়েছে তার মধ্যে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু প্রধানতম বিষয়গুলোর একটি। ২০০৬ সাল থেকে সিআইপিআরবির সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করে যাচ্ছে ইউনিসেফ। এ সময়ে ৫ লাখের বেশি শিশুকে আমরা সাঁতার শিখিয়েছি। এদের মধ্যে ৬০ শতাংশই কন্যা শিশু। এই প্রকল্পটি এখনো চলছে। আমরা গত বছর থেকে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কাজ শুরু করেছি। আমরা চলতি বছর বিশ্ব পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধ দিবসকে উদ্দেশ্য করে প্রথমবারের মতো এক সপ্তাহব্যাপী সচেতনতা সপ্তাহ পালন করব।'

গণমাধ্যম উন্নয়ন সংগঠন 'সমষ্টি'র গবেষণা পরিচালক রেজাউল হক বলেন, 'গত তিন বছর ধরেই আমরা গণমাধ্যমের সঙ্গে কাজ করেছি। আমরা যখন কাজ শুরু করেছিলাম তখন গণমাধ্যমে পানিতে ডুবে মৃত্যুর বিষয়টি তেমন উঠে আসত না। সবাই প্রায় স্বাভাবিকভাবেই পানিতে ডুবে মৃত্যুকে মেনে নিয়েছিল। এখন কিন্তু পরিস্থিতি অনেকখানিই বদলেছে। গণমাধ্যমে এই বিষয়টি প্রতিনিয়তই উঠে আসছে। পানিতে ডুবে ঠিক কত সংখ্যক শিশু মারা যাচ্ছে সে সংখ্যাটি আমরা পুরোপুরি বের করতে পারছি না। কারণ গণমাধ্যমে পানিতে ডুবে মৃত্যুর পুরোপুরি চিত্র উঠে আসছে না।'

গণসাক্ষরতা অভিযানের প্রোগ্রাম ম্যানেজার ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, 'সড়ক দুর্ঘটনায় কোনো মানুষ মারা গেলে থানায় ন্যূনতম একটি সাধারণ ডায়েরি করা হয়, অথচ গ্রামে পানিতে ডুবে কেউ মারা গেলে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। এখানে আমাদের বড় ধরনের সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। এই দায়িত্বটি কার? এটি কি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নাকি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় নাকি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। না এটি কোনো নির্দিষ্ট মন্ত্রণালয়ের একার দায়িত্ব নয়, বরং সম্মিলিতভাবে সবার দায়িত্ব। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে ৪ লাখের মতো শিক্ষক আছে। তাদের সংযুক্ত করতে পারলে আমরা বড় ধরনের সচেতনতা কর্মসূচি চালাতে পারি। দেশব্যাপী অসংখ্য স্বাস্থ্যকর্মী কাজ করছেন, ইউনিয়ন পর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীদের মাধ্যমেও আমরা প্রতিটি পরিবারে বার্তা পৌঁছাতে পারি। এজন্য সমন্বিত উদ্যোগের বিকল্পও নেই।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বাংলাদেশ কার্যালয়ের নন কমিউনিকেবল অ্যান্ড মেন্টাল হেলথের প্রধান ড. সাধনা ভাগওয়াত বলেন, 'পানিতে ডুবে মৃত্যুর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যথেষ্ট উন্নতি করেছে। যদিও এখানে কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। শুধু সাঁতারের মাধ্যমে পানিতে ডুবে মৃত্যু রোধ করা সম্ভব নয়। কারণ পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ পানিতে ডোবা। এক্ষেত্রে সিআইপিআরবি যে ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে তা মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়ন করাটাই বড় চ্যালেঞ্জ। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ পানিতে ডুবে মৃত্যু রোধে অনুকরণীয় হয়েছে। যদি সিআইপিআরবির গবেষণা এবং তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে পাওয়া কর্মপরিকল্পনা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা যায় তবে নিঃসন্দেহে তা যুগান্তকারী হবে।'

ইউনিসেফের আর্লি চাইল্ডহুড ডেভেলপমেন্ট বিভাগের সাবেক স্পেশালিস্ট ড. মোহাম্মদ মোস্তফা বলেন, '২০০৬ সাল থেকেই আমাদের সিআইপিআরবির সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়েছে। আমাদের আসলে লাইফ সার্কেলের মধ্য দিয়েই কাজ করতে হবে। পরিবারের এখানে ভীষণ প্রয়োজন। স্বাস্থ্যকর্মীদের কীভাবে আমরা কাজে লাগাতে পারি সেটি প্রথমেই দেখতে হবে। কীভাবে শিশুদেরকে পানি থেকে রক্ষা করতে হবে সেই উদ্যোগ তো থাকবেই।

বাংলাদেশ শিশু একাডেমির মহাপরিচালক আনজীর লিটন বলেন, 'পানিতে ডোবার পরে প্রাথমিক চিকিৎসায় এক ধরনের ভুল ব্যাখ্যা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছিল। তবে এখন পরিস্থিতি পাল্টেছে। সিআইপিআরবির সঙ্গে শিশু একাডেমি ১৬টি জেলায় সাঁতার শেখানো এবং শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশ কেন্দ্র স্থাপন করছি। যেখানে নানা ধরণের কর্মপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে এ বিষয়ে গণমাধ্যমেরও নিজস্ব একটি ভাষা ভীষণ প্রয়োজন। যেন তা গুরুত্বের সঙ্গে তুলে আনা হয়। কেবল পাঠ্যপুস্তকে সচেতনতার মাধ্যমে কখনোই পানিতে ডুবে মৃত্যু বন্ধ করা সম্ভব নয়।

জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, 'পানিতে ডোবার বিষয়ে সাংবাদিকদের যেমন দায়িত্ব রয়েছে ঠিক তেমনি বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর প্রকল্পেও সাংবাদিকদের ওয়াকিবহাল করা উচিত। এনজিওগুলোর অধিকতর গণমাধ্যম ঘনিষ্ঠতা প্রয়োজন। যেন সাংবাদিকরাও জানতে পারে কিছু একটা হচ্ছে এবং সে অনুযায়ী সাংবাদিকরা সাধারণ মানুষের সামনে তথ্য উপস্থাপন করতে পারে।'

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক ও সংক্রামক রোগ বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বলেন, 'পানিতে ডুবে মৃত্যুটি একদম অবহেলিত একটি গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা। আমাদের সৌভাগ্য যে বিশ্ব পানিতে ডোবা প্রতিরোধ দিবসের প্রস্তাবটি সিআইপিআরবির মাধ্যমে উঠে এসেছিল, যা এখন বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে। কিন্তু আমরা পানিতে ডুবে মৃত্যু বিষয়টি পুরোপুরি কীভাবে বাস্তবায়ন করবো তা প্রশ্নের দাবি রাখে। আমরা ডায়রিয়া কলেরা, নিউমোনিয়া পরিস্থিতিতে যথেষ্ট উন্নতি করেছি। কিন্তু আমরা পানিতে ডোবা বিষয়টি পুরোপুরি সমাধানে পৌঁছাতে পারিনি, যার ফলে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু তেমন কমছে না। এজন্য আমাদের ভিন্ন ভিন্ন সেক্টরে পরিপূর্ণ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। এটি বলা যতোটা সহজ করা কিন্তু ততটা সহজ নয়। এজন্য দরকার ভিন্ন ভিন্ন পরিকল্পনা এবং সর্বশেষে একটির সঙ্গে অপরটির সমন্বয়।

সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব ড. মো. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার বলেন, 'আমরা সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুকে যতোটা গুরুত্ব দিচ্ছি, পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুকে সে তুলনায় কোন গুরুত্বই দিই না। যদিও ধীরে ধীরে আমাদের অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। আমাদের এমন একটি বাস্তবমুখী মহাপরিকল্পনা নেয়া দরকার যেন আমরা পানিতে ডুবে প্রতিটি মৃত্যুই রোধ করতে পারি।'

সেমিনারে আরও বক্তব্য রাখেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের ডিপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার নুসাইদ চৌধুরী, সিসিমপুরের সিনিয়র ম্যানেজার মো. খলিলুর রহমান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ এন্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. ফারিহা হাসিন, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. ফজলে এলাহী প্রমুখ।

সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রাক্তন মহাপরিচালক অধ্যাপক মো. আবুল ফয়েজ।

Comments

The Daily Star  | English
quota reform movement,

Govt publishes preliminary list of those killed in July-August protests

The interim government today published a preliminary list of 726 people who died during the student-led mass protests in July and August.

1h ago