পাবনার মেয়ে সুচিত্রা যেভাবে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় সুপারস্টার হলেন

পারিবারিক নাম রমা দাশগুপ্ত অথবা 'প্রাচ্যের গ্রেটা গার্বো'- যে নামেই ডাকা হোক না কেন, সুচিত্রা সেন এখনও অসাধারণ অভিনয় ও মাধুর্যে ঘেরা এক রহস্যময় ব্যক্তিত্বই রয়ে গেছেন। বড়পর্দায় ও নিজের ব্যক্তিজীবনে যেভাবে বাঙালি নারীত্ববোধ ও লাবণ্য ফুটিয়ে তুলেছেন, তা তাকে নিয়ে গেছে অন্য উচ্চতায়।

পঞ্চাশের দশকে স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতের সিনেমাজগতে পশ্চিমা ধ্যানধারণা ও আধুনিকতার ছোঁয়ায় ব্যাপক সাংস্কৃতিক পরিবর্তন এসেছিল। নতুন দেশে এই পরিবর্তনের মধ্যে অভিনেতারাও যেখানে তারকাখ্যাতি পেতে হিমশিম খাচ্ছিলেন, সুচিত্রা সেখানে নিজের লাবণ্য, সৌন্দর্য ও অনবদ্য অভিনয় দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন একজন সুপারস্টার হিসেবে। ১৯৫৫ সালে শরৎচন্দ্রের 'দেবদাস' উপন্যাস অবলম্বনে বিমল রায়ের হিন্দি ক্ল্যাসিক 'দেবদাস' এ দিলীপ কুমারের বিপরীতে 'পারো' চরিত্রে অভিনয় করে জাতীয় পুরস্কার অর্জন করেন তিনি।

১৯৫২ সালে 'শেষ কোথায়' এর মাধ্যমে চলচ্চিত্র জগতে যাত্রা শুরু করেন সুচিত্রা সেন, তবে এই সিনেমাটি আজও মুক্তি পায়নি। পরবর্তীতে 'আঁধি', 'সাত পাকে বাঁধা', 'অগ্নিপরীক্ষা', 'সপ্তপদী', 'দ্বীপ জ্বেলে যাই' এর মতো সিনেমা ও মহানায়ক উত্তম কুমারের সাথে অমর জুটি তাকে করে তুলেছে চলচ্চিত্রের আইকন।

ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে সুচিত্রা সেন বাংলা সিনেমার প্রতিমূর্তি হয়ে আছেন। বর্ণিল ক্যারিয়ারে অসংখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন, মেধা ও শৈল্পিক মননের মিশেলে প্রতিটি চরিত্রকে সূক্ষ্ণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। সাবলীলভাবে চরিত্রের জটিল দিকগুলো তুলে ধরে নিজ যোগ্যতায় হয়েছেন সুপারস্টার।

১৯৬০ এর দশকে চলচ্চিত্র নির্মাতা ও অভিনেতারা মুখিয়ে থাকতেন তার সাথে কাজ করার জন্য। কাজের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ সুচিত্রা ছিলেন একজন 'পারফেকশনিস্ট'। আড়ম্বরতা ও মাধুর্য দিয়ে নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তোলা প্রতিটি চরিত্রের প্রতি সুবিচার করেছেন। তার ভুবন ভোলানো হাসি মুহুর্তেই দর্শকদের মুগ্ধ করত। নান্দনিকতা ও সুচারু অভিনয়ের জন্য বিখ্যাত এই অভিনয়শিল্পী অনেক নামীদামী নির্মাতাদের সাথে কাজের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।

সিনেমা, পরিচালক ও সহ-অভিনেতা বাছাইয়ের ব্যাপারে ছিলেন কিছুটা খুঁতখুঁতে। তবে কারও সাথে কাজের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়ার পেছনে ছিল তার অকাট্য যুক্তি, যা তার নারীবাদী ব্যক্তিত্বের পরিচয় দেয়। তার এই ব্যক্তিত্ব সে যুগের অনেক নারীকে অনুপ্রাণিত করেছে। বাংলা চলচ্চিত্রের মায়েস্ট্রো সত্যজিৎ রায়ের সাথে 'ঘরে বাইরে' ছবিতে কাজ করার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন, কারণ সত্যজিৎ এর শর্ত ছিল তার ছবির কাজ করার সময় অন্য কারও ছবিতে কাজ করতে পারবেন না সুচিত্রা। কিন্তু সুচিত্রার হাতে তখন বেশ কিছু ছবির কাজ।

আত্মপ্রত্যয়ী ও অবিচল সুচিত্রা হিন্দি সিনেমার পথিকৃৎ রাজ কাপুরের সাথে কাজের প্রস্তাবও ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, কারণ রাজ কাপুরের ব্যক্তিত্ব ভালো লাগেনি তার। সুচিত্রাকে মুগ্ধ করার চেষ্টায় রাজ কাপুর এমন এক কাজ করেন যাতে বিরক্ত হয়েছিলেন তিনি।

অমিতাভ চৌধুরীর লেখা স্মৃতিকথা 'আমার বন্ধু সুচিত্রা সেন' এ সুচিত্রা বলেন, 'আমি পুরুষদের মধ্যে সৌন্দর্য খুঁজি না, বুদ্ধিমত্তা ও তীক্ষ্ণ কথোপকথন খুঁজি। সাথে সাথেই রাজ কাপুরের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। তার ছবিতে নায়িকা হওয়ার প্রস্তাব নিয়ে তিনি আমার বাড়িতে আসেন। আমি যখন বসলাম, তিনি হঠাৎ আমার পায়ের কাছে বসে পড়েন, ছবির প্রস্তাব দেয়ার সময় এক তোড়া গোলাপও দেন। আমি তার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেই। তার ব্যক্তিত্ব আমার ভালো লাগেনি। তিনি যে আচরণ করেছেন- আমার পায়ের কাছে বসে পড়েছেন- তা একজন পুরুষকে মানায় না।' এভাবেই তিনি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন ভারতীয় চলচ্চিত্রের শ্রেষ্ঠ 'শোম্যান' কে। তিনি সুচিত্রা সেন বলেই এ কাজ করতে পেরেছিলেন।

পরিচিতদের স্মৃতিচারণে দুর্দান্ত এই অভিনেত্রীকে বিচক্ষণ ও জেদি মনে হলেও, তিনি আদতে একজন ভদ্র, বিনয়ী ও আন্তরিক একজন মানুষ ছিলেন। নিয়মিত বাড়িতে অতিথি নিমন্ত্রণ করতেন, নিজ হাতে রান্না করে খাওয়াতেন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দিতেন।

উর্দু ও হিন্দি ভাষার কিংবদন্তি লেখক, গীতিকার ও কবি গুলজার সুচিত্রার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, 'জনসম্মুখ থেকে অন্তরালে যাওয়াটা তাকে মানায়। শোবিজ এ এমন মর্যাদাপূর্ণ ব্যক্তিত্বের উদাহরণ তিনি একাই। এ কারণেই মিডিয়া তাকে গ্রেটা গার্বোর সাথে তুলনা করে।'

এক সাক্ষাৎকারে সুচিত্রার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, 'সুচিত্রা সেন আমার 'স্যার'। খুলে বলছি। আঁধির শুটিং এর সময় তিনি আমায় 'স্যার' বলে ডাকতে শুরু করেন। যেহেতু আমি তার ছোট, তাকে অনুরোধ করলাম আমাকে স্যার না ডাকতে। তিনি শুনলেন না। তাই আমি তাকে 'স্যার' ডাকি, তিনিও আমায় 'স্যার' ডাকেন।'

২৬ বছরের অনবদ্য ক্যারিয়ার শেষে, ২০১৪ সালে মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত ৩৬ বছর নিভৃতে জীবন কাটান সুচিত্রা সেন।

১৯৭৮ সালে তার ছবি 'প্রণয় পাশা' আশানুরুপ সাফল্য পায়নি, তারপর থেকেই ধীরে ধীরে চলে যান লোকচক্ষুর অন্তরালে। ২০০৫ সালে ভারতীয় চলচ্চিত্রের সর্বোচ্চ সম্মাননা 'দাদাসাহেব ফালকে' পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন তিনি, তবে জনসম্মুখে গিয়ে পুরস্কার নিতে হবে বলে তিনি পুরস্কার ফিরিয়ে দেন।

পুরোনো দিনের এই নায়িকা যখন নিজেকে লোকচক্ষুর অন্তরালে নেয়ার, অন্দরের সীমারেখায় নিজেকে আটকে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তখন তাকে ঘিরে রহস্য ও সবার কৌতূহল বেড়েছে বহুগুণ।

উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক কোনো চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কার পাওয়া প্রথম ভারতীয় অভিনেত্রী সুচিত্রা।১৯৬৩ সালে মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে 'সাত পাকে বাঁধা' ছবির জন্য পান সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার।

১৯৩১ সালের ৬ এপ্রিল পাবনা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন সুচিত্রা। তার আসল নাম রমা দাশগুপ্ত। বাবা করুণাময় দাশগুপ্ত ছিলেন সরকারি চাকরিজীবী, মা বিমলা দেবী ছিলেন গৃহিণী। ১৯৪৭ সালে শিল্পপতি দীননাথ সেনের ছেলে আদিনাথ সেনের সাথে বিয়ে হয় তার।

২০১৪ সালের ১৭ জানুয়ারি তার মৃত্যুর সাথে সমাপ্তি ঘটে বাংলা চলচ্চিত্রের সোনালি এক অধ্যায়ের। নিজের কাজের মাধ্যমে তিনি এমন এক রহস্যের ছোঁয়া রেখে গেছেন, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম এখনো হাতড়ে বেড়াচ্ছে।

দর্শকরা এখনও চেষ্টা করে যাচ্ছেন তার রহস্যঘেরা জীবনের অর্থ বুঝে উঠতে। মিষ্টি খেতে ভালোবাসতেন সুচিত্রা, বাংলাদেশি শাড়ি ছিল তার খুব পছন্দের। চলচ্চিত্রের ব্যাপারে দারুণ আগ্রহী এই অভিনেত্রী ছদ্মবেশে চষে বেড়িয়েছেন কলকাতার ব্যস্ত রাস্তা, গিয়েছেন মন্দিরে, মিষ্টি বিক্রেতাদের কাছে।

গতকাল ছিল বাংলার প্রথম নারী সুপারস্টার, নারীবাদী চেতনায় অসামান্য ব্যক্তিত্ব সুচিত্রা সেনের প্রয়াণ দিবস। যিনি নিজের ভাগ্য নিজে গড়েছেন, নারীত্ব নিয়ে প্রচলিত সংজ্ঞা ও ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেছেন।

Comments

The Daily Star  | English

Sada Pathor Looting: Admin officials, law enforcers involved

Some government officials  including members of law enforcement agencies were involved in the rampant looting of stones from Bholaganj’s Sada Pathor area, found a probe committee of the Sylhet district administration.

3h ago