বাংলাদেশে স্বল্প দক্ষতার আইটি চাকরি কেড়ে নিচ্ছে এআই

এআই, আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা,
রয়টার্স ফাইল ফটো

গত কয়েক বছর ধরে স্থানীয় কোম্পানি স্কাইটেক সলিউশনসের দারুণ একটি প্রকল্প ছিল, ৫০ জনেরও বেশি মানুষ তাতে প্রত্যেকে ঘণ্টায় সাড়ে আট ডলার করে ইনকাম করতে পারতো।

কোম্পানিটির কাজ ছিল উবার ফ্রেইট পরিষেবার চালান তৈরি ও তা কাস্টমার রিলেশনশিপ ম্যানেজমেন্ট নামে একটি সিস্টেমে আপলোড করা। কাস্টমার রিলেশনশিপ ম্যানেজমেন্ট গ্রাহকের মতামত ও সন্তুষ্টির পাশাপাশি ব্যবসার প্রসার ঘটাতে সাহায্য করে।

কিন্তু, গত বছরের শেষের দিকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহারের ফলে এক ধাক্কায় এই প্রকল্পের ৮০ শতাংশেরও বেশি কর্মী চাকরি হারিয়েছেন।

দেশের অন্যতম শীর্ষ বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং (বিপিও) প্রতিষ্ঠান স্কাইটেকের প্রতিষ্ঠাতা মুসনাদ ই আহমেদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'তারা আমোদের বলেছেন- প্রাথমিক কাজটি এআই অটোমেশনের মাধ্যমে করা হবে। তাই এখন থেকে কর্মীরা শুধু মান নিয়ন্ত্রণ করবেন।'

ফলে, সেই প্রজেক্টটিতে কর্মীর সংখ্যা এখন ৫৫ থেকে কমে ১০ জনে নেমে এসেছে।

এআইয়ের মাধ্যম ডেটা এন্ট্রি ও কাস্টমার সাপোর্টের মতো রুটিন কাজগুলো স্বয়ংক্রিয় করায় কর্মীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাচ্ছে। এটি দেশের বিপিও খাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

বিপিওকে প্রায়ই তথ্য প্রযুক্তি-সক্ষম পরিষেবা (আইটিইএস) হিসেবে উল্লেখ করা হয়। কারণ, এটি প্রযুক্তি অবকাঠামোর ওপর নির্ভর করে।

সংশ্লিষ্টদের মতে, বিপিওতে এআই-পরিচালিত অটোমেশনের প্রভাব বাংলাদেশের জন্য আরও বিধ্বংসী হবে। কারণ, বেশিরভাগ কর্মী সাধারণত স্বল্প-দক্ষতার প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ করে থাকেন।

বিপিওতে এআই ডেটা এন্ট্রি ও গ্রাহক সহায়তার মতো রুটিন কাজগুলো স্বয়ংক্রিয় করায় চাকরির সংখ্যা কমছে। ফলে প্রতিষ্ঠানের কর্মদক্ষতা বাড়লেও প্রচুর কর্মী ছাঁটাই হচ্ছেন।

এআই প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে কর্মীদের চাহিদা কমে যাওয়ায় তা বিপিওর কর্মসংস্থানের পরিস্থিতি বদলে দিচ্ছে।

মুসনাদ ই আহমেদ জানান, এআই-বিপ্লব গত দেড় বছরে ৩০ শতাংশ এন্ট্রি-লেভেল কর্মীর চাকরি কেড়ে নিয়েছে।

তিনি বলেন, 'আগে আমরা যেসব কাজ ভয়েস সার্ভিসের মাধ্যমে করতাম, বিশ্বব্যাপী এখন যেসব কাজ এআইয়ের মাধ্যমে হচ্ছে। বিপিও প্রতিষ্ঠানগুলোর গ্রাহক সহায়তা, সেবা বিক্রি ও বিপণন পরিষেবার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এআইয়ের মাধ্যমে করা হচ্ছে। এন্ট্রি-লেভেলের কাজগুলো, বিশেষ করে ভয়েস পরিষেবা এআই দখল করে নিচ্ছে।'

যেমন- একটি পিৎজা বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান এখন ফোনে অর্ডার নিতে এআই ব্যবহার করতে পারে। গ্রাহকরা কোন ধরনের পিৎজা চান তাও এআইয়ের মাধ্যমে জেনে নেওয়া যাবে।

এ ধরনের কার্যক্রম দেড় বছর আগে শুরু হয়। গত ও চলতি বছর এতে ব্যাপক পরিবর্তন আসে।

তার মতে, প্রতিষ্ঠানগুলো যখন বুঝতে পারে এআই দিয়ে কাজ করিয়ে নেওয়া যায়, তখন তারা এ এই সিস্টেম তৈরি করা শুরু করে।

চলতি বছরের শুরু থেকে যেসব প্রতিষ্ঠান আউটসোর্সিং সেবা নিতো তারা এখন কেবল উচ্চ দক্ষতার সেবা নিতে চাচ্ছে। যেমন- স্টেটমেন্ট প্রসেসিং, ব্যালেন্স ট্রান্সফার ও গোপনীয় তথ্য পরিচালনার মতো কাজ—যেগুলোর জন্য দক্ষ কর্মীর প্রয়োজন।

গ্রাফিকপিপলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইমতিয়াজ ইলাহী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'স্বয়ংক্রিয় ইমেজ এডিটিং ও ব্যাকগ্রাউন্ড রিমুভালসহ অন্যান্য কাজ এআইয়ের মাধ্যমে করা হচ্ছে।'

তবে স্টুডিও ইমেজ ও থ্রিডি পোস্ট প্রোডাকশন প্রতিষ্ঠান দ্য কাউ কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কাওসার আহমেদ বলেন, 'এআই তার প্রতিষ্ঠানের কর্মদক্ষতা বাড়িয়ে দিচ্ছে।'

তিনি আরও বলেন, 'আগে আমি ২৫ হাজার ছবি প্রসেস করতে পারতাম। এখন একই সংখ্যক কর্মী দিয়ে ৪০ হাজার ছবি প্রসেস করছি। এআই আমাদের সব জব কেড়ে নিবে না, বরং এটি কাজের গতি বাড়াবে।'

তার মতে, কোনো প্রতিষ্ঠান যদি সঠিক প্রবৃদ্ধির ধার অব্যাহত না রাখতে পারে তাহলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ কর্মী চাকরি হারাতে পারে।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) সভাপতি রাসেল টি আহমেদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এআইয়ের কারণে কর্মঘণ্টা নিরুপণে পরিবর্তন আসছে।'

তিনি আরও বলেন, 'বাংলাদেশ থেকে আউটসোর্স করা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ম্যান-আওয়ার (গড়ে এক ঘণ্টায় একজন কর্মীর কাজের পরিমাণ) কমিয়ে দিচ্ছে। কারণ তারা এখন মনে করে এআইয়ের মাধ্যমে একটি কাজের জন্য প্রয়োজনীয় সময় কমিয়ে আনা যায়।'

এন্ট্রি লেভেলের চাকরিতে এআইয়ের প্রভাব পড়বে উল্লেখ করে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব কন্টাক্ট সেন্টার অ্যান্ড আউটসোর্সিংয়ের সভাপতি ওয়াহিদ শরীফ বলেন, 'যেহেতু প্রতিষ্ঠানগুলো এখন চ্যাটবট ও অন্যান্য এআই প্রযুক্তির মাধ্যমে মৌলিক প্রশ্ন বারবার জিজ্ঞাস করার পরও উত্তর দিতে পারছে, তাই তারা কর্মীর ওপর নির্ভরশীলতা কিছুটা কমিয়ে আনছে।'

তিনি মনে করেন, 'এন্ট্রি লেভেলের চাকরিগুলো শেষ পর্যন্ত বিলুপ্ত হয়ে যাবে।'

'যেসব প্রতিষ্ঠান বাংলায় সেবা দেয়, তারা এআইয়ের কাছ থেকে এখনই কাজ হারানোর হুমকিতে পড়বে না।'

তিনি আরও বলেন, 'ইংরেজি ও অন্যান্য ভাষার মতো বাংলায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দক্ষতা এখনো তেমন বাড়েনি। ভবিষ্যতে বাংলায় এআইয়ের দক্ষতা বাড়বে। তখন এর প্রভাব পরিষ্কার হবে।'

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় স্কাইটেকের প্রতিষ্ঠাতা মুসনাদ ই আহমেদ জানান, তিনি সফটওয়্যার টিম গঠন করছেন। ক্লায়েন্টদের এআই ভয়েস সেবা দেওয়ার পরিকল্পনা করছেন।

তিনি বলেন, 'আমরা সফটওয়্যার ও ডিজিটাল মার্কেটিং বিভাগ করছি, কারণ আমরা জানি আগামী দুই বছরের মধ্যে এন্ট্রি লেভেলের কাজ আর থাকবে না।'

বেসিসের সভাপতি রাসেল টি আহমেদ বলেন, 'বাংলাদেশ কীভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণে সৃষ্ট চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করবে তা নিয়ে সরকার ও সংশ্লিষ্টদের দ্রুত আলোচনা করা উচিত।'

তার মতে, 'এখনই উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। আমরা যখন এ নিয়ে কথা বলছি, তখনই হয়তো এআই প্রযুক্তি আরও উন্নত হয়ে যাচ্ছে।'

Comments

The Daily Star  | English
NCP will not accept delay in Teesta master plan

Won’t accept any implementation delay: Nahid

National Citizen Party Convener Nahid Islam yesterday said his party would not accept any delay or political maneuver over implementing the Teesta master plan.

5h ago