সাবেক মার্কিন জেনারেলের চোখে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ২ বছর

২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রুশ বাহিনীর হামলার পর পেরিয়ে গেছে দুই বছর। এখন পর্যন্ত এই হামলা বন্ধের কোনো আভাস পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে যুদ্ধের ভবিষ্যৎ কোন দিকে গড়াচ্ছে, সে বিষয়েও সঠিক কোনো পূর্বাভাস দেওয়া যাচ্ছে না।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি এবং রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ছবি: সংগৃহীত

২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রুশ বাহিনীর হামলার পর পেরিয়ে গেছে দুই বছর। এখন পর্যন্ত এই হামলা বন্ধের কোনো আভাস পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে যুদ্ধের ভবিষ্যৎ কোন দিকে গড়াচ্ছে, সে বিষয়েও সঠিক কোনো পূর্বাভাস দেওয়া যাচ্ছে না।

যুদ্ধের এই পর্যায়ে এসে সার্বিক পরিস্থিতির কিছুটা ধারণা দিয়েছেন সাবেক সিআইএ প্রধান এবং ইরাক ও আফগানিস্তান যুদ্ধে মার্কিন বাহিনীর কমান্ডিং জেনারেল ডেভিড পেট্রাউস।

অবসরপ্রাপ্ত মার্কিন এই জেনারেলের মতে, দুই বছরে এসে ইউক্রেন যুদ্ধের মোড় ঘুরে গেছে এবং রুশ বাহিনী কিছুটা গতি পেয়েছে। যদিও রুশরা বিস্ময়করভাবে হতাহতের শিকার হয়েছে, তবে ইউক্রেন লড়াইয়ে টিকে থাকতে পারবে যদি যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সহায়তা পায়।

রাশিয়ার দখলে থাকা ইউক্রেনের প্রায় ২০ শতাংশ অঞ্চল ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। সম্প্রতি ইউক্রেনের কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ শহর আভদিভকার দখল নিয়েছে রাশিয়া। একে দীর্ঘদিন পর বড় অগ্রগতি হিসেবে দেখছে মস্কো। এখন ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী মার্কিন সামরিক সহায়তার অপেক্ষায়।

গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস জার্মানির মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে বলেছেন, ইউক্রেনের জন্য সহায়তার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন।

সেই সম্মেলন শেষে ডেভিড পেট্রাউসের সঙ্গে কথা বলেন সিএনএনের জাতীয় নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক পিটার বার্গেন।

সেসময় পিটার বার্গেন ডেভিড পেট্রাউসকে জিজ্ঞেস করেন-

ইউক্রেন যুদ্ধে কে জিতেছে?

পেট্রাউস বলেন, 'বলতে পারছি না যে, উভয় পক্ষই জিতেছে। এখনো রুশদের অর্জনই বেশি। তারা যুদ্ধে ভালো অবস্থানে আছে। ইউক্রেনীয়দের আভদিভকা থেকে সরে যেতে বাধ্য করেছে।'

'এখনো কিছু কিছু অঞ্চলের দখল নিতে রুশরা প্রচুর গোলাবারুদ ব্যবহার করছে। যুদ্ধে তাদের হতাহতের সংখ্যাও অনেক। তা সত্ত্বেও ভ্লাদিমির পুতিনকে বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন হতে দেখা যাচ্ছে না। তিনি বাহিনীতে এখনো অতিরিক্ত নিয়োগ চালিয়ে যেতে সক্ষম বলে মনে হচ্ছে।'

পশ্চিমের গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, এখনো রাশিয়ায় যুদ্ধবিরোধী কণ্ঠস্বর তেমন আওয়াজ তুলতে পারেনি, বা বড় ধরনের বিক্ষোভ দানা বাঁধেনি।

সম্প্রতি পুতিনের কট্টর সমালোচক অ্যালেক্সি নাভালনি কারাগারে মারা গেছেন। যদিও ক্রেমলিন এতে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছে। যুদ্ধের আগে ইউক্রেনে পালিয়ে যাওয়া এক রুশ হেলিকপ্টার পাইলটকে স্পেনে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পাওয়া গেছে। এ সম্পর্কেও কোনো তথ্য নেই বলে জানিয়েছে মস্কো। 

রাশিয়ান ফেডারেশন মূলত স্ট্যালিনিস্ট একনায়কত্ব ছাড়া আর কিছুই না বলে মনে করেন পেট্রাউস।

ইউক্রেন যুদ্ধের শেষ কোথায়?

যুদ্ধের প্রথম বছরে ইউক্রেনীয় বাহিনী কিয়েভ, খারকিভ, চেরনিহিভ, সুমি এবং খেরসনের যুদ্ধে জিতেছিল উল্লেখ করে সাবেক সিআইএ প্রধান জেনারেল ডেভিড পেট্রাউস বলেন, 'তবে সময়মত মার্কিন ট্যাঙ্ক না সরবরাহের কারণে জার্মানিও লেপার্ড ট্যাঙ্ক পাঠাতে বিলম্ব করে। এ ছাড়া, সেসময় ইউক্রেনের কাছে পশ্চিমের যুদ্ধ বিমানও ছিল না।'

তার মতে, যুক্তরাষ্ট্রের উচিত ইউক্রেনকে আরও দূরপাল্লার আর্মি ট্যাকটিক্যাল ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা দেওয়া। যাতে তারা রুশ-নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে দূরবর্তী লক্ষ্যবস্তুতে সঠিকভাবে আঘাত করতে পারে।

যুদ্ধের প্রথম এক বছর বা তারও বেশি সময়ে নিজেদের পুরোপুরি শক্তিমত্তা ধরে রাখতে পারেনি ইউক্রেন, যে কারণে সবদিক থেকে আরও গুছিয়ে নেওয়ার সুযোগ পেয়েছে রাশিয়া। কেননা, রাশিয়ার জনসংখ্যা ইউক্রেনের তিনগুণ বেশি ও রুশ অর্থনীতি ইউক্রেনের প্রায় ১০ গুণ বড়।

এ পর্যন্ত ইউক্রেনের সবচেয়ে বেশি সাফল্য পশ্চিম কৃষ্ণ সাগরে। যেখানে রুশ ব্ল্যাক সি ফ্লিট সম্ভবত ৩০ শতাংশ ক্ষতির মুখে পড়েছে। ইউক্রেন রাশিয়ান ব্ল্যাক সি ফ্লিটকে কৃষ্ণ সাগরের বাইরে ঠেলে দিতে সক্ষম হয়েছে। এ কারণে অধিকৃত ক্রিমিয়ার গুরুত্বপূর্ণ সেভাস্তোপলের বন্দর থেকে রুশ নৌবহরের সিংহভাগকে প্রত্যাহার করতে হয়েছে।

এর ফলে ইউক্রেন এখনো পশ্চিম কৃষ্ণ সাগর দিয়ে মিশরসহ উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোতে শস্য রপ্তানি করতে পারছে।

সম্প্রতি মার্কিন সিনেটর রন জনসন দাবি করেন, এই যুদ্ধে এক লাখ ২০ হাজার রুশ সেনা নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন দুই লাখ সেনা। বিপরীতে ইউক্রেনের ৭০ হাজার সেনা নিহত হয়েছেন। আহত সেনার সংখ্যা এক লাখ ২০ হাজারের মতো।

গত সপ্তাহে পেন্টাগনও দাবি করে—ইউক্রেন যুদ্ধে রুশ বাহিনীর হতাহতের সংখ্যা তিন লাখ ১৫ হাজার। এ দাবির বিষয়ে পেট্রাউস বলেন, 'এটি একটি গুরুতর ক্ষতি। তা সত্ত্বেও রাশিয়া তার গ্রামীণ অঞ্চল থেকে বোনাসের ঘোষণা দিয়ে সেনা নিয়োগে সক্ষম বলে মনে হচ্ছে।'

'মনে রাখবেন, পুতিন মস্কো ও সেন্ট পিটার্সবার্গের অভিজাতদের রক্ষা করছেন। যুদ্ধের বোঝা তাদের ওপর পড়ছে না। এটা অনেক বেশি পড়ছে গ্রামীণ এলাকার যুবকদের ওপর।'

তিনি মনে করেন, পুতিন এক বছর আগের চেয়ে এখন আরও ভালো অবস্থানে আছেন, এটি অবশ্যই উদ্বেগজনক। 

কিন্তু ইউক্রেন যদি যুক্তরাষ্ট্রের ৬০ বিলিয়ন ডলার সাহায্যের প্যাকেজটি পায় এবং বাহিনীতে চাহিদামতো জনবল নিয়োগ দিতে পারে, সেক্ষেত্রে মনে হয় শুধু অবস্থান ধরে রাখাই নয়, কিছু ক্ষেত্রে অগ্রগতিও পেতে পারে বলে মনে করেন এই সাবেক শীর্ষ গোয়েন্দা কর্মকর্তা।

যুদ্ধে ইউক্রেন হেরে গেলে কী হবে?

পেট্রাউস বলেন, পুতিন যে কেবল ইউক্রেনেই থামবেন না, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তবে প্রশ্ন হলো—অন্যত্র মোতায়েনের জন্য তার বাহিনীকে উজ্জীবিত করতে কতক্ষণ লাগবে? মলদোভা অবশ্যই টার্গেটে থাকবে। কেননা দেশটির ট্রান্সনিস্ট্রিয়া এলাকায় এখনো দেড় হাজার বা তার বেশি রুশ সেনা আছে। 

তবে পুতিনের মনোযোগ বাল্টিক রাষ্ট্রগুলোর দিকেও ঘুরে যেতে পারে বলে মন্তব্য করে তিনি।

তার মতে, পুতিনের সম্ভবত একটাই লক্ষ্য, জার হিসেবে তার নেতৃত্বে সোভিয়েত ইউনিয়ন বা সম্ভবত রাশিয়ান সাম্রাজ্যের যতটা সম্ভব পুনরায় একত্রিত করা।

Comments