বিটিভির সঙ্গে যেমন ছিল আমাদের ৯০ দশকের শৈশব

ডিজাইন: মাহিয়া তাবাসসুম

'আলিফ লায়লা'র জিন, পরী আর উড়ন্ত কার্পেট কী করে আমাদের নিয়ে জাদুর জগতে হারিয়ে যেত মনে পড়ে? প্রতি শুক্রবার সন্ধ্যায় অধীর আগ্রহে বিটিভির রাত ৮টার সংবাদের জন্য অপেক্ষা করতাম, যাতে নতুন এপিসোডে শাহজাদী গুলাফসার নিত্য-নতুন জাদুর দেখা পাই।

বিটিভি আমাদের জন্য শুধু একটি চ্যানেল ছিল না, ছিল আবেগ। শৈশবে যেন বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার একমাত্র মাধ্যম ছিল বিটিভি। আমার সকাল শুরু হতো প্রিয় কার্টুনে চোখ রেখে, আর রাত শেষ হতো পছন্দের বিদেশি ড্রামা দেখে।

আজকের নতুন প্রজন্ম হয়তো এই 'একদা-জনপ্রিয়' চ্যানেলের সঙ্গে নিজেকে খুব একটা মেলাতে পারবে না। কিন্তু আমরা যারা ৯০ এর দশকের বাচ্চাকাচ্চা তাদের জন্য বিটিভি নানা ধারাবাহিক উপহার দিত, যা আজও আমাদের হৃদয়ের মণিকোঠায় বিশেষ স্থান জুড়ে রয়েছে। 'কোথাও কেউ নেই'য়ের বাকের ভাই কিংবা 'আজ রবিবার' নাটকের অদ্ভুত কিন্তু প্রিয় সেই পরিবারের কথা কে ভুলতে পারে?

আলিফ লায়লা

আজও বাকের ভাইয়ের শুরুর দৃশ্যটা মনে করে বারবার রোমাঞ্চিত হই। ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজতে থাকা 'হাওয়া মে উড়তা যায়ে' গান আর বিশাল মাপের কালো সানগ্লাস পড়ে দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সঙ্গে বসে থাকা আমাদের সেই প্রিয় 'গ্যাংস্টার'। আসাদুজ্জামান নূরের চরিত্র 'বাকের ভাই' যেন আমাদের পরিবারেরই একজন হয়ে গিয়েছিল।

কোথাও কেউ নেই

বাকের ভাইকে টিভিতে দেখতে পেলেই যেন অলিগলির সব চোখ একসঙ্গে থেমে যেত সেই স্ক্রিনে। অন্যদিকে হাসিতে লুটপাট হবার জন্য তো খ্যাপাটে সাইকিয়াট্রিস্ট আসগর আর ভাড়াটে আনিসের সঙ্গে তিতলি-কঙ্কার ত্রিভুজ প্রেমের মজাদার গল্প ছিলই। এমনকি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আনিসের গণিতপ্রেম এবং তার সেই স্মরণীয় সংলাপ 'মেয়েটা রেগে গেল কেন'  তো সামাজিক মাধ্যমে মিমের উপকরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে!

আজ রবিবার

আমার পরিবারের সবাই যখন হুমায়ূন আহমেদের ধারাবাহিকে ডুবে আছে, তখন আমি 'ক্যাপ্টেন প্ল্যানেট', 'সিনবাদ' ও রবিনহুডের রোমাঞ্চকর অভিযানে শান্তি খুঁজে পেতাম। প্রতি রোববার বিকেল ৩টা ৩০ মিনিটে বিটিভিতে আসত 'উডি উডপেকার', যেখানে জ্যানি অ্যান্টিকস মন ভালো করে দিতে ভুলত না। এই চ্যানেলে প্রতিদিন 'গডজিলা', 'জুমাঞ্জি', 'ক্যাপ্টেন প্ল্যানেট' এবং 'মোগলি'র মতো আলাদা আলাদা কার্টুন সম্প্রচার করা হতো। এদের সবার সঙ্গে আমার কল্পনার ঘোড়াও ছুটে চলত।

দ্য অ্যাডভেঞ্চারস অব সিনবাদ

বিদেশি কার্টুন ছাড়া অবশ্য চিরতরুণ 'মীনা'র জন্যও আমার বিশেষ দুর্বলতা ছিল। আমি সবসময় চাইতাম আমার মিঠুর মতো একটি কথা বলা পাখি আর মীনার মতো চমৎকার বন্ধু হোক, যারা আমার স্বপ্নের পিছু ছুটে চলতে উৎসাহ দেবে। 'মুরগি চোর' এপিসোডটিতে যখনই মীনা এবং গ্রামবাসীরা চোরকে ধাওয়া করে, তখন আমার হাসির বাঁধ ভেঙে যেত। আমি তখন টিভি পর্দার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠতাম, 'যাও, মীনা! যাও!' আর আমার বোন আমার দিকে অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে থাকত।

মীনা কার্টুন

৯০ এর দশকের বাচ্চাদের প্রায়ই 'জেনারেশন এক্স' বলা হয়। তাদের অনেকেই রবিনহুড আর ম্যাকগাইভারের মতো চরিত্র থেকে অনুপ্রাণিত ছিল। ছোট বাচ্চা ছেলেরা তাদের অনুকরণ করে মারামারি করত আর একটু বড়রা চুল লম্বা করে, আরেকটু বড়রা ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি রেখে ম্যাথিউ পোরেটার মতো হওয়ার চেষ্টা করত।

সেই যুগে পছন্দের চরিত্রদের ছবিসহ স্টিকার আর পেন্সিল বক্স রাখার ঝোঁক ছিল। আমার কাছেও একটি 'রোবোকপ' পেন্সিল বক্স ছিল।

রোবোকপ

আমার ছোট ভাই-বোনরা 'মিস্টার বিন' আর তার মজাদার অভিযানে মজে থাকত। আর তার আজীবন সঙ্গী 'টেডি' জড়বস্তু হলেও তাদের মধ্যকার বন্ধুত্ব যেন অপ্রত্যাশিত তবু দৃঢ় বন্ধনের কথাই জানাত আমাদের।

আর সবশেষে যে অনুষ্ঠানের কথা থাকছে, সেটিও কম নয়। হানিফ সংকেতের 'ইত্যাদি' তো কোনোভাবেই মিস করতাম না। অধীর আগ্রহে আমি এই অনুষ্ঠানের বিভিন্ন অংশের জন্য অপেক্ষা করতাম, যেখানে বিদেশিরা বাংলা বলার চেষ্টা করত। এ ছাড়া সুবীর নন্দী আর সাবিনা ইয়াসমিনের জাদুকরী গানও ছিল। 'ইত্যাদি'র এই বিষয়গুলো এই অনুষ্ঠানের চুম্বক অংশ ছিল।

সময়ের সঙ্গে বিটিভির সোনালি দিন হয়তো মলিন হয়ে এসেছে, কিন্তু এখনও আমাদের মনের অন্তস্থলে এর উপস্থিতি বিরাজমান। শৈশবের এই বিশেষ অংশটির মধ্য দিয়ে বহির্বিশ্বের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক স্থাপনের জন্য আমরা বিটিভির কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকব।

অনুবাদ করেছেন অনিন্দিতা চৌধুরী

Comments

The Daily Star  | English

No justifiable reason to delay nat'l polls beyond Dec: Salahuddin

We have been able to make it clear that there is not even a single mentionable reason to hold the election after December, says the BNP leader

3h ago