জমানো টাকা কোথায় বিনিয়োগ করবেন?

টাকা বিনিয়োগ
অর্থ সংকটের কারণে ব্যাংকগুলোর জন্য গ্রাহকের আমানত রাখা ব্যয়বহুল হয়ে উঠেছে। তহবিল টানতে প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাধ্য হয়ে সুদের হার বাড়াতে হয়েছে। ছবি: এমরান হোসেন/স্টার

দেশে গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষ প্রতিদিনের খরচ মেটাতেই হিমশিম খাচ্ছেন। এমন চরম পরিস্থিতিতে যারা অল্পকিছু সঞ্চয় করতে পারছেন, তারা সেই কষ্টার্জিত টাকা যথাযথভাবে বিনিয়োগের চেষ্টা করছেন।

দুর্ভাগ্য যে, টাকা বিনিয়োগের সুযোগগুলো সবার জানা নেই। অনেকে আবার তাদের টাকা কোথায় কীভাবে বিনিয়োগ করবেন তা জানেন না।

দেশে বিনিয়োগের জনপ্রিয় ক্ষেত্রগুলো হচ্ছে—পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ, জাতীয় সঞ্চয়পত্র, জমি ও স্বর্ণ কেনা, এবং ব্যাংক ও ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানে টাকা জমা রাখা। বেশি সুদ পাওয়া যায় বলে সম্প্রতি ব্যাংকে আমানত রাখার পাশাপাশি সরকারি ট্রেজারি বিল ও বন্ড কেনাও বেশ আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে।

আগে সঞ্চয়পত্রে বেশি সুদ পাওয়া যেত। ইদানিং ব্যাংকগুলো উচ্চ মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেওয়া সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির কারণে বেশি সুদ দিচ্ছে। গত বছরের মার্চ থেকে নয় শতাংশের ওপরে থাকা মূল্যস্ফীতি গত ফেব্রুয়ারিতে ছিল নয় দশমিক ৬৭ শতাংশ।

অর্থ সংকটের কারণে ব্যাংকগুলোর জন্য গ্রাহকের আমানত রাখা ব্যয়বহুল হয়ে উঠেছে। তহবিল টানতে প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাধ্য হয়ে সুদের হার বাড়াতে হয়েছে।

ব্যাংকে টাকা রাখা

গত বছর ঋণ ও আমানতের সুদের হারের ঊর্ধ্বসীমা তুলে নেওয়ায় ব্যাংক বা ব্যাংক বহির্ভূত প্রতিষ্ঠানে টাকা রাখা বেশ আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। গত বছরের জুনে বাংলাদেশ ব্যাংক নয় শতাংশ সুদহারের ঊর্ধ্বসীমা তুলে নতুন সুদহারের নীতি চালু করে।

২০২১ সালের আগস্টে আরোপিত আমানতের সুদের হারের ঊর্ধ্বসীমা গত ডিসেম্বরে তুলে নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মূল্যস্ফীতির ধাক্কা সামলাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার বাড়িয়ে দেয়। ফলে, ব্যাংকে টাকা রাখার হার বেড়ে যায়।

টাকা বিনিয়োগ
আমানতের ওপর সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় মানুষ এখন ব্যাংকে টাকা রাখছেন বলে জানিয়েছেন বিশ্লেষকরা। ছবি: এমরান হোসেন/স্টার

বেশিরভাগ ব্যাংক এখন মেয়াদি আমানতে নয় শতাংশের বেশি সুদ দিচ্ছে। কয়েক মাস আগেও তা ছিল পাঁচ শতাংশেরও কম। ঋণের সুদের হারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছে আমানতের সুদহার।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, গত জানুয়ারিতে ব্যাংকে রাখা টাকার ওপর গড় সুদহার ছিল সাত দশমিক ৬২ শতাংশ। গত বছরের ডিসেম্বরে তা ছিল সাত দশমিক ৪২ শতাংশ।

গত জানুয়ারিতে এবি ব্যাংকের প্রস্তাবিত সুদের হার ছিল আট দশমিক ১৯ শতাংশ। এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের আট দশমিক ৯৬ শতাংশ ও ঢাকা ব্যাংকের আট দশমিক ১৭ শতাংশ।

ব্যাংক কর্মকর্তাদের মতে, সরকারের সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির কারণে জমা রাখা টাকার ওপর সুদ বেশি হওয়ায় ঋণের ওপর সুদহার বাড়াতে হচ্ছে।

ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিস এ খান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমানতের ওপর সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় মানুষ এখন ব্যাংকে টাকা রাখছেন।'

তিনি মনে করেন, আমানতের সুদহার বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকিং ব্যবস্থার বাইরে টাকা কমে আসছে।

সরকারি ট্রেজারি বিল ও বন্ড

টি-বিল ও টি-বন্ড নামে পরিচিত সরকারি ট্রেজারি বিল ও বন্ড বিনিয়োগকারীদের জন্য লাভজনক হয়ে উঠেছে। এখানে সবচেয়ে বেশি সুদ দেওয়া হয়। সব ধরনের ট্রেজারি বিলের সুদের রেকর্ড ১১ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। এটি ব্যাংক আমানতের সুদের হারের তুলনায় অনেক বেশি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারকে ঋণ দেওয়া বন্ধ করে দেওয়ার পর আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের কাছ থেকে সরকারের অভ্যন্তরীণ ঋণ বেড়েছে। ৯১ দিনের ট্রেজারি বিলের সুদ বর্তমানে ১১ দশমিক ৩৫ শতাংশ, ১৮২ দিনের বিলের সুদ ১১ দশমিক ৪০ শতাংশ ও ৩৬৪ দিনের বিলের সুদ ১১ দশমিক ৬০ শতাংশ।

গত বছরের জুনে এগুলো ছিল যথাক্রমে ছয় দশমিক ৯৫ শতাংশ, সাত দশমিক ২৫ শতাংশ ও আট দশমিক ৩০ শতাংশ।

ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমরানুল হক ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সুদহার বেড়ে যাওয়ায় ট্রেজারি বিল ও বন্ডে মানুষের বিনিয়োগ বাড়ছে। এই সুদের হার ব্যাংকের দেওয়া সুদের চেয়ে বেশি।'

তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, 'ব্যক্তি ও কর্পোরেট আমানতকারীরা সরকারি সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ করে মাত্র ৯১ দিনে ১১ শতাংশের বেশি সুদ পান।'

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যেহেতু বিনিয়োগকারীরা টি-বিল ও টি-বন্ডের দিকে ঝুঁকছেন, তাই ব্যাংকগুলোর টাকা পাওয়া কঠিন হবে। অনেকে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে ট্রেজারি বিলে বিনিয়োগ করছেন। কারণ সেখানে সুদের হার ব্যাংকের সুদের হারের তুলনায় দুই শতাংশ পয়েন্ট বেশি।'

টাকা বিনিয়োগ
অনেকের মতে আবাসনে বিনিয়োগ একটি ভালো উপায়। ছবি: এমরান হোসেন/স্টার

ট্রেজারি বিলে বিনিয়োগ করতে পারেন কারা?

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগের কারণে দেশের যে কেউ সহজেই ট্রেজারি বিলে টাকা রাখতে পারেন। বর্তমানে ৯১ দিন, ১৮২ দিন ও ৩৬৪ দিনের মেয়াদের ট্রেজারি বিলগুলো বেশি জনপ্রিয়।

টি-বিলের মূল দাম একাধিক নিলামের মাধ্যমে জারি করা হয়। খুচরা বিনিয়োগকারীরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্থানীয় অফিস, বাণিজ্যিক ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউস থেকে এগুলো কিনতে পারেন। বিনিয়োগের সর্বনিম্ন সীমা এক লাখ টাকা নির্ধারণ করা হলেও সর্বোচ্চ সীমা বলা হয়নি।

ট্রেজারি বিল সরকার জারি করায় এখানে বিনিয়োগকে ঝুঁকিমুক্ত হিসেবে দেখা হয়। কারণ, বাংলাদেশ কখনো ঋণ পরিশোধে খেলাপি হয়নি। মূল টাকা ও মুনাফা বা সুদ মেয়াদপূর্তির পর দেওয়া হয়।

পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ

কোনো প্রতিষ্ঠানের শেয়ার কেনা বিশ্বব্যাপী বিনিয়োগের একটি জনপ্রিয় ক্ষেত্র। ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ৬০ শতাংশের বেশি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেছেন। দেশে এই হার প্রায় এক শতাংশ।

একটি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার কিনে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তা ধরে রেখে একজন বিনিয়োগকারী অর্থবছরের শেষে শেয়ার ও নগদ লভ্যাংশ পেয়ে থাকেন।

পাসপোর্ট বা জাতীয় পরিচয়পত্র ও ব্যাংক অ্যাকাউন্টধারীরা যেকোনো পরিমাণ অর্থ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে পারেন। তাদের দরকার ব্রোকারেজ হাউসে বিও (বেনিফিশিয়ারি মালিকের) অ্যাকাউন্ট।

পুঁজিবাজার দেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলেও এটি টাকার স্বল্পতা, দুর্বল সুশাসন, বিনিয়োগকারীদের আস্থার অভাব ও দুর্বল বাজার অবকাঠামোসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত।

সঞ্চয়পত্র

বেশি সুদ দেওয়ায় সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ লাভজনক। ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত সঞ্চয়পত্র ছিল সরকারের অভ্যন্তরীণ অর্থ সংগ্রহের প্রাথমিক উৎস। তাই বিনিয়োগের ক্ষেত্র হিসেবে এটি জনপ্রিয় হয়েছিল।

বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিযোগিতামূলক সুদের হার কম ও সঞ্চয়পত্র ইস্যুতে কঠোর নিয়মের কারণে চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমেছে।

চার ধরনের সঞ্চয়পত্রে ভিন্ন ভিন্ন হারে সুদ দেওয়া হয়। সর্বোচ্চ হার ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ। সাধারণত অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, আধা-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও মৃত কর্মচারীদের পরিবারের সদস্যরাই এখানে বিনিয়োগ করতে পারেন। সবাই সঞ্চয়পত্র কিনতে পারলেও সরকারের কঠোর নিয়মের কারণে তা সবার জন্য সম্ভব হয়ে উঠছে না।

নানান নিয়মনীতি ও খরচের চাপে সঞ্চয়পত্রে নতুন বিনিয়োগের তুলনায় মানুষ বেশি পরিমাণে তুলে ফেলছেন। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সঞ্চয়পত্রের সর্বনিম্ন বিক্রির পরিমাণ ছিল নেতিবাচক আট হাজার ৮৯১ কোটি টাকা। এটি গত অর্থবছরের একই সময়ে তা ছিল তিন হাজার ৫০৯ কোটি টাকা।

জমি কেনা

বিনিয়োগের অনেক বিকল্প আছে। তবে এ ধরনের বিনিয়োগ নিরাপদ হওয়ায় দেশে অনেকের জন্য আবাসনে বিনিয়োগ লাভজনক। ঘনবসতিপূর্ণ হওয়ায় দেশে আবাসন সবচেয়ে জরুরি। নগরায়ণের সঙ্গে সঙ্গে জমি কমে যাওয়ায় এর দাম ক্রমাগত বেড়েই চলছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আবাসনে বিনিয়োগ একটি ভালো উপায়। যেহেতু দেশে দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে, তাই আবাসনে বিনিয়োগ খুব লাভজনক হয়ে থাকবে।

ঝুঁকি এড়াতে যা জানা দরকার

ঝুঁকি এড়াতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রগুলো সম্পর্কে সঠিক তথ্য নেওয়া জরুরি। বিনিয়োগকারীদের বিকল্প পথগুলোও দেখতে হবে। ঝুঁকি কমানোসহ অন্যান্য কারণগুলো চিহ্নিত করতে হবে।

ট্রাস্ট ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুক মঈনুদ্দিন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সঞ্চয়কারীদের বিনিয়োগের আগে ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সূচক সম্পর্কেও জানতে হবে।'

সঞ্চয়কারীরা যদি হিসাব-নিকাশ বোঝেন, তাহলে তারা ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করতে পারবেন। খেলাপি ঋণের অনুপাত, মূলধন পর্যাপ্ততা এবং লোকসান ও মুনাফার ভারসাম্য দেখে তারা টাকা বিনিয়োগ করতে পারবেন। সঞ্চয়কারীরা যদি হিসাব-নিকাশ না বোঝেন, তাহলে তাদের উচিত পেশাদারদের পরামর্শ নেওয়া।

'শুধু বেশি সুদ পাওয়া যাচ্ছে বলে টাকা বিনিয়োগ করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না' উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'কেননা, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দুর্বল প্রতিষ্ঠানগুলো সবচেয়ে বেশি সুদ দিয়ে থাকে।'

Comments

The Daily Star  | English
Kamal Hossain calls for protecting nation

Kamal Hossain urges vigilance against obstacles to nation-building effort

"The main goal of the freedom — gained through the great Liberation War — was to establish democracy, justice, human rights and build a society free from exploitation. But we have failed to achieve that in the last 54 years," says Dr Kamal

1h ago