বুয়েট প্রশাসন দায়িত্ব পালনে ‘ব্যর্থ’, আন্দোলন চলবে

ছবি: সুচিস্মিতা তিথি/স্টার

মধ্যরাতে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের প্রবেশের ঘটনায় দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার অভিযোগ তুলে ছাত্রকল্যাণ পরিদপ্তরের পরিচালক দায়িত্বপ্রাপ্ত অধ্যাপক মিজানুর রহমানের অপসারণের দাবি জানিয়েছে শিক্ষার্থীরা।

আজ শনিবার সকাল থেকে ছয় দফা দাবিতে উত্তাল ছিল বুয়েট ক্যাম্পাস। শুরুতে ক্যাম্পাসের শহীদ মিনারের সামনে, পরে প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান নেন শিক্ষার্থীরা। দুপুর ২টা পর্যন্ত প্রশাসনিক ভবনের সামনে তারা অবস্থান করেন। আজ ও আগামীকাল টার্ম ফাইনালসহ সব একাডেমিক কার্যক্রম বর্জনের ঘোষণা করেছেন শিক্ষার্থীরা।

আবরার ফাহাদ হত্যার পর বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়। ওই ঘটনার প্রায় সাড়ে চার বছর পর বুধবার মধ্যরাতে ছাত্রলীগের বহিরাগত নেতাকর্মীরা ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে।

শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাত দেড়টায় বুয়েটের মূল ফটক দিয়ে মোটরসাইকেল ও গাড়ি নিয়ে ক্যাম্পাসে ঢোকেন ছাত্রলীগের অন্তত ৭০-৮০ জন নেতাকর্মী। ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেনও সেখানে ছিলেন। তারা ক্যাফেটেরিয়ার সেমিনার কক্ষে বৈঠক করেন, সেখানে খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন ছিল। মোটরসাইকেল, গাড়ি নিয়ে দীর্ঘসময় ধরে ক্যাম্পাসে 'শোডাউন' করেছেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।

বুয়েট কর্তৃপক্ষের নিয়ম অনুযায়ী, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার জন্য রাত সাড়ে ১০টার পর ক্যাম্পাসে থাকা নিষেধ। এর পর ক্যাম্পাসে অবস্থান করতে হলে শিক্ষার্থীদের ছাত্রকল্যাণ পরিদপ্তরের পরিচালকের অনুমতি দেওয়ার বিধান আছে।

শিক্ষার্থীরা বলছেন, কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া রাত দেড়টায় ক্যাম্পাসে এসে সেমিনার রুমে ভুরিভোজের আয়োজন ও বৈঠক করা সম্ভব না। যদি বহিরাগতরা অনুমতি ছাড়াই প্রবেশ করে থাকে তাহলে এর অর্থ হলো ডিএসডব্লিউ (ছাত্রকল্যাণ পরিদপ্তর) দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। আর যদি অনুমতি দেওয়া হয়ে থাকে তাহলে তা বুয়েটের রেজিস্ট্রার অফিস থেকে দেওয়া 'বুয়েটে সকল প্রকার রাজনৈতিক সংগঠন এবং কার্যক্রম নিষিদ্ধ'—এই ঘোষণার লঙ্ঘন।

এসব কারণ উল্লেখ করে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ ডিএসডব্লিউর দ্রুততম সময়ের মধ্যে অপসারণ চেয়েছেন শিক্ষার্থীরা।

বুয়েটের এক শিক্ষার্থী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ডিএসডাব্লিউ স্যারকে যখন আমরা জিজ্ঞেস করেছি তিনি বলেছেন, তিনি কিছুই জানতেন না। কিন্তু কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতারা ক্যাম্পাসে ঢুকে প্রোগ্রাম করেছে এটা তো হতেই পারে না।'

এ ব্যাপারে জানতে ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ব্যস্ততা দেখিয়ে পরে কথা বলবেন বলে জানান।

গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মুখে পুরকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী ইমতিয়াজ হোসেনের হলের সিট বাতিল করে বুয়েট প্রশাসন।

শিক্ষার্থীরা বলছেন, ইমতিয়াজ হোসেন ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক সমাগমের মূল সংগঠক। তিনি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য।

এছাড়া ছবি ও ভিডিও ফুটেজ থেকে বুয়েটের আরও যে শিক্ষার্থীরা সেখানে ছিল তাদের একাংশকে চিহ্নিত করে তাদের নাম-পরিচয় প্রকাশ করেছে আন্দোলনকারীরা।

তাদের অভিযোগ, সেদিন ইমতিয়াজের সঙ্গে ছিলেন এ. এস. এম. আনাস ফেরদৌস, মোহাম্মদ হাসিন আরমান নিহাল, অনিরুদ্ধ মজুমদার, জাহিরুল ইসলাম ইমন এবং সায়েম মাহমুদ সাজেদিন রিফাত।

নিয়মভঙ্গের দায়ে তাদের প্রত্যেককে বুয়েট থেকে স্থায়ীভাবে বহিস্কারের দাবি জানিয়েছে শিক্ষার্থীরা।

এ বিষয়ে বুয়েটের এক শিক্ষার্থী বলেন, 'ইমতিয়াজ ওই ছাত্র সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। এর আগে শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদের মুখে ক্যাম্পাসের অরাজনৈতিক পরিবেশ অক্ষুণ্ণ রাখতে সে তার পদ থেকে অব্যাহতি নেবে বলে জানালেও সে তা করেনি। বরং প্রকাশ্যে রাজনৈতিক চর্চা চলমান রেখেছে। সে রাতে বহিরাগতদের ক্যাম্পাসে প্রবেশ করানো, গার্ডদের সঙ্গে কথা বলা, রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের সাথে সাক্ষাৎ, তাদের গাড়ি বের করানো কিংবা প্রবেশ করানো এই সবকিছুতে সে সক্রিয় ভূমিকায় ছিল। শুধু হল সিট বাতিল করলে হবে না আমরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তার বহিষ্কার চাই এবং বুয়েটের অন্য যারা সেখানে ছিল তাদেরও বহিষ্কার চাই।'

পাশাপাশি তাদের বাইরে আরও কেউ সেখানে ছিল কি না তা খুঁজে বের করে ব্যবস্থা নিতে বুয়েট প্রশাসনের কাছে দাবি জানানো হয়। এছাড়া, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে কোনো রকম হয়রানিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না এই মর্মে প্রশাসনের কাছে লিখিত প্রতিশ্রুতিও দাবি করেন শিক্ষার্থীরা।

এদিকে আন্দোলনের মুখে আজ শনিবার দুপুরে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেছেন উপাচার্য অধ্যাপক সত্য প্রসাদ মজুমদার। তিনি ক্যাম্পাসে প্রবেশ করায় ছাত্রলীগের সমালোচনা করেন। উপাচার্য বলেন, 'গভীর রাতে কেউ (ক্যাম্পাসে) ঢুকলে এটা অবশ্যই অনিয়মতান্ত্রিক। যদি কোনো নিরাপত্তারক্ষী বহিরাগত ব্যক্তিদের ঢুকতে দিয়ে থাকেন, তার বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নেব। আর কে কে ঢুকেছে, তাদের তো আগে চিহ্নিত করতে হবে। চিহ্নিত না করে তো শাস্তি দেওয়া যাবে না। তার জন্য সময় প্রয়োজন।'

উপাচার্য আরও বলেন, 'পুরো ঘটনা তদন্ত করে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইতিমধ্যে ৬ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। আগামী ৮ এপ্রিলের মধ্যে তদন্ত কমিটিকে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।'

বুয়েটের ছাত্রকল্যাণ পরিদপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক মিজানুর রহমানের (ডিএসডব্লিউ) পদত্যাগের দাবি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'এটা নিয়ম মেনে ব্যবস্থা হবে। তদন্ত কমিটি খতিয়ে দেখবে। ডিএসডব্লিউ বলেছেন, তার পক্ষ থেকে কোনো গাফিলতি ছিল না। শিক্ষার্থীরা দাবি করতেই পারে, কিন্তু দাবির মুখে আমরা ব্যবস্থা নিতে পারি না।'

আজ দ্বিতীয় দিনের কর্মসূচি শেষে আগামীকাল সকাল ৭টা থেকে আবারও বুয়েট শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে অবস্থান কর্মসূচি চলবে বলে শিক্ষার্থীরা জানান।

শিক্ষার্থীদের শঙ্কা

২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর বুয়েটের ইলেকট্রিক অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবরার ফাহাদের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। আবরারের বাবা বরকত উল্লাহ বাদী হয়ে রাজধানীর চকবাজার থানায় বুয়েট শাখার ছাত্রলীগের ১৯ জন নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় অজ্ঞাতনামা আরও অনেক জনকে আসামি করা হয়।

প্রতিবাদের মুখে ৭ অক্টোবর সংগঠনের শৃঙ্খলা ভাঙার অভিযোগে সাধারণ সম্পাদক রাসেলসহ বুয়েট শাখার ১১ নেতা-কর্মীকে বহিষ্কার করে ছাত্রলীগ। একই অভিযোগে ১৪ অক্টোবর অমিত ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কৃত হন।

১১ অক্টোবর বুয়েট প্রশাসন ক্যাম্পাসে সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করে। ২১ নভেম্বর হত্যা মামলায় সংশ্লিষ্টতা থাকার অভিযোগে ২৫ শিক্ষার্থী বুয়েট থেকে বহিষ্কার করা হয়। তাদের অধিকাংশই বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী।

তবে শিক্ষার্থীদের আশঙ্কা, প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদদে ক্যাম্পাসে বারবার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালানোর চেষ্টা করছে ছাত্রলীগ।

এ বিষয়ে বুয়েটের এক শিক্ষার্থী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে বুয়েট শিক্ষার্থীদের পদ দেওয়া হচ্ছে। এর বিরুদ্ধে দুই বছর আগেও আমরা আন্দোলন করেছি। তখন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে, ক্যাম্পাসের বাইরে কেউ রাজনীতি করলে সেটা তার ব্যক্তিগত বিষয়। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, কেন্দ্রীয় ছাত্রনেতারা সেসব সদস্যদের মাধ্যমে ক্যাম্পাসে ঢুকে বৈঠক করছে। ছাত্রলীগ বুয়েটে আবার সক্রিয় হতে চেষ্টা করছে এবং প্রশাসনও তাদের পক্ষেই ভূমিকা রাখছে। এটি দুঃখজনক।'

Comments

The Daily Star  | English
cyber security act

A law that gagged

Some made a differing comment, some drew a political cartoon and some made a joke online – and they all ended up in jail, in some cases for months. This is how the Digital Security Act (DSA) and later the Cyber Security Act (CSA) were used to gag freedom of expression and freedom of the press.

5h ago