অধঃপতনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় একা না

ভাষা কেবল চিন্তার বাহন না, চিন্তার স্মারকও বটে। মানুষের ভাষাই বলে দেবে তার চিন্তার শক্তি ও দুরবস্থার কথা এবং ইঙ্গিত দেবে তার ভবিষ্যতের। এই কথাটা প্রেক্ষাপটে রেখে আমরা বুঝতে চাইব 'ইউনিভার্সিটি' ভাব-প্রত্যয়টি কীভাবে বাংলায় 'বিশ্ববিদ্যালয়' অভিনামে আত্মস্থ হয়েছে এবং তার পরিণতি কী।

যারা এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ইংরেজি নামের বাংলা করছিলেন তাদের খুব ভাল করে ইংরেজি ভাষা বা ইংরেজদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও প্রত্যয়গুলোর সাথে গভীর পরিচয় থাকার সুযোগ ছিল না। আবার যাদের জন্য তারা এই নামগুলোর বাংলা করছিলেন সেই দখলদার ইংরেজদেরও বাংলা ভাষা সম্পর্কে ভাল জানা-শোনা ছিল না। এই সুযোগে গোঁজামিল দিয়ে কাজ চালানোর মতো কিছু একটা বাংলা দাঁড় করালেই সে সময় চলে যাচ্ছিল। সুতরাং স্কুলের বাংলা 'বিদ্যালয়' হলো, কলেজের বাংলা হলো 'মহাবিদ্যালয়'। অনেক ক্ষেত্রেই ভুলভাল একটা কিছু অনুবাদ করে দিলেই সমাজ-মানসে তা সহজে গৃহীত হয় না। কিন্তু বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় হলো। 'কেন হলো' এই প্রশ্নটার উত্তর খুঁজতে গিয়ে যে কথাটা মনে ধরেছে সেটিও কম মন্দ নয়!

বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যমান অবস্থা বুঝাতে আমি একটা উদাহরণ নেই। বাংলায় ইংরেজ আসার আগে টোল ছিল, গুরুগৃহ ছিল, পাঠশালা ছিল, মক্তব ছিল, মাদ্রাসা ছিল, বিহার ছিল, তপোবন ছিল কিন্তু স্কুল ছিল না। স্কুল এলো ইউরোপীয়দের হাত ধরে। সেটি নানান কারণে জনপ্রিয় হলো। এই দেশের মানুষ স্কুল তৈরি করতে চাইলো। এই চাওয়া থেকে নিখাদ অনুকরণ। 

স্কুলের একটা বাংলা দরকার হলো, বাংলা করা হলো বিদ্যালয়। বিদ্যালয় শব্দটা চালু ছিল। কিন্তু আজ যে অর্থে বুঝি সে অর্থে না। বিদ্যার আলয়, বিদ্যা যেখানে থাকে, বিদ্যা কোথায় থাকে? বইয়ে। বই বা গ্রন্থ ছিল বিদ্যালয়। বইয়ের সমার্থক হয়ে গেল স্কুল, আমাদের বুঝাবুঝির ভুলে। তারপর কলেজ এলো। বিশাল ব্যাপার। আরবি কুল্লিয়া থেকে কালিজ, কলেজ। মানে সব কিছু ওখানেই হবে। কলেজ- বাংলা করতে গিয়ে বাঙলা ভাষার ভাণ্ডারে থাকা সবচে বড় শব্দ মহা বসিয়ে বানানো হয়েছে মহাবিদ্যালয়। 

কিছুদিন বাদে যখন কলিকাতা বা মাদ্রাজ ইউনিভার্সিটি হলো তখন তৈরি হলো বিপদ। আগেই তো মহাবিদ্যালয় খরচ করে ফেলেছে, এখন ইউনিভার্সিটাস বুঝাতে কী শব্দ ব্যবহার করবে? এইদেকে ইউনিভার্স অর্থ আগেই মহাবিশ্ব হয়ে আছে। যথাযথ সমাধান হলো না, ইউনিভার্সিটির বাংলা হলো বিশ্ববিদ্যালয়। হওয়া সঙ্গত ছিল মহাবিশ্ববিদ্যালয়। এখন ইউনিভার্সিটি কলেজগুলোর বাংলা আর করা যায় না। বাংলা কী করবে, ইডেন বিশ্ববিদ্যালয় মহাবিদ্যালয় না কি মহাবিদ্যালয় বিশ্ববিদ্যালয়?

এই উদাহরণ দেই এ কথা বলতে যে, স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটি আমাদের এগুলো আমরা শিক্ষালয় হিসেবে গড়তে চেয়েছি। বিদ্যালয় না। শিক্ষালয়ের উদ্দেশ্য হচ্ছে দক্ষতা তৈরি। আর বিদ্যার উদ্দেশ্য থাকে জ্ঞানার্জন, জ্ঞান শক্তি। সেই শক্তি নিজের ভেতরের সম্ভাবনাগুলোকে বিকশিত করার, মানুষ হওয়ার। সে যাই হোক, এই যে ইউনিভার্সিটির ভুল বাংলা হইলো, তা কি কারো নজরে আসে নাই। আসছে। একটু দেরিতে হইলেও নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু গৌড় ইউনিভার্সিটির নাম দিছিলেন গৌড়িয় সর্ববিদ্যায়তন্ খেয়াল করেন। আরও অনেক চেষ্টা হইছে।

এই যে ভুলভাবে যাত্রা শুরু হইলো। কেন হইলো? কারণ ইউনিভার্সিটির কনসেপ্ট বা প্রত্যয় আমাদের কাছে পরিষ্কার ছিল না। আমরা ইউনিভার্সিটির অন্তরের খবর জানতাম না, বুঝি নি। আমরা কপি বা নকল করছি। আত্মার নকল করা যায় না, কিন্তু দেহের, কাঠামোর নকল হয়। 

আজকে যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আমরা দেখতেছি এর সব কিছু নকল। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এমন একটা বস্তুগত বা অবস্তুগত কিছু পাবেন না যা কন্সেপচুয়াল ওয়েস্টের নকল না। এর আইনকানুন, কাঠামো, অনুষ্ঠানাদি সব নকল। একটা বিষয় নাই, যা এই দেশের প্রয়োজনে এখানে তৈরি হয়েছে। কোনো পাঠ্যসূচি বা সিলেবাস নাই যার আগাগোড়া আর একটি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচির কপি বা নকল না। 

আমাদের বিদ্যা-ব্যবস্থার সবচে বড় ত্রুটি হচ্ছে এই নকল। নকল বিদ্যা চর্চার মূল উদ্দেশ্য ব্যহত করে- এ নিয়ে কোনো তর্ক নাই। নকল করে পাশ করা যায়, বিদ্বান হওয়া যায় না। আর শিক্ষার অন্যতম উপায়-পদ্ধতি হচ্ছে নকল। সাধনী, হাতিয়ার, প্রযুক্তির নকল হয়, আত্মার নকল হয় না। আমাদের পরিষ্কার হতে হবে যে আমারা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বিদ্যালয় হিসেবে দেখতে চাই, না কি শিক্ষালয়?

বিদ্যার যে মূল উদ্দেশ্য- "আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে আমাদের চেয়ে উন্নত করে গড়ে তুলা, তাদের মধ্যে যে সম্ভাবনাগুলো আছে তাকে পরিপুষ্টি দেওয়া"- এই দর্শন যদি প্রতিষ্ঠা করতে চাই তার একটা উপায় হচ্ছে বিপ্লব, অন্যটা সংস্কার। সংশোধন না। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীকে "জন্মদিন" ঘোষণা করে আমরা যেসব অনুষ্ঠানাদির আয়োজন করি এবং তাতে তৃপ্তির যে ঢেঁকুর ওঠে এতে মনে হয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হাল অবস্থা সম্পর্কে আমরা ওয়াকিবহালই নই, সুতরাং বিশ্ববিদল্যালয়গুলোর সংস্কারের আশাও এ মুহূর্তে দূরাশামাত্র।

অন্যদিকে বাংলাভাষার আজ যে অবনম, যে অধস্তন দশা; তার সূতিকাগার ও রূপকার এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। পরের ভাষা আর পরের ভাবের ঘরে চুরি করাকে অতিস্বাভাবিক করে তুলাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সবচে বড় অপরাধ। আজকের দেশের যে সর্বগ্রাসী অধঃপতন তার অন্যতম উৎস বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এগুলো কেবল নিজেরাই নষ্ট হয়নি, এ দেশের বহু প্রতিষ্ঠান নষ্ট করে চলেছে। দুর্নীতিগ্রস্ত অক্ষম অসৎ পাচাটার আঁতুড়ঘর হয়ে উঠেছে। এর মাঝে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ব্যতিক্রম কিছু না।

Comments

The Daily Star  | English

Eid meat: Stories of sacrifice, sharing and struggle

While the well-off fulfilled their religious duty by sacrificing cows and goats, crowds of people -- less fortunate and often overlooked -- stood patiently outside gates, waiting for a small share of meat they could take home to their families

2h ago