নিমতলী থেকে সিদ্দিকবাজার: কোনো অগ্নিকাণ্ডের মামলার রায় হয়নি আজও

অগ্নিদূর্ঘটনা মামলায় দীর্ঘসূত্রিতা এবং আজও রায় না হওয়ার হিসাবে এটা কোনো ব্যতিক্রম ঘটনা নয়। শত শত মানুষের মৃত্যুর কারণ যেসব আগুনের ঘটনা, এর কোনো মামলারই রায় আজ পর্যন্ত হয়নি।
আগুনের ঘটনায় মামলা
পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টা এলাকায় আগুন নেভাচ্ছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। ছবি: স্টার ফাইল ফটো

২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টা এলাকায় ওয়াহেদ ম্যানশনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে অন্তত ৭১ জন নিহত হন।

একটি প্রাইভেটকারের গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে পাশের একটি ট্রান্সমিটারে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। ঘটনার একদিন পর ওই এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ আসিফ বাদী হয়ে চকবাজার থানায় মামলা করেন।

তদন্তের তিন বছর পর মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক আবদুল কাইয়ুমও ২০২২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ওয়াহেদ ম্যানশনের মালিক হাসান সুলতান ও তার ভাই হোসেন সুলতান সোহেলসহ আটজনকে আসামি করে চার্জশিট দাখিল করেন।

এর এক বছর পর ২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি আদালত অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন।

নয় মাসের ব্যবধানে গত বছরের ১৭ অক্টোবর মামলার অভিযোগকারী আসিফের সাক্ষ্য রেকর্ড করেন আদালত। মামলার পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য হয়েছে আগামী ২১ মার্চ।

এই মামলায় মোট ১৬৭ জনকে সাক্ষী করা হয়।

মামলার কার্যক্রমে এত দেরি হওয়ার বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মাজহারুল হক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'অভিযোগ গঠনের সময় মামলাটি অন্য আদালতে ছিল। পরে তা ঢাকার অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত-৮ এ স্থানান্তর করা হয়। এ কারণে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হতে কিছুটা সময় লাগছে।'

আগুনের ঘটনায় মামলা
রাজধানীর বনানীর এফআর টাওয়ারে আগুন থেকে বাঁচার চেষ্টা। ছবি: স্টার ফাইল ফটো

অগ্নিদূর্ঘটনা মামলায় দীর্ঘসূত্রিতা এবং আজও রায় না হওয়ার হিসাবে এটা কোনো ব্যতিক্রম ঘটনা নয়। শত শত মানুষের মৃত্যুর কারণ যেসব আগুনের ঘটনা, এর কোনো মামলারই রায় আজ পর্যন্ত হয়নি।

চুড়িহাট্টা দুর্ঘটনার নয় বছর আগে ২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলী এলাকায় মর্মান্তিক অগ্নিকাণ্ডে অন্তত ১২৪ জন নিহত হন।

এ ঘটনায় বংশাল থানায় সাধারণ ডায়েরি বা জিডি হয়েছে। কোনো তদন্ত হয়নি। তাই এত মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ীদের বিচারের সম্মুখীনও করা সম্ভব হয়নি।

আইন বিশেষজ্ঞ খুরশীদ আলম খান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কোনো ঘটনা ঘটলে আমরা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ি, কষ্ট পাই। বড় বড় ঘটনায় প্রতিবাদ হয়, মামলা হয়। কিন্তু কয়েক দিন যেতে না যেতেই আমরা ঘটনাগুলো ভুলে যাই।'

তিনি জানান, আগুনের ঘটনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে তদন্ত ত্রুটিপূর্ণ হয়। কারণ অজ্ঞাতনামাদের বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার প্রবণতা বেশি।

তিনি আরও বলেন, 'এমন ক্ষেত্রে আসামিকে দোষী সাব্যস্ত করার জন্য যথেষ্ট প্রমাণ উপস্থাপন করা হয় না। ফলে অভিযুক্তরা খালাস পেয়ে যান।'

যেসব ক্ষেত্রে বিচার শুরু হয়, সেগুলোও বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকে।

২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর তাজরিন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ডে ১১২ শ্রমিক মারা যান।

এ ঘটনায় আশুলিয়া থানায় মামলা হয়। ২০১৩ সালের ২২ ডিসেম্বর পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের পরিদর্শক একেএম মহসিন উজ্জামান খান কারখানার মালিক দেলোয়ার হোসেন, মাহমুদা আক্তার ও ১১ কর্মচারীর বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেন।

২০১৫ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর আদালত ১৩ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। আদালতের রেকর্ড অনুসারে মোট ১০৪ সাক্ষীর মধ্যে ১১ জন আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন।

আগুনের ঘটনায় মামলা
নারায়ণগঞ্জের হাসেম ফুডস কারখানায় আগুন। ছবি: স্টার ফাইল ফটো

সর্বশেষ সাক্ষীর জবানবন্দি ২০২২ সালের ১৮ মে রেকর্ড করা হয়েছে। এরপর আর কোনো সাক্ষী আদালতে আসেননি। কারখানা মালিক দেলোয়ারকে প্রথমে গ্রেপ্তার করা হলেও এখন তিনি জামিনে আছেন।

একই ঘটনা ঘটেছে ২০১৯ সালের ২৮ মার্চ এফআর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের ক্ষেত্রেও। ওই দুর্ঘটনায় অন্তত ২৫ জন মারা যান। ঘটনার দুদিন পর বনানী থানায় মামলা করে পুলিশ।

পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন গত ৪ ফেব্রুয়ারি মামলাটির চার্জশিট দাখিল করলেও এখনো বিচার শুরু হয়নি।

ঢাকা মেট্রোপলিটনের পাবলিক প্রসিকিউটর মো. আবদুল্লাহ আবু ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আগুনের ঘটনায় মৃত্যু মামলায় সাক্ষী পেতে আমরা হিমশিম খাই। অনেক সময় সাক্ষী পাওয়া যায় না। ফলে বিচার প্রক্রিয়ায় দেরি হয়ে যায়।'

তবে শিগগির বিচার শেষ করতে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন তিনি।

২০২১ সালের ১৮ জুলাই নারায়ণগঞ্জের হাসেম ফুডস কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে ৫৪ জনের মৃত্যুতে দায়ের করা হত্যা মামলার অভিযোগপত্র গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর দাখিল করে সিআইডি। অভিযোগপত্র থেকে হাসেম ফুডসের পরিচালকদের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে।

মামলার শুনানি এখনো শুরু হয়নি।

২০২১ সালের ২৭ জুন ঢাকার মগবাজার এলাকায় গ্যাস লিকেজের কারণে হওয়া বিস্ফোরণে অন্তত সাতজন নিহত হন। এটি এখন কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের (বিডিইউ) তদন্তাধীন।

গত বছরের ৮ মার্চ রাজধানীর সিদ্দিকবাজারে একটি সাততলা ভবনের বেসমেন্ট ক্যাফেতে গ্যাস লাইনের লিকেজ থেকে বিস্ফোরণে ২৫ জন নিহত এবং প্রায় ১০০ জন আহত হন।

এর একদিন পর বংশাল থানায় মামলা করা হয় এবং সিটিটিসি ইউনিটের বিডিইউ মামলার তদন্ত শুরু করে। তদন্ত আজও শেষ হয়নি।

বিডিইউ ইউনিটের প্রধান রহমত উল্লাহ চৌধুরী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'তদন্ত চলছে, আরও কিছুটা সময় লাগতে পারে।'

তিনি আরও বলেন, 'মগবাজারের মামলার অভিযোগপত্র চলতি মাসের মধ্যে দাখিল করা হবে বলে আশা করা হচ্ছে।'

অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যুর মামলার বিচার কেন হয় না?—জানতে চাইলে রহমত উল্লাহ চৌধুরী বলেন, 'আমাদের আগুন সংক্রান্ত ফরেনসিক তদন্তে দক্ষতার ঘাটতি আছে। আশাবাদী যে প্রশিক্ষণ শেষ হলে এই ধরনের মৃত্যুর মামলাগুলো আরও কার্যকরভাবে তদন্ত করা যাবে।'

Comments

The Daily Star  | English

Commuters suffer as heavy rain inundates parts of Dhaka

The Meteorological Department recorded 87 millimetres rain between 6:00am and 9:00am and thunderstorm [Kalbaishakhi] at 52 kilometres per hour

28m ago