শুভ্র মেঘের দলে, কাশবনে এসেছে আশ্বিন

মেঘের সঙ্গে কাশফুলের মিতালী। ছবি: আহমাদ ইশতিয়াক

'হিমের শিহর লেগেছে আজ মৃদু হাওয়ায়

আশ্বিনের এই প্রথম দিনে।

ভোরবেলাকার চাঁদের আলো

মিলিয়ে আসে শ্বেতকরবীর রঙে।

শিউলিফুলের নিশ্বাস বয়

ভিজে ঘাসের 'পরে,

তপস্বিনী উষার পরা পুজোর চেলির

গন্ধ যেন

আশ্বিনের এই প্রথম দিনে।'

আশ্বিনের প্রথম দিনটি নিয়ে 'পয়লা আশ্বিন' কবিতায় এমনটিই লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ। প্রকৃতই প্রকৃতিতে শরতের পরিপূর্ণ রূপ যেন ফুটে উঠে আশ্বিনেই।

আজ পহেলা আশ্বিন। ষড়ঋতুর বাংলা পঞ্জিকার ষষ্ঠতম মাস আশ্বিন। অশ্বিনী নক্ষত্রের নামানুসারেই আশ্বিন মাসের নামকরণ।

ভাদ্রের কাঠফাটা রোদ আর উষ্ণতম প্রকৃতিতে যখন জীবনপ্রাণ ওষ্ঠাগত, ঠিক তখনই যেন আশ্বিন নিয়ে আসে এক টুকরো স্বস্তির নিঃশ্বাস। আশ্বিনের মধ্য দিয়েই যেন প্রকৃতি জানান দেয় শীতের আগমনী রূপ। দিগন্ত বিস্তৃত প্রান্তরে শুভ্র কাশফুলের সঙ্গে পেঁজা তুলার মতো ভাসমান সাদা মেঘের ভেলার মিতালি চোখে পড়ে আশ্বিনেই।

ছবি: আহমাদ ইশতিয়াক

ভোরের সূর্যকিরণের আগেই শিউলির বান নামে শিউলি তলায়। ঝরে পড়া শিউলিতে কেউ যেন শুভ্র গালিচা বিছিয়ে দেয় উঠোনে। ভোরের ঝিঝিঝিরি হাওয়ায় দুলে উঠে মনপ্রাণ। মধ্য দুপুরে মৃদু হাওয়ায় দোলে বিলের শাপলার দলও। ভ্রমরের মিতালিও জমে উঠে সেথায়। আশ্বিনের শেষ দিকে রাত্রি শেষের ঘাসে জমতে থাকে শিশির।

প্রকৃতিতে দেখা মেলে শারদীয় দুর্গোৎসবের আগমনী বার্তা। আশ্বিন যেন মনের মাধুরী মিশিয়ে প্রকৃতিকে করে তোলে পরিপূর্ণ। প্রকৃতিতে শরৎ স্নিগ্ধ হলেও শরতের ভাদ্র অনেকখানি রুক্ষ, অন্যদিকে বিপরীত অবস্থান আশ্বিনের। আশ্বিন কোমল, আশ্বিন উৎসবমুখর।

কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর 'আশ্বিন দিবসে' কবিতা জানান দেয় তাই।

'আশ্বিন বলতেই চোখে ভেসে ওঠে রোদ্দুরের ছবি,

চক্রাকারে চিল

মাথার উপর দিয়ে ডানা মেলে

উড়ে যায়

মেঘের জানলার দিকে। আশ্বিন বলতেই

আলোর-তরঙ্গে-ধোয়া দৃশ্যাবলি চোখের সমুখে

দেখতে পাই।

দেখি নদী, দেখি নৌকা, গেরুয়া বাদাম

স্রোতের দুরন্ত টানে ঘুরে যায়।'

আশ্বিনের সৌন্দর্যের আলোকছটা কালে কালে মুগ্ধ করেছে বাংলার কবিদের। মধ্যযুগের মহাকবি চণ্ডীদাস থেকে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম; পল্লীকবি জসীমউদদীন থেকে প্রমথনাথ বিশী কে নেই সেই তালিকায়। সৃষ্টিসুখের উল্লাসে আশ্বিনের জয়জয়কারে মেতেছেন কবি সাহিত্যিকরা। অন্যদিকে মাইকেল মধুসূদন দত্তের প্রিয় মাসই যে ছিল আশ্বিন। তাইতো 'আশ্বিন মাস' কবিতায় মাইকেল মধুসূদন  লিখেছেন,

'এক পদ্মে শতদল৷ শত রূপবতী—

নক্ষত্রমণ্ডলী যেন একত্রে গগনে!—

কি আনন্দ! পূৰ্ব্ব কথা কেন কয়ে, স্মৃতি,

আনিছ হে বারি-ধারা আজি এ নয়নে?—

ফলিবে কি মনে পুনঃ সে পূর্ব্ব ভকতি?'

চণ্ডীদাস তার কবিতায় আশ্বিনের প্রকৃতির অপূর্ব বর্ণনা দিয়ে লিখেছেন,                                                                         

'আশিন মাসের শেষে নিবড়ে বরিষী।

মেঘ বহির্জা গেলে ফুটিবেক কাশী॥

তর্ক্সে কাহ্ন বিণী হৈব নিফল জীবন।

গাইল বড় চণ্ডীদাস বাসলী গণ ॥'

নজরুলের কবিতায় বারেবারে এসেছে বিরহের পালা। আশ্বিনও পায়নি তাতে মুক্তি। নজরুলের চোখে আশ্বিন যেন নিয়ে আসে বিরহের বার্তা। শুভ্র শেফালির বুকে আশ্বিনের প্রভাতকে বিরহের চিত্রাঙ্কন করে নজরুল তার কবিতায় লিখেছেন,

'বেদনা-হলুদ-বৃন্ত কামনা আমার

শেফালির মত শুভ্র সুরভি-বিথার

বিকশি' উঠিতে চাহে, তুমি হে নির্মম,

দলবৃন্ত ভাঙ শাখা কাঠুরিয়া সম!

আশ্বিনের প্রভাতের মত ছলছল

ক'রে ওঠে সারা হিয়া, শিশির সজল

টলটল ধরণীর মত করুণায়!'

নজরুল আবার আগমনী কবিতায় প্রেমময় বর্ণনায় লিখেছেন, 

'আজ আকাশ ডোবানো নেহারি তাঁহারি চাওয়া

 ঐ শেফালিকা-তলে কে বালিকা চলে?

কেশের গন্ধ আনিছে আশিন-হাওয়া!'    

ছবি: আহমাদ ইশতিয়াক

তবে পল্লীকবি জসীমউদদীনের মতো করে বাংলা কবিতায় প্রকৃতির সার্থক রূপ তুলে এনেছেন এমন কবির সংখ্যা নেই বললেই চলে। জসীমউদদীন তার কালজয়ী অনবদ্য আখ্যানকাব্য নকশীকাঁথার মাঠে তুলে এনেছিলেন রূপাই ও সাজু নামক দুই গ্রামীণ দুই যুবক-যুবতীর অবিনশ্বর প্রেমের করুণ কাহিনী। নকশীকাঁথার মাঠে কবি আশ্বিনের ঝড়ের অপূর্ব বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন,

'আশ্বিনেতে ঝড় হাঁকিল, বাও ডাকিল জোরে,

গ্রামভরা-ভর ছুটল ঝপট লট্ পটা সব করে।

রূপার বাড়ির রুশাই-ঘরের ছুটল চালের ছানি,

গোয়াল ঘরের খাম থুয়ে তার চাল যে নিল টানি।'

আশ্বিন উৎসবের ঋতু। সনাতন ধর্মাবলম্বী বাঙালিদের কাছে আশ্বিন মাস পরম পূজনীয়। আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষের ষষ্ঠ থেকে দশম দিনে সনাতন ধর্মাবলম্বী বাঙালিরা শারদীয়া দুর্গাপূজা পালন করে থাকে।  আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষটিকে বলা হয় 'দেবীপক্ষ'। দেবীপক্ষের সূচনার অমাবস্যাটির নাম মহালয়া; এই দিন বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীরা তর্পণ করে তাদের পূর্বপুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। দেবীপক্ষের শেষ দিনটি হলো কোজাগরী পূর্ণিমা। এই দিন সনাতন ধর্মাবলম্বী বাঙালিরা দেবী লক্ষ্মীর পূজা করে থাকেন। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করেন বছরের সবচেয়ে উজ্জ্বল রাত আশ্বিনের পূর্ণিমা তিথি। আর এই রাতেই ধন ও প্রাচুর্য ও সৌন্দর্যের দেবী লক্ষ্মী বিষ্ণুলোক থেকে পৃথিবীতে নেমে আসে।

প্রমথনাথ বিশীর চোখেও এসেছে আশ্বিনের নির্মল রূপ। আশ্বিনের নির্মল নদী হয়েছে তরবারির মতো।

'আশ্বিনের নির্মল নদী/ দিগ্বিজয়ী সম্রাটের কোষনির্মুক্ত/ তরবারির মত,/ পাশেই পড়ে আছে/ কাশের রূপালি কাজ করা তার খাপখানা।'

তাই তো শরতের দিগ্বিজয়ী রূপের দেখা মেলে আশ্বিনেই।

Comments

The Daily Star  | English

Israeli military says it killed Iran's wartime chief of staff

Israel says conducted 'extensive strikes' in Iran's west, while explosions near Tel Aviv, sirens blare across Israel; smoke rises after explosion in Iran’s Tabriz

3h ago