কলম ‘মায়েস্ত্রো’ মোস্তফা: ঝরনা কলম ভালোবেসে এক জীবন

ফাউন্টেন পেন

ঢাকার বায়তুল মোকাররম মার্কেটে নিজের ছোট্ট দোকানে বসে বিশেষ ধরনের একটি ঝরনা কলম 'ডেস্ক ফাউন্টেন পেন' নিয়ে কাজ করছিলেন কলম-কারিগর মোস্তফা কামাল পাশা।

এই একবিংশ শতাব্দীর প্রাত্যহিকতা থেকে ঝরনার জলের মতোই ঝরে পড়া এই কলম এক সময় ছিল আভিজাত্যের প্রতীক। বুকপকেটে পার্কার, শেফার্স কিংবা সোয়ানের মতো নামীদামি কলম দেখে কলমধারীর সামাজিক অবস্থান বুঝে নেওয়া যেত অনেকটা। কর্মক্ষেত্র, পরীক্ষার খাতা কিংবা সইসাবুদের জন্য আলাদা কলম ব্যবহারের চল ছিল। শোনা যায়, খোদ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও ছিলেন ঝরনা কলমের ভক্ত। আবার চিঠি লেখা থেকে শুরু করে দীর্ঘ উপন্যাস, ডায়েরি কিংবা কবিতা লেখার জন্য খ্যাতনামা লেখকদের বিশেষ বিশেষ ঝরনা কলম ব্যবহারের ঝোঁক নিয়েও অনেক গল্প প্রচলিত আছে।

এমন পরিস্থিতিতে প্রায় লুপ্ত এই ঐতিহ্য নিয়ে নিজেও ব্যক্তিগতভাবে আগ্রহী হওয়ার কারণে মোস্তফা কামালের কারিগরি দেখার লোভ সামলানো গেল না। কাছে গিয়ে বোঝা গেল, যে কলমটি সারাইয়ের কাজ করছিলেন মোস্তফা সেটি ছিল শেফার্স টাচডাউন মডেলের ১৪ ক্যারেট সোনার 'ট্রায়াম্ফ' নিববিশিষ্ট একটি ঝরনা কলম, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে নির্মিত হত।

ফাউন্টেন পেন

ঝরনা কলম নিয়ে আগ্রহীদের কাছে মোস্তফা পরিচিত মহব্বত মোস্তফা নামে। তিনি জানালেন, শেফার্সের এ কলমটির  টাচডাউন ফিলার আর কাজ করছে না। তাই এর পরের মডেলের কলমের একটি অ্যারোমেট্রিক ফিলার লাগিয়ে সেটা আবার ব্যবহারের উপযোগী করে তোলা যায় কিনা, সেই চেষ্টাই করছেন তিনি।

পরের দুই ঘণ্টায় প্লায়ার্স, গহনা কারিগরদের ল্যুপ, সিলিকন গ্রিজ, ছোট্ট হাতুড়িসহ বাহারি সব যন্ত্রপাতি দিয়ে টাচডাউন মডেলের কলমটিতে কালি ভরার চেষ্টা চালাতে চালাতে নিজের অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা বলতে থাকেন বিরল এই পেশায় চার দশক ধরে টিকে থাকা মোস্তফা। ধারণা করা হয়, দেশে এমন পেশায় নিযুক্ত একমাত্র ব্যক্তি এখন তিনিই।

মোস্তফার জন্ম ঢাকার কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়া গ্রামে; ১৯৬২ সালের ২৪ অগাস্ট। মানিকগঞ্জের নয়াবাড়ি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিকে উত্তীর্ণ হয়ে তিনি ভর্তি হন ঢাকার জগন্নাথ কলেজে। তবে পর পর দুইবার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ফেল করে পড়াশোনা ছেড়ে দেন তিনি। পরের কয়েক বছর বিভিন্ন পেশায় থেকে শেষ পর্যন্ত ঝরনা কলম সারাইয়ের কাজে থিতু হন।

মোস্তফা বলেন, 'তখনো বলপেন তেমন সহজলভ্য হয়নি, বলতে গেলে সবাই লেখার কাজে ঝরনা কলমই ব্যবহার করতেন। আমি নিজের ঝরনা কলম নিজেই সারাতাম। সেখান থেকেই এই কাজে আগ্রহ জন্মায় এবং পরবর্তীতে এই পেশায় আসি।'

ফাউন্টেন পেন

সে সময় এই পেশায় থাকা অন্যদের কাছ থেকে মোস্তফা অনেক কিছু শিখেছেন জানিয়েছে বলেন, 'কিছুদিন পর পর ঝরনা কলম সার্ভিসিংয়ের দরকার হতো। তাই এই পেশা তখন তেমন বিরল ছিল না।'

পরে বলপয়েন্ট সহজলভ্য হয়ে ওঠায় ধীরে ধীরে ঝরনা কলমের ব্যবহার কমে আসার কারণে এই পেশার সঙ্গে যুক্ত অনেকে অন্য কাজে যুক্ত হন। এভাবেই পেশাটি হারিয়ে যেতে থাকে।

মোস্তফা বলেন, 'আমি এই পেশায় যুক্ত হওয়ার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বলপেনে বাজার সয়লাব হয়ে যায়। সে কারণে নতুন কেউ আর এই পেশায় যুক্ত হওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী হননি। আর বয়স্কদের মধ্যে যারা ছিলেন তারাও মারা গেছেন।

মোস্তফা বলেন, 'আমি জানি না যে বর্তমানে আর কেউ এই পেশাটি ধরে রেখেছেন কিনা। আমি আমার দোকানে অন্য স্টেশনারি সামগ্রীও বিক্রি করি। কিন্তু আমার মন পড়ে থাকে ফাউন্টেন পেনের ওপর।'

মোস্তফার দীর্ঘ পেশাগত জীবনে ২০০৭ সালের একটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য। সে বছর তিনি বঙ্গভবনে গিয়ে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ইয়াজুদ্দিন আহমেদের সেন্ট ডুপন্ট কলম মেরামত করে দিয়ে এসেছিলেন। কথোপকথনের ফাঁকে এই অভিজ্ঞতার কথা জানাতে ভোলেন না তিনি।

সম্প্রতি দেশের তরুণদের মাঝে ঝরনা কলমের ব্যাপারে কিছুটা আগ্রহ তৈরি হয়েছে বলে জানান মোস্তফা। এদের মধ্যে কেউ সংগ্রাহক আবার কেউবা ঝরনা কলমের টেকসই গুণের জন্য এর কদর করেন।

ফাউন্টেন পেন

মোস্তফার ভাষ্য, যত্ন নিয়ে ব্যবহার করলে ও নিয়মিত পরিচর্যার ভেতর রাখলে একটি ভালো মানের ঝরনা কলম সারাজীবনও ব্যবহার করা যায়। সস্তার বলপয়েন্ট কলম সাধারণত প্লাস্টিকের তৈরি। কালি শেষ হয়ে গেলেই এগুলো ফেলে দিতে হয়। মানে পরিবেশের জন্যও এটা ক্ষতিকর।

ঝরনা কলমের এই কারিগর বলেন, 'আপনি একটা ভালো মানের ঝরনা কলম কিনে বছরের পর বছর ব্যবহার করতে পারবেন। এর কালির খরচও খুব বেশি নয়। কিন্তু সমস্যা হলো এই কলম ব্যবহারের কাগজ খুব সহজলভ্য নয়। তবে এখন এই ধরনের কাগজের বিক্রি ও ব্যবহার বেড়েছে। ফলে ঝরনা কলম ব্যবহারের ঝোঁকও বাড়ছে।

মোস্তফা বললেন, ব্যবহারকারী ও সংগ্রাহকরা তার কাছে বিভিন্ন ধরনের কলম সারাই করতে নিয়ে আসেন। এগুলোর বেশিরভাগ পার্কার, পাইলট ও শেফার্স। তবে কিছু ম ব্লা ও ওয়াটারম্যান কলমও মেরামত করেছেন তিনি।

কেউ এই পেশায় আসতে চাইলে তার করণীয় সম্পর্কে জানতে চাইলে মোস্তফার পরামর্শ, এই কাজের জন্য কোনো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই। শুরুতে আগ্রহীদের কলম ব্যবহার করে এতে কালি ভরার কৌশল, নিব মেরামক ও সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ শিখতে হবে। এভাবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অভিজ্ঞতা বাড়বে।

মোস্তফা বলেন, 'একটি অকেজো কলমকে আবার ব্যবহারের উপযোগী করে তুলতে পারলে আমি খুব আনন্দ পাই। এই আনন্দটুকুর জন্যই এত বছর ধরে এই পেশার মায়ায় পড়ে আছি। জীবনে অনেক কলম সারিয়েছি। কিন্তু মনে হয় এখনো অনেক কিছু শিখিনি। সত্যি বলতে ঝরনা কলমের পরিসরটাই অনেক বড়।'

ফাউন্টেন পেন

মোস্তফার প্রত্যাশা, অন্তত শখের বশে হলেও অনেকে ঝরনা কলম ব্যবহার করবেন। কারণ, এই কলম দিয়ে লেখার অনুভূতি অসাধারণ। কেউ যদি নিজের হাতের লেখার উন্নতি করতে চান। তাহলে এর জন্য ঝরনা কলম ব্যবহারের বিকল্প নেই।

কথোপকথনের ভেতরেই শেফার্স কলমটি মেরামতের কাজ শেষ করে আনেন মোস্তফা। প্রথমে সেটাতে তিনি পানি ভরে দেখে নিলেন যে এটা ঠিকঠাক কাজ করছে কিনা। পরে ওয়াটারম্যানের নিল কালি ভরে কাগজে কিছু লেখালেখিও করলেন। বললেন, 'এই যে কলমটি আবার ঠিক হয়ে গেছে!'

এ সময় মোস্তফার মুখে আনন্দের যে দীপ্তি খেলে গেল, তাতে বোঝা গেল কেন সবকিছু ছেড়ে এই পেশাকেই আঁকড়ে রেখেছেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

JP central office vandalised, set ablaze

A group of unidentified people set fire to the central office of Jatiyo Party in Dhaka's Kakrail area this evening

1h ago