শ্রদ্ধা

রনো ভাই  দীর্ঘদিন বাঁচতে চেয়েছিলেন

ছবি: সংগৃহীত

রনো ভাই চলেই গেলেন, মৃত্যু আর তাকে ছাড় দেয়নি। ব্যক্তি মানুষের শরীরী জীবন নিয়ে আরও দীর্ঘদিন বাঁচতে চেয়েছিলেন তিনি। অক্সিজেন মাস্ক পরে দুর্বিষহ সময়ের সঙ্গে লড়াই করে গেছেন একাকী। ব্যক্তির এই যন্ত্রণার ভাগ হয় না। বাঁচার জন্য ব্যক্তি মানুষের এই লড়াই শ্রেণিযুদ্ধের চেয়েও ভয়ঙ্কর।

কেননা এই যুদ্ধে শ্রেণির কোনো কমরেড থাকেন না, একেবারে একাকী যুদ্ধ। একদিন নয়, দু'দিন নয়, মাস এবং বছরের পর বছর। প্রশ্ন তা নয়, আসল প্রশ্নটা হচ্ছে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী মহলে রনো ভাইয়ের রাজনৈতিক জীবনের বাইরে তাঁর শিল্পসত্তা নিয়ে। রনো ভাই একজন বিরল প্রজাতির রাজনৈতিক সাহিত্যের মহান কারিগর। মার্কসবাদী রাজনীতির ওপর অসংখ্য বই লিখেছেন তিনি। আমার বিশ্বাস যদি ভুল না হয় তবে দাবি করা চলে বাংলাদেশে প্রগতিশীল তথা মার্কস বিষয়ক বই লেখার ক্ষেত্রে তাঁর বিকল্প কেউ নেই।

এটাও আশ্চর্য যে, বাঙালি বুদ্ধিজীবী সমাজ হায়দার আকবর খান রনোর মেধা এবং শ্রমকে অজ্ঞাত কোনো কারণে উচ্চারণ করতে দ্বিধা করে গেছেন। তাঁর বই নিয়ে পাঠক সমাজকে জানান দিতে খুব সামান্যই লেখা হয়েছে। হয়তো তেমন কিছু লেখা হয়নি। এমনটা কেনো হলো? বুদ্ধিজীবী বিষয়ক ঈর্ষা? ভুল হলে এই বাক্য উচ্চারণের জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী। রনো ভাইয়ের পাঠক সমাজ যে 'জনপ্রিয়' বইয়ের পঙ্গপাল পাঠকদের মতো অগুণতি তা বলা যাবে না। একটি বইয়ের প্রচারের দায় কেবল প্রকাশকের নয়, সতীর্থ লেখকদেরও। সেই দায় কেউ গ্রহণ করেননি।

রনো ভাই একাত্তরের যুদ্ধে (অবশ্যই শ্রেণি যুদ্ধে) আমার জন্ম মাটি পলাশ, শিবপুর, নরসিংদী, মনোহরদি অঞ্চলে ছিলেন মান্নান ভূঁইয়ার সঙ্গে। সঙ্গী ছিলেন অনুজ হায়দার আনোয়ার খান জুনো। এই লেখা (ক্ষুদ্র) রনো ভাইয়ের রাজনৈতিক জীবনের বিশাল পটভূমিতে ঢুকছে না। আমার উদ্দেশ্য তাঁর বিশাল সংগ্রামী জীবনকে ব্যাখ্যা করা নয়। অনুসন্ধানটা হচ্ছে তাঁর বিপ্লবী সাহিত্য সৃষ্টির বিষয়ে সামান্য খোঁজ খবর দেয়া। 

বাংলাদেশের কৃষক-শ্রমিকের বিপ্লবী সত্তাকে চিনতেন রনো ভাই। মার্কসবাদী দৃষ্টিতে তা ব্যাখ্যাও  করেছেন। কেবল তাই নয় বিশ্বসাহিত্য সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান-প্রজ্ঞা ছিল অতুলনীয়। সারাবিশ্বের বিপ্লবী সাহিত্যের অনুরাগী পাঠক ছিলেন তিনি।

একজন বিপ্লবী যে অস্ত্র নিয়েই থাকবে এমন তো নয়, হাতে তার কলমও থাকে। প্রগতির বিশ্বে ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন তার প্রমাণ। অসংখ্য বই লিখে গেছেন তিনি। স্ট্যালিনও রাতের পর রাত জেগে রয়েছেন পড়ার বইয়ে এবং লেখার খাতায়। আমাদের রনো ভাই লেনিন-স্ট্যালিন হতে চাননি। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সাহিত্যে তার অবদান অসামান্য। 

রনো ভাই মন্ত্রী হননি, সাংসদ হননি, হয়েছেন বাম রাজনৈতিক ধারার বিশ্লেষক। সংবাদপত্রে তাঁর লেখা কলামগুলো তারই প্রমাণ। আজীবন যিনি রাজনৈতিক কর্মী এবং সংগঠক, অবশ্যই নেতা, তিনিই আবার লেখকও বটে। বাঙালি রাজনীতিকদের মধ্যে দ্বৈতসত্তা খুব কম পাওয়া যায়। অবশ্যই পাওয়া যায় আত্মজৈবনিক লেখক। কিন্তু খুব কম মেলে প্রগতিবাদী তত্ত্ব-সাহিত্যের মানুষ। 

বাংলাদেশের কৃষক-শ্রমিকের বিপ্লবী সত্তাকে চিনতেন রনো ভাই। মার্কসবাদী দৃষ্টিতে তা ব্যাখ্যাও  করেছেন। কেবল তাই নয় বিশ্বসাহিত্য সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান-প্রজ্ঞা ছিল অতুলনীয়। সারাবিশ্বের বিপ্লবী সাহিত্যের অনুরাগী পাঠক ছিলেন তিনি। আমার বিশ্বাস লাতিন আমেরিকান বিপ্লবী সাহিত্য সম্পর্কে তাঁর যতটা জ্ঞান ছিল, অনেক খ্যাতিমান বাঙালি লেখকেরা তাঁর ধারে কাছেও নেই। এই মহান মানুষটি চলে গেলেন অনেকটা নিঃসঙ্গ অবস্থায়ই। একদিন আমরা তাঁকে ভুলে যাব। বাঙালির বিস্তৃতির ভেতর তলিয়ে যাবেন তিনি। 

তার যে সব মূল্যবান বই আজ বাজারে ঘুরে বেড়ায়, হয়তো একদিন সে সবের সন্ধানে ন্যাশনাল আর্কইভে জীর্ণ পুস্তকের অন্ধকারে হাতড়েও নিরাশ হয়ে বিলুপ্ত প্রজাতির স্মৃতি নিয়ে ঘরে ফিরবো। এটাই তো বাঙালির ইতিহাস, এটাই জাতীয় নিয়তি। রনো ভাই চলে গেলেন সত্য, তবে তিনি মেহনতি মানুষের মুক্তি সংগ্রামে আলোক বর্তিকা হয়ে থাকবেন অনন্তকাল। 

লাল সালাম কমরেড হায়দার আকবর খান রনো। 

Comments

The Daily Star  | English
Prof Yunus in Time magazine's 100 list 2025

Prof Yunus named among Time’s 100 Most Influential People of 2025

A tribute article on Prof Yunus was written by Hillary Clinton for the magazine

1h ago