ভারতের জুনিয়র সেরা ক্রিকেটার, যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলা ‘ইঞ্জিনিয়ার’

ক্রিকেট যেমন আবেগের জায়গা ছিল এই বাঁহাতি পেসারের। গণিত ও বিজ্ঞানও ছিল পছন্দের বিষয়। এমনকি ভারতের বিখ্যাত আইআইটিতে (ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি) সুযোগ পেয়ে গেলে হয়তো ক্রিকেট ছেড়েই দিতেন। ভাগ্যিস, ভর্তি পরীক্ষার সময় তিনি ছিলেন ভারতের অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে খেলতে নিউজিল্যান্ডে।
Saurabh Netravalkar
যুক্তরাষ্ট্রের বাঁহাতি পেসার সৌরভ নেত্রভালকর। যিনি যুব বিশ্বকাপ খেলেছেন ভারতের হয়ে। ফাইল ছবি।

বাংলাদেশের বিপক্ষে দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টিতে দুই ওভারে ১৫ রান যখন লাগে, তখন বোলিংয়ে এসে সৌরভ নেত্রভালকর দেন মাত্র ৩ রান। এর আগে প্রথম ওভারেই সৌম্য সরকারকে শূন্য রানে ফিরিয়ে রাখেন অবদান। ম্যাচসেরা আলী খানের দারুণ পারফরম্যান্স তাকে কিছুটা আড়াল করে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে এই সৌরভের চেয়ে বেশি ম্যাচ খেলেননি আর কেউই। অথচ মার্কিন মুলুকে ক্রিকেটের স্বপ্ন মাটিচাপা দিয়েই পা রেখেছিলেন। সেই তিনিই কিনা যুক্তরাষ্ট্রকে নেতৃত্ব দিলেন দেশটির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক ম্যাচে।

ক্রিকেট যেমন আবেগের জায়গা ছিল এই বাঁহাতি পেসারের। গণিত ও বিজ্ঞানও ছিল পছন্দের বিষয়। এমনকি ভারতের বিখ্যাত আইআইটিতে (ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি) সুযোগ পেয়ে গেলে হয়তো ক্রিকেট ছেড়েই দিতেন। ভাগ্যিস, ভর্তি পরীক্ষার সময় তিনি ছিলেন ভারতের অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে খেলতে নিউজিল্যান্ডে। ২০১০ সালের অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে ভারতের হয়ে সবচেয়ে বেশি উইকেট নিয়েছিলেন সৌরভই। ৬ ম্যাচে তার নেওয়া ৯ উইকেটের মধ্যে জো রুট ও মিচেল মার্শও আছেন।

বাঁহাতি এই বোলারের কয়েকজন ভারতের সতীর্থের নাম বললেই চিনে যাবেন- লোকেশ রাহুল, মায়াঙ্ক আগারওয়াল, হার্শাল প্যাটেল, জায়দেব উনাদকেট, সন্দীপ শর্মা। বয়সভিত্তিক পর্যায়ে দারুণ পারফরম্যান্স করা সৌরভকে একবার বিসিসিআই পুরস্কৃত করেছিল 'জুনিয়র ক্রিকেটার অব দ্য ইয়ার'। সেই সৌরভই তাহলে কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে লড়ছেন এখন?

ভারতেই ক্রিকেট নিয়ে তার স্বপ্ন জোরেশোরে ছিল। সঙ্গে আরেক যে আবেগের জায়গা, পড়াশোনাও চালিয়ে গিয়েছেন একেবারে সর্বোচ্চ স্তরে। ভারতের মুম্বাই ইউনিভার্সিটিতে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে স্নাতক শেষ করেন। এরপরই পেয়ে গিয়েছিলেন চাকরি, কিন্তু ক্রিকেটে পূর্ণ মনোযোগ দিতে সেসময় চাকরিতে ঢুকেননি, সময়টা ২০১৩ সাল।

পরে মনস্থ করেছিলেন, ক্রিকেটেই মন-প্রাণ ঢেলে দিবেন। মুম্বাইয়ের হয়ে রঞ্জি ট্রফিতে অভিষেকও হয়ে যায়। কিন্তু ঘরোয়া ক্রিকেটে দলে আসা-যাওয়ার মধ্যেই ছিলেন। ওদিকে আইপিএলের আঙ্গিনায়ও তার হাঁটা-চলা ছিল, কিন্তু মূল মঞ্চে যাওয়ার সুযোগ আসেনি। একটা সময় গিয়ে তাই ক্রিকেট স্বপ্নের ঘরে তালা মেরেই দেন। এখনও বলেন, যা করা তার জন্য বড় বেদনাদায়ক ছিল! পেশাদার ক্রিকেটকে সত্যিকার অর্থেই বিদায় বলেছিলেন। তাইতো ২০১৫ সালে মাস্টার্স করতে যখন পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে, ক্রিকেটের শু-জুতা পর্যন্ত সঙ্গে নিয়ে যাননি।

বিশ্বের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি কর্নেল ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করেন সৌরভ কম্পিউটার সায়েন্সে। চলতি বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের র‍্যাঙ্কিংয়ে যেটিকে দেখা যাচ্ছে সেরা বিশে থাকতে। পড়াশোনায় কেমন ছিলেন, বুঝতেই পারছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমেরিকান কলেজ ক্রিকেট নামে যে প্রতিযোগিতা হতো, সেসবে খেলতেন। তবে নিছকই মজার ছলে। মার্স্টার্স শেষে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি বিশ্বখ্যাত ওরাকলে চাকরি পেয়ে যান। প্রিন্সিপাল মেম্বার অব টেকনিকাল স্টাফ পদে এখনও কাজ করে যাচ্ছেন সেখানে। সাত বছরের বেশি সময় ধরে ওরাকলে কর্মরত তিনি।

একবার দেশে ফিরে এক কোচের সঙ্গে দেখা হলে তিনি পরামর্শ দেন, ক্লাব ক্রিকেট খেলতে পারো যুক্তরাষ্ট্রে। সেই কোচ এক ক্লাবের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিলে শুরু করেন খেলা। ইউএস ওপেন, আটালান্টা ওপেন- এসব নামে টুর্নামেন্ট আয়োজন হয় যুক্তরাষ্ট্রে। সেসবে খেলে মোটামুটি নামডাকও কুড়াতে শুরু করেন বাঁহাতি সৌরভ।

সপ্তাহের পাঁচদিন কাজ করতেন। শুক্রবার রাতে ফ্লাইট কিংবা গাড়িতে করে দেশের এখানে-ওখানে, যেতেন চারিদিকে। শনি-রবিবার ম্যাচ খেলে আবার ফিরতেন। এভাবেই চলতো তার কাজের ফাঁকে খেলা। যে ক্লাবের হয়ে খেলতেন, সেখানে জাতীয় দলের তিন-চারজন ছিলেন। তাদের কথায় উৎসাহ পেলেন, জাতীয় দলে ডাক দেওয়ার। কিন্তু খেলা ছেড়ে দেওয়া সৌরভ তখন পেশাদার ক্রিকেটারের শারীরিক অবস্থা থেকেই যে ছিলেন বেশ দূরে!

ব্যস, দিনের কাজ শেষে রাতেই ঘণ্টা দুয়েক নেমে পড়তেন অনুশীলনে। ট্রেনিং চলত, ম্যাচে নেমে পড়তেন ছুটির দিনে। এভাবেই একবার লস অ্যাঞ্জেলেস দলের হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় দলের বিপক্ষে খেলার সুযোগ পেয়ে যান। সেখানে দুর্দান্ত পারফর্ম করলে তখনকার হেড কোচ পুবুদু দাসানায়েকের নজর পড়ে তার দিকে। কিন্তু তখনও তিনি যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় দলে খেলতে পারতেন না। ভাগ্য ভালো তার, যেবার আইসিসি এই যোগ্য হওয়ার মানদণ্ডে বাসিন্দাদের ক্ষেত্রে সময় কমিয়ে আনে তিন বছরে, সেই ২০১৮ সালেই মার্কিন মুলুকে সৌরভের তিন বছর পূর্ণ হয়ে যায়।

এরপর ২০১৯ সালের মার্চেই অভিষেক হয়ে যায় তার যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে। আমেরিকা মহাদেশের দলটির নেতৃত্বও দিয়েছেন এ পর্যন্ত ২৭ ম্যাচে। সবচেয়ে বেশি ৭৪টি ম্যাচও খেলেছেন তিনিই। অথচ স্বপ্ন দেখেছিলেন ভারতে, ধরা দেয়নি। স্বপ্ন দেখেননি যুক্তরাষ্ট্রে, সেখানেই পেয়ে গেলেন স্বপ্নের ছোঁয়া। একজন পেশাদার প্রকৌশলী হয়েও ক্রিকেটের শিখরে পা রাখলেন, জীবন!

একমাত্র প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ যেটি খেলেছিলেন সৌরভ, সেখানে ভারতের আসন্ন বিশ্বকাপ দলের সদস্য সূর্যকুমার যাদব ছিলেন তার মুম্বাই দলের সতীর্থ। সেই সূর্যকুমারই তার প্রতিপক্ষ থাকবেন ১২ জুন নিউইয়র্কে। বিশ্বকাপের মঞ্চে ভারতের বিপক্ষে যখন মাঠে নামবেন, তখনও হয়তো সৌরভের মনে পড়বে এই শব্দটা- জীবন! যে দেশে ক্রিকেটের স্বপ্নই দেখেননি, সেখানেই বিশ্বকাপের স্বপ্নে বাস করবেন, সেটিও জন্মভূমির বিপক্ষে!

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh eyes longer-term loans at fixed rates to manage debt better

Bangladesh eyes longer-term loans at fixed rates to manage debt better

The government aims to borrow more from the domestic sector at fixed rates and for longer periods and cut reliance on Treasury bills with a view to keeping debt risks lower and avoiding exchange rate volatility.

11h ago