শ্রদ্ধা

শিক্ষক রাজনীতিতে অনাগ্রহী দানীউল হকের সাধনা

আমাদের শিক্ষক সমাজে অন্যরকম এক ব্যক্তিত্বের অধিকারী অধ্যাপক মহাম্মদ দানীউল হক। পরিমিতিবোধের সংযোগ ছিলো তার চলন ও বলনে। কখনো উচ্চবাচ্যে কথা বলতেন না। ধীরলয়ে কথাবলা, কথার ফাঁকে স্মিতহাসির স্ফুরণের অপূর্ব সমারোহ অনুসরণীয় হয়ে উঠেছিলেন অনেকের। গুছিয়ে কাজ করার দক্ষতা অনেককেই মুগ্ধ করতো। সময়ের কাজ সময়ের মধ্যেই সম্পাদন করার দৃষ্টান্ত অনুসরণযোগ্য। নিষ্ঠা, একাগ্রতা ও কর্তব্যনিষ্ঠ জীবন-তার সাফল্যের মূলসূত্র। শিক্ষকতা তার জীবনের ব্রত।

স্যার, সাবলীল শৈলীতে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। অতিরিক্ত বাক্যব্যয় করতেন না। জীবনবোধের সাথে পাঠ্যপুস্তকের সম্মিলন ঘটানোর আপ্রাণ চেষ্টা থাকতো তার শ্রেণীকক্ষের পাঠদানে। অপ্রিয় সত্য বলতেন নির্দ্বিধায়। শিক্ষক ও ছাত্ররাজনীতিকে অপছন্দ করতেন। পড়ালেখা ও পাঠদানের মধ্যেই নিজেকে সীমায়িত রেখেছিলেন আমৃত্যু। বর্তমান সমাজে এমন নিষ্ঠাবান শিক্ষক, পাঠক ও গবেষক পাওয়া দুরূহ।

মহাম্মদ দানীউল হকের জন্ম (১৯৪৭) দেশভাগের সময়-ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে। শিক্ষাজীবনের অধিককাল কেটেছে চট্টগ্রাম কলেজ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছোটবেলা থেকেই লেখালেখির প্রতি ছিলো অনুরাগ।  সে ধারাকে আরও দক্ষ করে তোলেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে ডিগ্রি লাভের পর। কর্মময় জীবন অতিবাহিত করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপনায়। আশির দশকে তিনি সৃজনশীল সাহিত্য রচনায় মনোনিবেশ করেন। ভ্রমণকাহিনী ও শিশুতোষ গ্রন্থের দৃষ্টান্ত উল্লেখযোগ্য। পরবর্তীকালে ভাষাবিজ্ঞানের অন্বিষ্ট সাধনায় নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছেন।

সাহিত্যের বাইরে তার প্রবল আগ্রহ ছিলো ভাষাবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা। হাওয়াই ও লসএঞ্জেলেস বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষাবিজ্ঞান বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি লাভের পর ভাষাবিজ্ঞান চর্চায় অভিনিবিষ্ট হন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষাবিজ্ঞান চর্চার 'অগ্রপথিক' হিসেবে তাঁকে গণ্য করা হয়। এই পথ ধরেই ভাষাবিজ্ঞানীর খ্যাতি লাভ করেন। দেশে-বিদেশে প্রবন্ধ পাঠ, সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে অংশগ্রহণ করে নিজেকে সর্বদা নিয়োজিত রাখতেন। ভাষা ও ভাষাবিজ্ঞান বিষয়ে গ্রন্থের মধ্যে 'ভাষাবিজ্ঞানের সূক্ষ্মতর প্রসঙ্গ', 'ভাষাবিজ্ঞানের কথা', 'বাংলা ভাষা-সাহিত্যের উল্লেখ্য', 'ভাষা আয়ত্তকরণ ও শিখন', 'নির্বাচিত ভাষাবিজ্ঞান প্রবন্ধ', 'সাহিত্য-কথা অনুবেদন' প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

সংখ্যার বিচারে বেশি গ্রন্থ তিনি রচনা করেননি। তবে এসব রচনায় কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন-ভাষা ও ভাষাবিজ্ঞানের মৌলিক নীতি ও নিজস্ব চিন্তা প্রকাশে। এ ধারার অগ্রপথিক মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। তাদের হাত ধরে মুহম্মদ আবদুল হাই, রফিকুল ইসলাম, হুমায়ুন আজাদ, মনিরুজ্জামান, আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ, রাজীব হুমায়ুন, মনসুর মুসা প্রমুখ বাংলা অঞ্চলের ভাষাবিজ্ঞান চর্চার গতিকে উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। তারা ভাষাবিজ্ঞানের চর্চাকে কেবল ত্বরান্বিতই করেননি; আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানের পথচলাও ঋদ্ধ করেছেন। 

ভাষাবিজ্ঞানের পথচলায় সারথি হয়েছেন অধ্যাপক মহাম্মদ দানীউল হক। তার লেখা 'ভাষাবিজ্ঞানের কথা'-গ্রন্থটি বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য। এ-গ্রন্থ প্রকাশের পর তিনি বাংলাদেশের ভাষাবিজ্ঞান জগতে পরিচিতি পান। এতে ভাষাবিজ্ঞানের প্রধান প্রধান দিকের সমাবেশ ঘটেছে। বিষয়কে অযথা দুর্বোধ্য করা হয়নি এবং সমধর্মী বিষয়ের সাথে প্রতি-আলোচনায় বা তুলনা দ্বারা সমস্যাকে স্পষ্টতর করার চেষ্টা করা হয়েছে। ব্যাখ্যাগুলোও উপযোগী উদাহরণ সমর্থিত। কিছু বিষয়কে বিস্তারিত দেখার চেষ্টা করা হয়েছে, অথচ ভাষা-শৃঙ্খলার প্রয়োজনীয় প্রায় সকল সমস্যাই অবতারণা এখানে সুলভ। 

এ- গ্রন্থের সর্বত্র একটি বৈজ্ঞানিকমনস্কতা তথা বিষয়কে প্রামাণ্যভাবে উপস্থিত করার প্রতি অসামান্য মনোযোগ-উপযোগিতা নিঃশেষে বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রচলিত ও পুষ্ট ধারণার মধ্যে নবতর চিন্তা এবং পদ্ধতির প্রস্তাবনা তথা অবতারণায় তিনি সিদ্ধহস্তের পরিচয় দিয়েছেন। মানব-মনীষা ভাষা নামক প্রপঞ্চের মাধ্যমেই ভাবের আদান-প্রদান করে থাকে। জগতের সকল কিছুর মধ্যেই ভাষা-সংশ্লিষ্টতা বিদ্যমান। ভাষাবিজ্ঞান বর্তমানে বহু-শৃঙ্খলা-লব্ধ জ্ঞানশাখা। দানীউল হক এ-সব দিক বিবেচনায় গ্রন্থটিতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের বিন্যাস ঘটিয়েছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য-মানবভাষার শ্রেষ্ঠত্ব, ধ্বনিবিজ্ঞান, রূপমূলতত্ত্ব, বাক্যতত্ত্ব, বাগর্থতত্ত্ব, রূপান্তরমূলক ব্যাকরণ, ভাষার ক্রম পরিবর্তন, পৃথিবীর ভাষাসমূহ প্রভৃতি। 

২০০১ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরনো কলাভবনের সামনে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পর বিভিন্ন ব্যাচের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের সঙ্গে সামনে থেকে দ্বিতীয় সারিতে মধ্যখানে অধ্যাপক দানীউল হককে দেখা যাচ্ছে। ছবি সংগ্রহ: অধ্যাপক খালেদ হোসাইন

মানুষের সুশৃঙ্খল ভাষা আয়ত্তের পারজ্ঞমতা বিদ্যমান। এ-বিষয়ক দুটি তত্ত্ব বর্তমান ভাষাবিজ্ঞান-জগতে আলোচিত-সমালোচিত। এক তত্ত্বে বলা হয়েছে, একটি শিশু জন্ম-প্রক্রিয়ার প্রারম্ভে ভাষা-ধারণা আয়ত্ত করতে থাকে। শিশু যে পরিবেশে জন্মগ্রহণ করে সে পরিবেশের ভাষা তার মধ্যে বিকশিত হয়। বিখ্যাত ভাষাবিজ্ঞানী ও চিন্তক আব্রাহাম নোয়াম চমস্কি তার তত্ত্বে বলেছেন, একটি শিশু জন্মের সময়ই ভাষা-জ্ঞান নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। সংশ্লিষ্ট পরিবেশের ভাষা সে আয়ত্ত করে থাকে। এ-তত্ত্বকে মনোবাদী তত্ত্ব বলা হয়। অন্য তত্ত্বে বলা হয়েছে, একটি শিশু জন্মের সময় কোনো ভাষা জ্ঞান নিয়ে পৃথিবীতে আসে না; জন্মের পর পরিবেশ থেকে সে ভাষা শেখে। এ-তত্ত্বের নাম আচরণবাদী তত্ত্ব।

মহাম্মদ দানীউল হক 'ভাষা আয়ত্তকরণ ও শিখন প্রাথমিক ধারণা' গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনায় ব্রতী হয়েছেন। ভাষা আয়ত্তকরণ, মাধ্যমিক জ্ঞাতব্য, দ্বিতীয় ভাষা আয়ত্তকরণ তত্ত্ব: অনুপুঙ্খ ভাবনা, ভাষা আয়ত্তকরণ ও ভাষাবৈজ্ঞানিক তত্ত্ব, ভাষার ব্যবহার প্রভৃতি বিষয় সংশ্লিষ্ট করে গ্রন্থটিতে আলোচিত হয়েছে ভাষা আয়ত্তকরণের খুঁটিনাটি দিক। ভাষাবিজ্ঞানের নবতর শাখা হিসেবে এটি প্রায়োগিক ভাষাবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয়। বাংলাভাষাী অঞ্চলে এ বিষয়ে তেমন কোনো কাজ নেই। এ গ্রন্থ-রচনার মাধ্যমেই তিনি এ বিষয়ে পাঠকদের মধ্যে উদ্দীপনা ও গবেষণার আগ্রহ সৃষ্টি করেছেন। 

অধ্যাপক মহাম্মদ দানীউল হকের ভাষাবিজ্ঞান চর্চায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের ভূমিকা অনস্বীকার্য। প্রতিষ্ঠালগ্ন (১৯৯২) থেকে প্রায় ৩২ বছর তিনি এ বিভাগের খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণের পরও এ-বিভাগে তার সুদীপ্ত পদচারণা তার প্রমাণ। সাহিত্যের অঙ্গন থেকে ভাষাবিজ্ঞানের চর্চার আঁকড় এই ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ। আমৃত্যু এ-বিভাগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাই তাকে ভাষাবিজ্ঞানের 'নিষ্ঠাবান সারথি' বললে অত্যুক্তি হবে না। 

বাংলা ভাষা ও ভাষাবিজ্ঞান চর্চায় মহাম্মদ দানীউল হক এক অন্যতম প্রতিভু। প্রচারবিমুখ মানুষটি ৭ অক্টোবর সবাইকে কাঁদিয়ে চলে যান। অন্তরে-বাইরে তথা আপাদমস্তক তিনি ভাষাবিজ্ঞান চর্চায় মনোনিবেশ করেছিলেন। বাংলা একাডেমি থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো তার কর্মনিপুণতার ছাপ। তিনি বাগ্মী ছিলেন; ছিলেন একজন প্রকৃত গবেষক। প্রবন্ধ, সাহিত্য, ভাষাবিজ্ঞান-প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। কর্মের মধ্যেই তিনি পাঠকহৃদয়ে চির অম্লান হয়ে থাকবেন। ভাষাবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের- পাথেয় হয়ে থাকবে তার রচনাগুলো। গবেষণায় প্রেরণা জোগাবে তার গবেষণাধর্মী কাজ। তাই তিনি ইহলোক ত্যাগ করলেও বেঁচে থাকবেন পাঠক-হৃদয়ে যুগান্তরে।

Comments

The Daily Star  | English

Jatiya Party HQ set afire, vandalised

The Jatiya Party headquarters at the capital’s Kakrail was set on fire and vandalised last night by a group of people who claimed themselves to be “anti-fascist students, workers, and masses”.

15m ago