‘সব বন্ধ করে দিয়ে বসে থাকব’

ভোট মানুষের অধিকার। সেই অধিকার থেকে মানুষ বঞ্চিত হয়েছে ২০১৪ ও ২০১৮ সালে। আসন্ন নির্বাচনের পূর্বে মানুষ সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনের প্রত্যাশা নিয়ে কথা বলবে, সেটা তো অস্বাভাবিক কোনো চাওয়া নয়।

শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে টানা ১৫ বছর পার করছেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো সরকারপ্রধান একনাগাড়ে এতদিন দেশ পরিচালনা করতে পারেননি। এই ১৫ বছরের সময়কালে অনেক রকমের মূল্যায়ন আছে, সমালোচনা আছে, দুর্নীতি-অনিয়ম নিয়ে কথা আছে।

দৃশ্যমান অর্জন আছে, বিশেষ করে অবকাঠামোখাতে। পদ্মা সেতু থেকে শুরু করে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের মতো আরও কিছু অর্জনের কথা বলা যাবে। এই অর্জনগুলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একক উদ্যোগ ও দৃঢ়তার কারণেই সম্ভব হয়েছে। এ কারণে অবশ্যই তিনি প্রশংসিত হবেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আরেকটি ভালো বা প্রশংসনীয় উদ্যোগ—বিদেশ সফর থেকে ফিরে তিনি সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হন। আনুষ্ঠানিক সেই সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিক ও সম্পাদকরা তাকে প্রশ্ন করার সুযোগ পান।  প্রশ্ন করার সুযোগের মধ্য দিয়ে দেশের মানুষ জানতে পারেন যে তিনি বিদেশ সফরে কেন গেলেন, কী অর্জন করলেন, বাংলাদেশের কী কী লাভ হলো, কী কী সুবিধা হলো। যদিও সেখানে যেসব সংবাদকর্মীরা প্রশ্ন করেন, তারা মূল প্রশ্নটি না করে অন্যান্য অপ্রাসঙ্গিক বিষয় অবতারণা করায় যে উদ্দেশ্যে সংবাদ সম্মেলন করা, সেটা অর্জিত হয় কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।

সংবাদ সম্মেলন আয়োজনের জন্য অবশ্যই আমরা তার প্রশংসা করি। সেখানে প্রশ্ন-উত্তরে যা সামনে আসে, তা নিয়েও তৈরি হয় অনেক প্রশ্ন।

যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে ১৬ দিনের সফর শেষে দেশে ফেরার দুই দিন পর গত ৬ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলন করলেন। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশ দুটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র।

যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য সফরের অর্জন মূলত সংবাদ সম্মেলনের বিষয় হওয়ার কথা ছিল। তবে সেই সংবাদ সম্মেলনে সফরে বাংলাদেশের অর্জন বা তিনি কী কী করেছেন—তার পাশাপাশি প্রশ্ন-উত্তর পর্বে উঠে এসেছে ভিন্ন কিছু প্রসঙ্গ। সেই প্রসঙ্গও বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেশের জন্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাওয়া বিষয়ক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছেন, 'বেশি কথা বললে সব বন্ধ করে দিয়ে বসে থাকব। ইলেকশনের পর যদি আসতে পারি, তাহলে আবার করব। সব গুছিয়ে দেওয়ার পর এখন ইলেকশনের কথা, ভোটের কথা, অর্থনীতির পাকা পাকা কথা শুনতে হয়। আমি এসব শুনতে রাজি না।'

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছেন, 'এখন দেশের মানুষ যদি বলে রিজার্ভ রক্ষা করতে হবে, তাহলে আমি বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দেই, পানি দেওয়া বন্ধ করে দেই, সার দেওয়া বন্ধ করে দেই। সব বন্ধ করে বসিয়ে রাখি, আমাদের রিজার্ভ ভালো থাকবে।'

উত্তরে যখন বলা হয় 'বেশি কথা বললে সব বন্ধ করে দিয়ে বসে থাকব', এটা কি প্রশ্নের প্রাসঙ্গিক উত্তর? এতে মানুষের জানার যে অধিকার, তা কি সংকুচিত হয়ে গেল না?

এখানে খুব প্রাসঙ্গিকভাবে আসে বাংলাদেশের সংবিধানের প্রসঙ্গ। সংবিধান দেশের জনগণকে রাষ্ট্রের মালিক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। রাষ্ট্রের মালিকের পক্ষে যারা দেশ পরিচালনা করেন, যারা ক্ষমতায় থাকেন, তারা জনগণের পক্ষে দেশ পরিচালনা করেন। এ কথা আমরা সবাই জানি যে সরকারের কোনো অর্থ থাকে না, সরকারের কোনো সম্পদ থাকে না, মন্ত্রী বা রাজনীতিবিদরা রাষ্ট্রীয় অর্থ-সম্পদের মালিক না। মালিক জনগণ। জনগণের পক্ষে একটি সরকার সেটার ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকে। বর্তমান সরকারও এর ব্যতিক্রম নয়। জনগণের সম্পদ-অর্থ ব্যবহার করেই রাষ্ট্রীয় সব উন্নয়ন করা হয়েছে বা হচ্ছে।

বিদ্যুৎখাতের কথা যদি বলি, সেখানে রেন্টাল-কুইক রেন্টাল, ক্যাপাসিটি চার্জ, দুর্নীতি-অনিয়ম নিয়ে অনেক কথা আছে। কিন্তু এ কথা সত্যি যে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ২০০৯ সালে যখন দায়িত্ব নিয়েছিলেন, তখনকার তুলনায় এখন আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা অনেক বেড়েছে। তখন চার হাজার মেগাওয়াটের মতো সক্ষমতা ছিল, এখন যা প্রায় ২৫ হাজার মেগাওয়াট।

বিদ্যুৎ উৎপাদনের পদ্ধতিগত ও দুর্নীতি-অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা নিয়ে মানুষের মনে বহুবিধ প্রশ্ন আছে। তার অংশ হিসেবেই প্রধানমন্ত্রীর সামনে প্রশ্ন তোলা হয়েছে।

উত্তরে যখন বলা হয় 'বেশি কথা বললে সব বন্ধ করে দিয়ে বসে থাকব', এটা কি প্রশ্নের প্রাসঙ্গিক উত্তর? এতে মানুষের জানার যে অধিকার, তা কি সংকুচিত হয়ে গেল না?

দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা প্রায় ২৫ হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু আমাদের চাহিদা ১৪-১৫ হাজার মেগাওয়াট। ১০ হাজার মেগাওয়াট বাড়তি সক্ষমতার ক্যাপাসিটি চার্জও পরিশোধ করতে হচ্ছে। এখানে কি সক্ষমতা ও চাহিদার ভারসাম্য থাকা দরকার ছিল না?

দেশ যদি জনগণের হয়, দেশের মালিক যদি জনগণ হয়, জনগণের সম্পদে যদি দেশ পরিচালিত হয়, জনগণের অর্থে যদি বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়, তাহলে 'সব বন্ধ' করে দেওয়ার মতো অবস্থা, ক্ষমতা বা সুযোগ কারো থাকে?  জনগণ তাদের মতামত জানাতে পারবে না, প্রশ্ন করতে পারবে না?

প্রধানমন্ত্রী এর আগেও বলেছেন, গত সংবাদ সম্মেলনেও বলেছেন যে, 'বিদ্যুৎ মন্ত্রীকে বলেছিলাম, প্রতিদিন যেন কিছু লোডশেডিং দেয়, তাহলে মানুষের মনে থাকবে যে লোডশেডিং আছে। পয়সা খরচ করে তেল কিনে জেনারেটর চালাতে হবে। তখন আক্কেলটা ঠিক হবে যে, না এই অবস্থা তো ছিল।'

বিদ্যুৎ থাকবে, কিন্তু লোডশেডিং দিয়ে জনগণকে মনে করাতে হবে কেন? দেশের মানুষ তো সব বাস্তবতা সম্পর্কে অবগত। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা প্রায় ২৫ হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু আমাদের চাহিদা ১৪-১৫ হাজার মেগাওয়াট। ১০ হাজার মেগাওয়াট বাড়তি সক্ষমতার ক্যাপাসিটি চার্জও পরিশোধ করতে হচ্ছে। এখানে কি সক্ষমতা ও চাহিদার ভারসাম্য থাকা দরকার ছিল না?

সংযোগ পেলেও বিদ্যুতের বণ্টনে কি নায্যতা আছে? ঢাকা শহরের মানুষ তুলনামূলক ভালো আছে। কিন্তু ডেইলি স্টারেও একাধিকবার সংবাদ প্রকাশ হয়েছে যে গ্রামের মানুষ অত্যন্ত কষ্টে আছে। সেখানে এখনো ৫-৬ ঘণ্টা, কোথাও কোথাও ৮-১০ ঘণ্টা লোডশেডিং হয়। ঢাকা শহরের মানুষকে ভালো রেখে গ্রামের মানুষকে লোডশেডিংয়ের মধ্যে রেখে ২৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য আমাদের বিপুল পরিমাণ যে ব্যয়, সেটার যৌক্তিকতা নিয়ে যদি কেউ প্রশ্ন তোলে, সেটা কি খুব অপ্রাসঙ্গিক হবে?

একটা সঠিক ব্যাখ্যা প্রত্যাশিত ছিল যে ঠিক কী কারণে গ্রামের মানুষকে বিদ্যুৎ কম দিয়ে শহরের মানুষকে বেশি দেওয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে যদি কোনো যুক্তি থাকে, তাহলে তা তুলে ধরা দরকার ছিল। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির কথা বারবার বলা হয়েছে। কিন্তু সেই অবস্থারও তো পরিবর্তন হয়েছে। বিশ্ববাজারে জ্বালানিসহ প্রায় সব জিনিসের দাম কমে এসেছে। দেশের বাজারে যদিও কোনো কিছুর দামই কমেনি।

রিজার্ভ থেকে অর্থ নিয়ে বিশেষ উন্নয়ন তহবিল করা হলো। দেশের অর্থনীতিবিদরা তখন বলেছিলেন, এটা করা ঠিক হচ্ছে না। কিন্তু সরকার সেদিকে নজর দেয়নি, সরকার কাজটি করেছে। কিন্তু এখন এসে যখন রিজার্ভ সংকট তৈরি হচ্ছে, তখন তাহলে এটার আরেকটা ব্যাখ্যা দেওয়া দরকার ছিল—যদি থেকে থাকে। তা না করে যদি ক্ষুব্ধতা প্রকাশ করা হয়, তাহলে রাষ্ট্র বা সমাজে এমন বার্তা যায় যে কোনো প্রশ্ন তোলা যাবে না।

যা সম্ভব ছিল তা কি আমরা করতে পেরেছি? রিজার্ভ থেকে চুরি যাওয়া অর্থই তো আমরা ফিরিয়ে আনতে পারলাম না। এমনকি তদন্ত করে শাস্তির ব্যবস্থাও করছি না।

যদি 'সব বন্ধ করে' দেওয়াও হয়, তাহলে কি রিজার্ভ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে? বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দিলে তো টাকাও পাওয়া যাবে না, বিদ্যুৎও পাওয়া যাবে না। ১৪ বছরে বেসরকারি, সরকারিখাত মিলিয়ে দেড় লক্ষাধিক কোটি টাকা 'ক্যাপাসিটি চার্জ' দেওয়া হয়েছে, তাও তো ফিরে এসে রিজার্ভে জমা হবে না। জিনিসপত্রের দাম কি সেই পূর্বের, মানে ২০০৯ সালের অবস্থানে ফিরে যাবে? নিশ্চয় যাবে না, বিশ্ব পরিস্থিতির কারণেই হবে না।

তেমনি 'সব বন্ধ করে' কোনো কিছুই পূর্বের অবস্থায় ফিরে যাবে না। বন্ধ করে দেওয়া কোনো বিবেচনাতেই সম্ভব না।

যা সম্ভব ছিল তা কি আমরা করতে পেরেছি? রিজার্ভ থেকে চুরি যাওয়া অর্থই তো আমরা ফিরিয়ে আনতে পারলাম না। এমনকি তদন্ত করে শাস্তির ব্যবস্থাও করছি না। সিআইডির তদন্ত প্রতিবেদন জমার তারিখ এখন পর্যন্ত পিছিয়েছে ৭৩ বার। এ বিষয়গুলোর ব্যাখ্যা জানার অধিকার তো মানুষের আছে।

ফলে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে সামনে আসে গণতন্ত্র ও জবাবদিহিতার প্রসঙ্গ। সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করছেন, কিন্তু প্রশ্নের উত্তরে প্রাসঙ্গিক উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না। ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার প্রকাশ ঘটছে। 'সব গুছিয়ে দেওয়ার পর' নির্বাচনের প্রসঙ্গ আসছে, কারণ নির্বাচনের আগেই তো নির্বাচন নিয়ে কথা হবে।

ভোট মানুষের অধিকার। সেই অধিকার থেকে মানুষ বঞ্চিত হয়েছে ২০১৪ ও ২০১৮ সালে। আসন্ন নির্বাচনের পূর্বে মানুষ সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনের প্রত্যাশা নিয়ে কথা বলবে, সেটা তো অস্বাভাবিক কোনো চাওয়া নয়।

[email protected]

Comments