বিয়েন্নালে দি ভেনেসিয়ায় বাংলাদেশ প্যাভিলিয়ন, উদ্দেশ্য নিয়ে শিল্পামোদিদের প্রশ্ন

ভেনিস বিয়েনালে বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নে শিল্পী আব্দুর রবের চিত্রকর্ম। ছবি: পলাশ রহমান

বিশ্ব চারুকলার সবচেয়ে বড় মেলা বসে ইতালির ভেনিসে। পৃথিবীর শিল্পামোদিদের কাছে এটি 'বিয়েন্নালে দি ভেনেসিয়া' বা 'ভেনিস বিয়েন্নালে' নামে পরিচিত। এ বছর ভেনিসে শুরু হয়েছে ৬০তম আর্ট বিয়েন্নালে। ৬ মাসের এই আয়োজনকে কেন্দ্র করে ভেনিস এখন ভরে গেছে শিল্পী, সমালোচক, দর্শক ও পর্যটকদের ভিড়ে।

১৮৯৫ সাল থেকে শুরু হওয়া ভেনিসের আর্ট বিয়েন্নালে আয়োজন করা হয় প্রতি দুবছর অন্তর। এ বছর 'আর্তে বিয়েন্নালে দ্য ভেনেসিয়া' আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় ২০ এপ্রিল, শেষ হবে ২৪ নভেম্বর।

ছয় মাসের এই বিশ্ব মেলার প্যাভিলিয়নগুলো খুলতে শুরু করে ১৭ এপ্রিল থেকে। ১৮ এপ্রিল ভেনিসের 'সানতা ক্রোচে' বাংলাদেশ প্যাভিলিয়ন উদ্বোধন করা হয়। এতে যোগ দেন প্যালিভিয়নের কমিশনার লিয়াকত আলী লাকী, মিলানোয় নিযুক্ত বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল এম জে এইচ জাবেদ, কিউরেটর ভিভিয়ানা ভাননুচ্চি, শিল্পীরা এবং ভেনিসে বাংলাদেশ কমিউনিটির নেতারা।

অতিথি শিল্পীদের চিত্রকর্ম। ছবি: পলাশ রহমান

ফরেনার্স এভরিহয়ার বা সর্বত্র বিদেশি শিরোনামে এবারের আয়োজনে ৮৬টি দেশের জাতীয় চারুশিল্প স্থান পেয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নটি করা হয়েছে ভেনিস বিয়েন্নালের মূল ভেন্যু জারদিনি ও আরসেনালে থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে—'সানতা ক্রোচে'র একটি ভবনের নিচতলার তিনটি কক্ষ ভাড়া নিয়ে।

অন্যান্য বছরের তুলনায় এবারের বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নের স্থানটা অনেক সুন্দর। যোগাযোগ সহজ। প্যাভিলিয়নের ভেতরটাও ছিমছাম। কানাল গ্রান্দে থেকে দেখা যায়। বিশেষ করে প্যাভিলিয়নের জানালা দিয়ে একজন বিদেশি শিল্পীর ডিজিটাল আর্টের আলো খানিকটা চোখে পড়ে।

বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নের প্রবেশ মুখে বড় অক্ষরে ব্যানার টানানো আছে। যদিও কানাল গ্রান্দের পাশে বা জানালার সঙ্গে একটা ব্যানার দিতে পারলে বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নটি সহজে পর্যটদের চোখে পড়তো। এতে দর্শক সংখ্যাও বাড়তে পারতো।

২০১১ সালে ভেনিসের আর্ট বিয়েন্নালে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ অংশগ্রহণ করে। সে সময় ঢাকার বেঙ্গল গ্যালারি অব ফাইন আর্টসের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশ থেকে পাঁচজন শিল্পী এসেছিলেন। জারদিনির ভিয়া গারিবালদি সড়কের একটি পরিত্যাক্ত ফ্ল্যাটে বাংলাদেশ প্যাভিলিয়ন করা হয়েছিল। ওই প্রদর্শনীতে বাংলাদেশের শিল্পীরা গরুর চামড়া দিয়ে শুকর এবং ব্লেড দিয়ে নারীর অন্তবাস বানিয়ে প্রদর্শন করেছিলেন, যা বেশ সমালোচিত হয়েছিল। শিল্পবোদ্ধারা প্রশ্ন তুলেছিলেন, নারীর অন্তর্বাস এবং শুকরের সঙ্গে বাংলাদেশি সংস্কৃতির মৌলিক সম্পর্ক কী?

অতিথি শিল্পীদের চিত্রকর্ম। ছবি: পলাশ রহমান

এ পর্যন্ত মোট চারবার ভেনিস বিয়েন্নালে বাংলাদেশ যোগ দিয়েছে।

রোববার সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় আমরা ওই দিনটি বেছে নিলাম এবারের ভেনিস বিয়েন্নালে যাওয়ার জন্য। দুপুর ৩টার দিকে রওনা করলাম প্রবাসী বাংলাদেশি শিক্ষার্থী ও চিত্রশিল্পী ফিয়রিনা মাসুম এবং তার মা শামসুন নাহার পলিকে সঙ্গে নিয়ে।

অতিথি শিল্পীদের চিত্রকর্ম। ছবি: পলাশ রহমান

ভেনিসের প্রধান প্রবেশ মুখ পিয়াচ্ছালে রোমা থেকে আমরা ১ নম্বর ওয়াটার বাসে চড়ে সানতা ক্রোচের সানতা স্তেয়ে ফেরমাতায় (ঘাট) নামলাম। লঞ্চ থেকে নেমেই যেটা সবার আগে চোখে পড়বে তা হলো সানতা ক্রোচে চার্চ। ডান দিকে ঘাড় ঘোরালেই দেখা যাবে 'দ্য কনটাক্ট' লেখা বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নের ব্যানার ঝুলছে।

এ বছর বাংলাদেশি চারজন চারুশিল্পীর চিত্রকর্ম দিয়ে সাজানো হয়েছে পঞ্চম বাংলাদেশ প্যাভিলিয়ন। তিন কক্ষ বিশিষ্ট প্যাভিলিয়নের শেষ কক্ষে প্রদর্শন করা হয়েছে 'ফিউচার লাইফ' শিরোনামে ১০ জন বিদেশি শিল্পীর চিত্রকর্ম।

অতিথি শিল্পীদের চিত্রকর্ম। ছবি: পলাশ রহমান

১৮৯৫ সালে প্রথম ভেনিস বিয়েন্নালে শুরু হয়। সে সময়ের রাজা উমবেরতো ও রানী মারগেরিতা সাভোইয়া এই আন্তর্জাতিক শিল্পমেলা প্রবর্তন করেন। ভেনিসের জারদিনিতে ৩০ দেশের জাতীয় প্যাভিলিয়ন দিয়ে শুরু করা বিয়েন্নালে পরবর্তীতে আরসেনালেয় সম্প্রসারণ করা হয়। এর আয়োজন ভার গ্রহণ করে ভেনিসের সিটি পরিষদ।

অতিথি শিল্পীদের চিত্রকর্ম। ছবি: পলাশ রহমান

শিল্প-সংস্কৃতি এবং অর্থনৈতিকভাবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রতিনিধিত্বকারী দেশগুলোর বাইরে বাংলাদেশের মতো অনেক দেশ আছে যারা জারদিনি বা আরসেনালের মূল ভেন্যুতে প্যাভিলিয়ন করতে পারে না। কিউরেটররা খুব বেশি খরচ করতে চান না। ভালো স্পন্সর পাওয়া যায় না। এসব দেশের শিল্প নিয়ে ভেনিসের অন্যান্য স্থানে—জারদিনি ও আরসেনালের বাইরে—কম ভাড়ার ঘর বা পৌরসভার অব্যবহারিত বাড়িতে প্যাভিলিয়ন করেন কিউরেটররা।

শিল্পী সৈয়দা মাহবুবা কারিমের চিত্রকর্ম। ছবি: পলাশ রহমান

চারুশিল্প দিয়ে ভেনিস বিয়েন্নালে শুরু করা হলেও পরবর্তীতে যুগের চাহিদা মোতাবেক এর সঙ্গে শিল্পের আরও কিছু শাখা-প্রশাখা যোগ করা হয়; ১৯৩০ সালে যুক্ত হয় সংগীত, ১৯৩৪ সালে থিয়েটার ও চলচ্চিত্র—যা বর্তমানে কানের পরেই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র উৎসব হিসেবে বিশ্বজুড়ে সমাদ্রিত। ১৯৮০ সালে যোগ করা হয় স্থাপত্য শিল্প। ১৯৯৯ সালে নৃত্য এবং ২০০৯ সালে শিশুদের জন্য বিশ্ব আনন্দ মেলা।

ভেনিসের জারদিনি ও আরসেনালের স্থায়ী প্যাভিলিয়নগুলো মূলত নিয়ন্ত্রণ করে নিজ নিজ দেশের শিল্প মন্ত্রণালয়। স্থায়ী প্যাভিলিয়ন নির্মাণের ক্ষেত্রে ধনী দেশগুলোর অর্থ ও কূটনৈতিক প্রভাব ব্যাপক ভূমিকা রাখে। সমালোচকদের ভাষায়, ১৯ শতকে স্থায়ী প্যাভিলিয়নের জন্য রীতিমতো স্নায়ুযুদ্ধ হতো। এখনো বিয়েন্নালের তহবিল গঠন এবং গুরুত্বপূর্ণ দেশের প্যাভিলিয়ন নির্মাণ নিয়ে পর্দার আড়ালে অনেক হিসাব-নিকাশ এবং রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রভাব কাজ করে।

শিল্পী শাজাহান আহমদ বিকাশের চিত্রকর্ম। ছবি: পলাশ রহমান

১৮ শতকে ভেনিস বিয়েন্নালের জন্ম হলেও মূল পরিবর্তন-পরিবর্ধন, যোগ-বিয়োগ প্রায় সবই সংঘটিত হয়েছে ১৯ শতকে। ১৮ শতকের শেষের দিকে ভেনিস বিয়েন্নালের সূচনা করা হয়েছিল সে সময়ের সমসাময়িক শিল্পের বাজার সৃষ্টি করা এবং শিল্পীদের আর্থিকভাবে সহযোগিতা করার জন্য।

শিল্পীরা যেন তাদের কাজ ভালো দামে বিক্রি করতে পারেন, আর্থিকভাবে ভালো থাকেন সে জন্য সেলস অফিস নতুন নতুন ক্রেতা খুঁজে বের করতো। এ কাজের জন্য সেলস অফিসকে ১০ শতাংশ কমিশন দিতে হতো। পরবর্তীতে এই ধারায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। বিয়েন্নালেকে অলাভজনক প্রতিষ্ঠানে রূপ দেওয়া হয়েছে। এর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যে ব্যাপক পরিবর্তন এনে আরও বেশি উন্মুক্ত ও উদার নীতি গ্রহণ করা হয়েছে।

শিল্পী তালুকদার শহিদ কবিরের কপি চিত্রকর্ম। ছবি: পলাশ রহমান

এখন ভেনিস বিয়েন্নালে মানে বিশ্ববাসী বোঝে, সমসাময়িক শিল্প বিনিময়; পারস্পরিক ভাব ও চিন্তার বিনিময়; আন্তরিকতা ও বন্ধুত্ব বিনিময়। ভেনিস বিয়েন্নালে এখন বিভিন্ন জাতী-গোষ্ঠী, ভাষাভাষী মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি গড়ে তোলার এক বড় মাধ্যমে পরিণত হয়েছে।

বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নের প্রথম কক্ষে ছোট-বড় মিলিয়ে অনেকগুলো ছবি রাখা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো শিল্পী আব্দুর রবের আঁকা সিনেমার পোস্টার ও রিকশাচিত্র। এখানে প্রদর্শীত হচ্ছে রিকশার পেছনে আঁকা বাংলা চলচ্চিত্রের নায়ক-নায়িকাদের ছবি এবং 'বেদের মেয়ে জোসনা', 'সাধু শয়তান' চলচ্চিত্রের পোস্টার।

শিল্পী সৈয়দা মাহবুবা কারিমের চিত্রকর্ম। ছবি: পলাশ রহমান

এ কক্ষে শিল্পী শাজাহান আহমদ বিকাশের দেয়াল জোড়া বিশাল চিত্রকর্ম রাখা হয়েছে, যার পুরোটা জুড়ে বঙ্গবন্ধু। ছবিতে বিভিন্ন ভাবে বঙ্গবন্ধুকে তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো, ছবিটা আসল নয়, কপি। এ ছাড়া, প্রথম কক্ষে শিল্পী তালুকদার শহিদ কবিরের চারটি ছবি রাখা হয়েছে, যার তিনটিই কপি।

ভেনিস বিয়েন্নালের মতো আন্তর্জাতিক আর্ট এক্সিবিশনে যে কপি ছবি প্রদর্শন করা যায়, তা বাংলাদেশ প্যাভিয়নে না গেলে বোঝা যেতো না। প্রথম কক্ষে চারটিসহ মোট পাঁচটি কপি ছবি প্রদর্শন করা হয়েছে এবারের বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নে।

শিল্পী আব্দুর রবের চিত্রকর্ম। ছবি: পলাশ রহমান

এখানে স্যুভেনিয়র হিসেবে প্রদর্শন করা হয়েছে কয়েকটি রিকশা, ভ্যান, বেবিট্যাক্সি—কিন্তু কোনো শিল্পীর নাম বা শিল্পের বিবরণ নেই। ব্রুশিয়রের প্রচ্ছদে বিয়েন্নালের ভুল লোগো ছাপা হয়েছে। ছবির বিষয়, ফ্রেম, বাঁধাই কোনোভাবেই আন্তর্জাতিক মানের নয়। এসব বিষয়ে কিউরেটর ভিভিয়ানা ভাননুচ্চির সঙ্গে কথা হয়, যা লেখার শেষাংশে রয়েছে।

প্যাভিয়িনের দ্বিতীয় কক্ষের বড় দেয়াল জুড়ে সাজাহান আহমদ বিকাশের আরেকটি বিশাল সাইজের কপি ছবি রাখা হয়েছে। শিল্পী সৈয়দা মাহবুবা কারিমসহ অন্যান্য শিল্পীদের আরও কিছু ছবি রাখা হয়েছে এ কক্ষে। যার মধ্যে অধিকাংশ উদ্বাস্তুদের চিত্র। এ ছাড়া আছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সুফিয়া কামাল ও বেগম রোকেয়ার ছবি। বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রীর ছবি রাখা হয়েছে মোট সাতটি।

শিল্পী শাজাহান আহমদ বিকাশের কপি চিত্রকর্ম। ছবি: পলাশ রহমান

এ কক্ষে ইতালিয় শিল্পী মারকো নেরেয় রোতেল্লির একটি ডিজিটাল চিত্রকর্ম উপস্থাপন করা হয়েছে। স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে, ভেনিসের ঐতিহাসিক পর্যটক নৌকা গন্দোলা ভেনিসের কানাল গ্রান্দে থেকে ভাসতে ভাসতে চাঁদের দেশে চলে যান। সেখান থেকে যান বাংলাদেশে। জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের সামনে নোঙ্গর করেন। শিল্পী রোতেল্লি এখানে বৈশ্বিক সম্পর্ককে স্বর্গের সঙ্গে তুলনা করেছেন।

শিল্পী তালুকদার শহিদ কবিরের কপি চিত্রকর্ম। ছবি: পলাশ রহমান

তৃতীয় কক্ষে প্রদর্শন করা হয়েছে ১০ জন অতিথি শিল্পীর শিল্পকর্ম। তারা হলেন—ইতালিয় শিল্পী রোবেরতো সালিয়েত্তো, তিনি বিশাল ক্যানভাসে অসংখ্য জানালা এঁকেছেন ভবিষ্যত দেখার জন্য; ভেনিসের শিল্পী মারকো নেরেয় রোতেল্লি, তিনি ডিজিটাল জানালা বানিয়েছেন; ইতালির আব্রুচ্ছোর শিল্পী ক্লাউদিয়া দে লেয়নারদিস এঁকেছেন বিশ্ব বৈচিত্রের সমাবেশ, যেখানে সংলাপ ও সংযোগের প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন; আব্রুচ্ছোর আরেক শিল্পী আন্না কারলা দে লেয়নারদিস কাঁচের ক্যানভাসে সোনার প্রলেপে একেছেন অদৃশ্য এলিয়ন; জার্মানির শিল্পী পাতরিছিয়া কাজাগরানদা এঁকেছেন একজন স্বাধীন নারীর চোখে ভবিষ্যত বিশ্ব; ইউক্রেনের শিল্পী নাতালিয়া রেভোনিক বৈশ্বিক ভাষার শৈল্পিক রূপ এঁকেছেন পশম দিয়ে; ইতালির ত্রেনতোর শিল্পী মিরকো দেমাত্তে আস্ত একটা শহর বানিয়েছেন, কিন্তু তা মানুষের জন্য না, এলিয়নদের জন্য; কোরিয়ান শিল্পী দোজং জো এবং জিয়ন ওহ এঁকেছেন কাঠের পরী ও সূর্য অস্ত না যাওয়া ভবিষ্যত বিশ্ব এবং শিল্পী ফ্রানকো মাররক্কো আদিম পানপাত্র বানিয়েছেন চামড়া দিয়ে।

শিল্পী শাজাহান আহমদ বিকাশের কপি চিত্রকর্ম। ছবি: পলাশ রহমান

বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নের ইতালীয় কিউেরেটর ভিভিয়ানা ভাননুচ্চি বলেন, 'প্রথমে পরিকল্পনা ছিল "ফিউচার লাইফ" শিরোনামে বাংলাদেশ প্যাভিলিয়ন করবো। শিল্পীদের ভবিষ্যত ভাবনা নিয়ে প্রদর্শনী করবো। কিন্তু বাংলাদেশের শিল্পীদের কাজগুলো বেশি ইতিহাস নির্ভর, অতীত নির্ভর। যে কারণে শিরোনাম বদলে "দ্য কনটাক্ট" করতে হয়েছে।'

'অতিথি শিল্পীরা সবাই ভবিষ্যত নিয়ে কাজ করেছেন আর বাংলাদেশের শিল্পীরা করেছেন অতীত নিয়ে। এই দুইয়ের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের জন্য শিরোনাম করেছি "দ্য কনটাক্ট"', যোগ করেন তিনি।

ব্রুশিয়ারে ভেনিস বিয়েনালের ভুল লোগো ছাপানো হয়েছে। ছবি: পলাশ রহমান

ভেনিস বিয়েন্নালের মতো আন্তর্জাতিক আর্ট এক্সিবিশনে কপি ছবি প্রদর্শন, স্যুভেনিয়র প্রদর্শন, রাজনীতিকরণ, ব্রুশিয়ারের প্রচ্ছদে বিয়েন্নালের ভুল লোগো ছাপানো, ছবির ফ্রেম ও বাঁধাই নিম্নমানের—এসব বিষয়ে জানতে চাইলে কিউরেটর ভিভিয়ানা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

ভেনিস প্রবাসী সাংবাদিক মোহাম্মদ উল্লাহ সোহেল বলেন, 'যদি শিল্পের চেয়ে রাজনৈতিক ছবির গুরুত্ব বেশি দিতে হয়, তাহলে সেভাবেই প্যাভিলিয়ন করা যেতো এবং আরও গোছালো ও গ্রহণযোগ্যভাবে বিশ্ব আসরে তাদের তুলে ধরা যেতো।'

স্যুভেনিয়রের ছবি তুলছেন একজন দর্শক। ছবি: পলাশ রহমান

উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, 'এর আগে ভারত একবার করেছিল। তারা গান্ধি প্রদর্শনী করেছিল। আমরাও বঙ্গবন্ধু বা শেখ হাসিনা প্রদর্শনী করতে পারতাম। কিন্তু এখন যা করা হয়েছে তাতে কোনোটাই হয়নি। বরং প্রদর্শনীর উদ্দেশ্য নিয়ে একগাদা প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। রাষ্ট্রীয় টাকা খরচ করে বিশ্ব আসরে হাসির পাত্র বানানো হয়েছে বাংলাদেশকে।'

সোহেল বলেন, 'কিউরেটর বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নের ব্রুশিয়ার তৈরি করেন ইউরোপীয় মানের। কিন্তু বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি প্রতিবার আলাদা ব্রুশিয়ার তৈরি করে, যা কোনোভাবেই ইউরোপীয় মানের হয় না। তাতে শিল্পের চেয়ে রাজনৈতিক প্রচার বেশি গুরুত্ব পায়। শিল্পীদের বয়ানেও শিল্পালোচনার চেয়ে রাজনৈতিক বন্দনা বেশি থাকে।'

লেখকের সাথে কথা বলছেন কিউরেটর ভিভিয়ানা। ছবি: লেখকের সৌজন্যে

তিনি বলেন, 'এ বছর "সভ্যতার সংকটে সম্প্রীতির প্রত্যাশা" শিরোনামে আলাদা ব্রুশিয়ার প্রকাশ করেছে শিল্পকলা একাডেমি, যেখানে বিয়েন্নালে দ্য ভেনেসিয়ার লোগো ভুল ছাপানো হয়েছে। কিউরেটর ব্রুশিয়ার প্রকাশ করার পরেও কেন শিল্পকলা একাডেমিকে আলাদা করে আবার ব্রুশিয়ার করতে হয়? দেশের এই অর্থ অপচয়ের কারণ কী?'

তার ভাষ্য, 'বাংলাদেশে কতো কতো বিদগ্ধ শিল্পী আছেন, যাদের কাজ বিশ্বমানের। এমন শিল্পীদের কাজগুলো কেন ভেনিস বিয়েন্নালে স্থান পায় না? কেন কপি ছবি প্রদর্শন করা হয়? একটা বিশ্ব আসরে কী কেউ কপি ছবি দেখতে আসে? মোনালিসার কপি ছবি দেখতে কী কেউ প্যারিসের ল্যুভরে যাবে?'

ভেনিস বিয়েনালের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাংলাদেশি কমিউনিটি নেতারা্ ছবি: পলাশ রহমান

তার অভিযোগ, 'ছবির বাঁধাই, ফ্রেম এত নিম্নমানের, যা বলার মতো না। অনেক শিল্পী তাদের লাগেজে ঢুকিয়ে ছবিগুলো এনেছেন এবং এখান থেকে সরু কাঠ জোগাড় করে নিজেরাই হাতুড়ি-বাটালি দিয়ে ফ্রেম বানিয়েছেন। এটা রীতিমতো লজ্জাজনক। তাছাড়া আমাদের অনেক শিল্পীর কাজ দেখলে মনে হয়, বিশ্ব আর্ট যে এখন আর শুধু রং-তুলিতে আটকে নেই, তা তারা জানেনই না।'

বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কথা বলছেন, কিউরেটর ভিভিয়ানা। ছবি: পলাশ রহমান

'মজার বিষয় হলো, বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নের কমিশনার ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকীর মেয়াদ আগামী বছর শেষ হবে এবং তিনি আবারও মহাপরিচালক পদেই থাকতে চান বলে এ বছরের বাংলাদেশ প্যাভিলিয়ন ও ব্রুশিয়ার এভাবে সাজিয়েছেন—এ আলোচনা এখন সবার মুখে মুখে। উদ্বোধনী দিন থেকেই এ নিয়ে আলোচনা চলছে,' যোগ করেন সোহেল।

Comments

The Daily Star  | English
road accidents death in Bangladesh April

Road accidents killed 583 in April: Jatri Kalyan Samity

Bangladesh Jatri Kalyan Samity (BJKS), a passenger welfare platform, said that a total of 583 people were killed and 1,202 injured in 567 road accidents across the country in the month of April, citing media reports

1h ago