কানাডা কি ভারতের জন্য ‘নতুন পাকিস্তান’ হয়ে দাঁড়াচ্ছে

এ বছরের শেষদিকে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য চুক্তি চূড়ান্ত করার কথা ছিল। তবে নিজ্জরের হত্যাকাণ্ড ভেস্তে দিয়েছে এ সম্পর্কিত আলোচনা । দুটো দেশই পাল্টাপাল্টি বহিষ্কার করেছে দু’দেশের কূটনীতিকদের।
জাস্টিন ট্রুডো ও নরেন্দ্র মোদি। ছবি: সংগৃহীত

গত জুনে কানাডার সারেতে এক মন্দিরের সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন খালিস্তান আন্দোলনের নেতা হারদীপ সিং নিজ্জর। 

এর পেছনে ভারতের হাত আছে বলে কানাডার সংসদ হাউস অব কমন্সে অভিযোগ তোলেন প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো।

এ মাসের শুরুতে জি ২০ সম্মেলনে ভারতে আসার পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠকে এ প্রসঙ্গ তুলেছিলেন ট্রুডো। তবে এক্ষেত্রে ভারতের আচরণ আন্তরিক ছিল না।

এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুদেশের সম্পর্ক ক্রমশই তিক্ত হয়ে উঠছে বলে আশঙ্কা করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

এ বিষয়ে দ্য প্রিন্টের রাজনৈতিক বিশ্লেষক শেখর গুপ্ত বলছেন, ভারত ক্রমশই কানাডাকে 'পাকিস্তান প্লাস' বা আরেকটি পাকিস্তান হিসেবে দেখছে। খালিস্তান আন্দোলনকারীদের নিজেদের রাষ্ট্রের জন্য হুমকি হিসেবে দেখছে ভারত। তাই তাদের আশ্রয় দেওয়া ও কার্যক্রমকে সমর্থন করার জন্য কানাডাকে পাকিস্তানসুলভ মনে করছে ভারত।

এদিকে ভারত ইস্যুতে একাট্টা কানাডা। হাউস অব কমন্সে বিরোধীদলীয় নেতা কনজারভেটিভ পার্টির পিয়েরে পোইলিভর বিভেদকে দূরে সরিয়ে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এভাবে অন্য দেশের হস্তক্ষেপে একটি হত্যাকাণ্ড ঘটলে তা কানাডার সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ বলে তিনি মনে করছেন।

কানাডার সাবেক প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হার্পারের সময় কনজারভেটিভ পার্টির সরকারের সঙ্গে শক্তিশালী দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক গড়েছিল ভারত। হার্পারের নেতৃত্বাধীন সরকারের মন্ত্রিসভায় দুবারের সদস্য ছিলেন পোইলিভর। কাজেই ভারতের বিপরীতে তার এই অবস্থানের আলাদা তাৎপর্য আছে।

টরন্টো স্টারের কলামিস্ট অ্যান্ড্রু ফিলিপস মনে করেন ট্রুডো এ নিয়ে এখনো তেমন শক্তিশালী কোনো প্রতিক্রিয়া জানাননি। তিনি বলেন, 'আমরা ধরে নিতে পারি, সরকার এখন পর্যন্ত যতটুকু প্রকাশ করেছে তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু জানে।'

পোইলিভরও ট্রুডো সরকারের সঙ্গে একমত হওয়ার পরদিনই এ বিষয়ে আরও তথ্য জানাতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

এক সপ্তাহ আগে বৃহস্পতিবার জাতিসংঘের বার্ষিক শীর্ষ সম্মেলন শেষের আগে ট্রুডো নিশ্চিত করেছিলেন হাউস অব কমন্সে তিনি অভিযোগগুলো জানাবেন। এক্ষেত্রে তাদের দিক থেকে শিথিলতা নেই- এমন মনোভঙ্গিই প্রকাশ পেয়েছিল তার কথায়।

গত সোমবার ট্রুডো হাউস অব কমন্সে জানান, শিখ নেতাকে হত্যা করতে ভারত সরকারের সম্পৃক্ততা ছিল। এ বিষয়ে তার কাছে বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ আছে। ভারতের দিক থেকেও আছে পাল্টা অভিযোগ- শিখ জনগোষ্ঠী ভারতে শিখদের জন্য স্বাধীন ভূখন্ড প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে আসছে ও কানাডা তাদের প্রশ্রয় দিচ্ছে।

গত ১৮ জুন নিহত হওয়া হারদ্বীপ সিং নিজ্জর পাঞ্জাবে শিখদের জন্য স্বাধীন ও সার্বভৌম ভূমি 'খালিস্তান' প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী ছিলেন। ২০২০ সালের জুলাইয়ে তাকে 'সন্ত্রাসী' আখ্যা দেয় ভারত ও 'ওয়ান্টেড' লিস্টে রাখে।

কানাডার ওয়ার্ল্ড শিখ অরগানাইজেশন মনে করছে, কানাডার গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে নিজ্জরকে আগেই সতর্ক করা হয়েছিল। হত্যাকাণ্ডটি পূর্বপরিকল্পিত বলে মনে করছেন তারা।

অপরদিকে, ভারত নজর রেখেছে কানাডার শিখ সম্প্রদায়ের দিকে। কানাডায় ৭ লাখ ৭০ হাজার শিখ ধর্মাবলম্বী মানুষ রয়েছেন৷ ভারত অতীতে অভিযোগ করেছে, কানাডার অভিবাসী শিখেরা 'বিচ্ছিন্নতাবাদ' উস্কে দিচ্ছে।

২০১৮ সালে ট্রুডো ভারতকে এমন আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, খালিস্তান আন্দোলন পুনর্জাগরিত হয়- এমন কোনো পদক্ষেপে সমর্থন দেবে না কানাডা৷ তবে মত প্রকাশ ও সভা সমাবেশের অধিকারে হস্তক্ষেপ করতে চান না বলেও জানিয়েছিলেন ট্রুডো।

এ বছরের শেষদিকে দুটো দেশের ভেতর বাণিজ্য চুক্তি চূড়ান্ত করার কথা ছিল। তবে নিজ্জরের হত্যাকাণ্ড ভেস্তে দিয়েছে এ সম্পর্কিত আলোচনা ও পরবর্তী পদক্ষেপ। দুটো দেশই পাল্টাপাল্টি বহিষ্কার করেছে দু'দেশের কূটনীতিকদের।

এই হত্যাকাণ্ডে ভারতের হাত থাকতে পারে- কানাডার এমন অভিযোগকে সমর্থন জানিয়েছে পাকিস্তান। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৮তম অধিবেশনে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব সাইরাস কাজী জানান, কানাডায় ভারতের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে পাকিস্তান বিস্মিত নয়। ট্রুডোর অভিযোগে অস্বাভাবিক কিছু দেখছেন না বলেও জানান তিনি।

এ বিষয়ে ভারতীয় এজেন্টদের সম্পৃক্ততা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কানাডা নিবিড়ভাবে কাজ করছে বলে কানাডা সরকারের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা রয়টার্সকে জানিয়েছেন।

তিনি জানিয়েছেন, কানাডার কাছে থাকা তথ্যপ্রমাণ যথাসময়ে যুক্তরাষ্ট্রকে জানানো হবে।

এ বিষয়ে অটোয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক ও ট্রুডো সরকারের সাবেক পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা রোল্যান্ড প্যারিস জানান, শিখ নেতা হত্যার তদন্ত সমাধান করার আগে দুটি দেশের সরকারের ভেতর স্বাভাবিক আলোচনা কঠিন হবে বলে মনে করি।

ট্রুডো কেন শিখ সংগঠনগুলোর প্রতি নমনীয়- তার পেছনেও কারণ রয়েছে। ট্রুডোর সরকার একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রাপ্ত নয়। কাজেই নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টির সমর্থন নিতে হয়েছে তাকে। আর এই পার্টির নেতা জগমিত সিং খালিস্তানি নেতাদের ঘনিষ্ঠ। ট্রুডো হাউস অব কমন্সে অভিযোগ আনার পরপরই জগমিত সিং বিবৃতি দিয়ে ভারতের ভূমিকায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন।

জি ২০ সম্মেলনের আগে গত আগস্টে কানাডার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জডি থমাস ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। কানাডা চেয়েছিল ভারত, কানাডা ও খালিস্তানিদের ত্রিপক্ষীয় বৈঠক। তবে কানাডার মধ্যস্ততায় এমন বৈঠকে বসতে সম্মত হয়নি ভারত।

তার ওপর নিজ্জরের হত্যাকাণ্ডের জন্য ভারতের দিকে ট্রুডো আঙ্গুল তোলায় ভারতে কানাডার নাগরিকদের ভিসা প্রদান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা ও ভারতে কানাডার কূটনীতিকদের সংখ্যা সীমিত করার কথা বলেছে ভারত।

ভারত বর্তমানে পশ্চিমের ঘনিষ্ঠ মিত্র ও ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্র কানাডার সঙ্গে তদন্তে সহায়তা করলেও চীনের বিরুদ্ধে তাদের অর্থনৈতিক আধিপত্য ধরে রাখতে ভারতকে বিব্রত করতে চাইবে না।

ভারতের বাজার পশ্চিমা বিনিয়োগের গুরুত্বপূর্ণ জায়গা, কানাডিয়ান পেনশন ফান্ডেরও গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগক্ষেত্র ভারত। রাশিয়া-চীনকে মোকাবেলার জন্য ভারতের বন্ধুত্ব প্রয়োজন পশ্চিমের। তাই পশ্চিমের সহযোগিতায় কানাডের সঙ্গে সম্পর্কের সংকট মিটিয়ে ফেলা হতে পারে ভারতের জন্য সুবিধাজনক। তবে ২০২৪ এর নির্বাচনের আগে এই ইস্যুতে দুর্বল হতে চাইবেনা মোদি সরকার। তাই খালিস্তান ইস্যুতে অনমনীয় ভূমিকায় থাকতে পারে ভারত।

কট্টর খালিস্তানিদের বিরুদ্ধে ট্রুডোর নমনীয় মনোভাবের সমালোচনা করেছেন লিবারেল পার্টির সাংসদ চন্দ্র আর্যও। এক্ষেত্রে অনেকটা ভারতের সুরেই কথা বলেছেন তিনি।

তবে টরন্টো স্টার বলছে, অনেক শিখ কানাডিয়ান নিজ্জরের হত্যাকাণ্ডে ভীত হবেন, কেউ হবেন রাগান্বিত অথবা প্রতিশোধ গ্রহণে প্রলুব্ধ। তাই কানাডায় জাতিগত ও সাম্প্রদায়িক কারণে রক্তপাতের ঝুঁকির বাস্তবতা রয়েছে। এই মূল্যায়ন বেশ গুরুত্ববহ, মোটেই উড়িয়ে দেবার মতো নয়।

উল্লেখ্য, কানাডায় প্রচুর ভারতীয় শিক্ষার্থী পড়তে আসেন৷ নিজ্জরের হত্যাকাণ্ড ভারতীয় শিক্ষার্থীদের ভিসা দেয়ার ক্ষেত্রে কানাডার আগ্রহ কমিয়েছে। বিশেষত, কানাডায় অভিবাসী শ্রমিকদের সবচেয়ে বড় উৎস ভারত। খালিস্তান ইস্যু কানাডায় ভারতীয় অভিবাসী শ্রমিকদের আগমনের পথ সংকুচিত করবে কি না তা এখন দেখার বিষয়।

Comments

The Daily Star  | English
44th BCS written exam result

Languishing in BCS LOOP

Imam Hossein had applied for the 41st Bangladesh Civil Service (BCS) exams in November 2019, just months after completing his master’s from Jagannath University.

59m ago