‘রেঞ্জ কর্মকর্তার যোগসাজশে’ সংরক্ষিত বনের হাজারো গাছ উজাড়, মাটি লুট

কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত থেকে পূর্ব দিকে বন বিভাগের মহিপুর রেঞ্জের অধীন কাউয়ারচরসহ গঙ্গামতি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের আয়তন প্রায় ২০০ একর। গত কয়েক বছরে ক্রমাগত ভাঙনে এ বনভূমির ২০ থেকে ২৫ একর জায়গা ইতোমধ্যে সাগরে বিলীন হয়ে গেছে।
পটুয়াখালীর সংরক্ষিত বন
মাটির ভাঁজে ভাঁজে থেকে যাওয়া শেকড় জানান দিচ্ছে এক সময়ের ঘন বনের অস্তিত্ব। ছবি: সোহরাব হাসান/স্টার

পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত-সংলগ্ন গঙ্গামতি এলাকার সংরক্ষিত বনাঞ্চলের নানান প্রজাতির কয়েক হাজার গাছ উজাড় করে মাটি লুট করা হয়েছে। এখনো রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী স্থানীয় কয়েকজন বনের গাছ ও মাটি লুট করে চলেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। তাদের ভাষ্য, এই কাজে বন বিভাগের কলাপাড়া রেঞ্জ কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদের 'যোগসাজশ' আছে।

কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত থেকে পূর্ব দিকে বন বিভাগের মহিপুর রেঞ্জের অধীন কাউয়ারচরসহ গঙ্গামতি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের আয়তন প্রায় ২০০ একর। গত কয়েক বছরে ক্রমাগত ভাঙনে এ বনভূমির ২০ থেকে ২৫ একর জায়গা ইতোমধ্যে সাগরে বিলীন হয়ে গেছে।

এর পাশাপাশি এই সংরক্ষিত বনের তেত্রিশ কানি এলাকা থেকে কেওড়া, আকাশমনি ও বাইনসহ নানা প্রজাতির ১০ হাজারের বেশি গাছ স্থানীয় একটি চক্র কেটে নিয়েছে বলে জানাচ্ছেন এলাকাবাসী। তারা বলছেন, উজাড় করা বনের প্রায় পাঁচ একর জায়গার মাটি কেটে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে—এই কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ কর্মী আবু সালেহ ফকির।

পটুয়াখালীর সংরক্ষিত বন
মাটি কেটে নেওয়ার পর গঙ্গামতি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের তেত্রিশ কানি এলাকার চিত্র। ছবি: সোহরাব হাসান/স্টার

এখানকার বাসিন্দারা জানান, ২০০৭ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় সিডরসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঠেকাতে এই সংরক্ষিত বনাঞ্চল প্রাকৃতিক ঢাল হিসেবে কাজ করেছে। এমন পরিস্থিতিতে মানবসৃষ্ট কারণে বনের এমন নাজুক অবস্থা তাদের শঙ্কিত করে তুলেছে।

গত সোমবার দুর্গম ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, উজাড় করা বনে নির্বিচারে মাটি কাটার কারণে অনেকগুলো বড় বড় পুকুরের মতো গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। সে সময় স্থানীয় কয়েকজন দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, সাধারণত যন্ত্র চালিয়ে মাটি কাটার কাজটি রাতে করা হয়। পরে তা ট্রাকে করে নিয়ে যায় চক্রের সদস্যরা। তারা স্থানীয় আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকায় কেউ তাদের ব্যাপারে মুখ খুলতে সাহস পায় না। আবার উপজেলা প্রশাসন এখানে অভিযান চালাতে আসলে তার খবর আগেভাগেই পৌঁছে যায় চক্রের কাছে। তখন সবাই গা ঢাকা দেয়।

স্থানীয় বাসিন্দা শাকিল ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এখান থেকে কেটে নেওয়া মাটি বেড়িবাঁধ নির্মাণের কাজে যুক্ত এক ঠিকাদারের কাছে বিক্রি করা হয়েছে। অনেক স্থানীয় মানুষও এই মাটি কিনেছেন। বন বিভাগের লোকজন গাছ কাটা ও মাটি লুট ঠেকাতে তেমন কোনো ভূমিকাই রাখেনি।'

অপর বাসিন্দা হজরত আলী বলেন, 'আমরা স্থানীয়ভাবে এর প্রতিবাদ করলেও তা কোনো কাজে আসেনি। উল্টো আমাদের মামলার ভয় দেখানোর পাশাপাশি বিভিন্নভাবে হুমকি দেওয়া হয়েছে।'

ঘূর্ণিঝড় সিডরে নিজের দুই সন্তান হারানো হজরত আলী আরও বলেন, 'এভাবে যদি বন ধ্বংস হতে থাকে তাহলে ভবিষ্যতে ঝড়-বন্যাসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা তৈরি হবে।'

পটুয়াখালীর সংরক্ষিত বন
কিছুদিন আগেও এখানে কেওড়া, আকাশমনি, বাইনসহ বিভিন্ন প্রজাতির হাজারো গাছপালায় ভরা ছিল। সেই সবুজ উজাড় করে কেটে নেওয়া মাটি বিক্রি করা হয়েছে। এই লোভ-লাভের ভাগীদার ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় রাজনৈতিক কর্মী ও বনবিভাগের অসাধু কর্মকর্তারা। ছবি: সোহরাব হাসান/স্টার

স্থানীয় ধুলাসার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুর রহিম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এই সংরক্ষিত বনাঞ্চলে এক সময় অনেক গাছপালা ছিল। এসব কেটে বন উজাড় করে মাটি কাটা হয়েছে।' তবে কারা এ মাটি কেটে নিয়েছেন, সে ব্যাপারে মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।

এ ব্যাপারে বন উজাড় ও মাটি লুট চক্রের প্রধান বলে অভিযুক্ত আবু সালেহ ফকিরের বক্তব্য, তিনি এই কাজের সঙ্গে জড়িত নন। তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'স্থানীয় লোকজন জেলা প্রশাসকের অফিস থেকে বনের কিছু জমি বন্দোবস্ত নিয়েছেন। তারাই মাটি বিক্রি করছেন।'

এই কাজে সহযোগী হিসেবে নাম আসা বন বিভাগের কলাপাড়া রেঞ্জ কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ মিথ্যা ও বানোয়াট। মাটি কাটার খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গেলে দুর্বৃত্তরা আমাকে গালিগালাজের পাশাপাশি প্রাণনাশের হুমকি দেয়।'

কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মাটি লুটের সঙ্গে জড়িত চক্রটি বনের অপূরণীয় ক্ষতি করেছে। চক্রের লোকজনকে ধরতে কমপক্ষে ২০ বার অভিযান চালিয়েও আমরা ব্যর্থ হয়েছি।'

গত ১৬ অক্টোবর গভীররাতে অভিযান চালিয়ে ছয় জনকে গ্রেপ্তারের পাশাপাশি তিনটি মাটি কাটার যন্ত্র ও মাটি পরিবহনের কাজে ব্যবহৃত সাতটি ট্রাক জব্দ করা হয়েছে বলে জানান তিনি। বলেন, 'গ্রেপ্তার হওয়া প্রত্যেককে ছয় মাস করে কারাদণ্ড দেওয়ার পাশাপাশি এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এ ধরনের অভিযান চলতে থাকবে।'

পটুয়াখালী উপকূলীয় বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক মো. তরিকুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সংরক্ষিত বনাঞ্চল রক্ষায় আমরা প্রশাসনের সহযোগিতা নিয়ে অপরাধীদের থামানোর চেষ্টা করছি। ইতোমধ্যে একাধিক মামলা দায়েরসহ বেশকিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।'

Comments

The Daily Star  | English

Desire for mobile data trumps all else

As one strolls along Green Road or ventures into the depths of Karwan Bazar, he or she may come across a raucous circle formed by labourers, rickshaw-pullers, and street vendors.

14h ago