ঐতিহ্যগত বন্ধুত্বে, উন্নত ভবিষ্যৎ গড়ি একসঙ্গে

চীনের প্রধানমন্ত্রী লি ছিয়াংয়ের আমন্ত্রণে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ৮ জুলাই সরকারি সফরে বেইজিং যাবেন। এটি শেখ হাসিনার পঞ্চম চীন সফর এবং গত পাঁচ বছরের মধ্যে প্রথম। অতীতের অর্জনগুলোর ওপর ভিত্তি করে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এগিয়ে নিতে এই সফর তাৎপর্যপূর্ণ।

সফরকালে, শেখ হাসিনা চীনের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক ও সাক্ষাৎ করবেন। এই সফর চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে বহুমুখী সম্পর্ক ও সহযোগিতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করবে বলে আশা করা হচ্ছে। এটি কৌশলগত অংশীদারিত্বে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে পারে, যা দুই দেশের সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে সাহায্য করবে।

৪৯ বছর আগে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পর থেকে চীন ও বাংলাদেশের নেতারা দুই দেশের মধ্যে দৃঢ় বন্ধুত্ব গড়ে তুলেছেন। উভয় দেশ একে অপরের সঙ্গে ন্যায্য এবং সম্মানের সঙ্গে আচরণ করে। তারা একে অপরকে সাহায্য করে পরস্পরের প্রয়োজনে পাশে দাঁড়ায়। বন্ধুত্বপূর্ণ সহাবস্থান এবং একে অপরকে সাহায্য করার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে চীন ও বাংলাদেশ।

বন্ধুত্বপূর্ণ সহযোগিতা চীন ও বাংলাদেশের সম্পর্কের ভিত্তি। এই বন্ধুত্ব অন্য কারো বিরুদ্ধে নয়। এতে দুই দেশের মানুষের পূর্ণ সমর্থন আছে। প্রকৃতপক্ষে, এটি সমগ্র অঞ্চলকে আরও শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ করতে সাহায্য করে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী একাধিকবার বলেছেন, চীন বাংলাদেশের সবচেয়ে বিশ্বস্ত উন্নয়ন সহযোগী এবং সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বন্ধু। এই বক্তব্য দুই দেশের সম্পর্কে অনেক কিছু বলে।

গত ৪৯ বছরে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পর থেকে, চীন ও বাংলাদেশ তাদের দেশ গড়ার, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং আধুনিকীকরণের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অর্জন অর্জন করেছে। চীন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে। এই দেশটি মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় দারিদ্র্য দূরীকরণের যুদ্ধে জয়লাভ করেছে, সব দিক থেকে একটি সমৃদ্ধ সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছে এবং আধুনিকায়নের মাধ্যমে চীনকে একটি শক্তিশালী দেশ হিসেবে গড়ে তোলার মহান লক্ষ্য অর্জনে এগিয়ে চলেছে।

দীর্ঘমেয়াদী রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে, বাংলাদেশ প্রায় ১৮ কোটি মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণে সক্ষম হয়েছে। গত এক দশকে, দেশের জিডিপির গড় বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ছাড়িয়েছে ৬ শতাংশ, মোট জিডিপি ৪৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে গেছে এবং মাথাপিছু জিডিপি পৌঁছেছে প্রায় ২৮০০ মার্কিন ডলার। এর ফলে, বাংলাদেশের অর্থনীতি সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে।

বাংলাদেশ দরিদ্রতম দেশগুলোর একটি থেকে বিশ্বের দ্রুততম বর্ধনশীল অর্থনীতির একটিতে পরিণত হয়েছে। গড় আয়ু, সাক্ষরতার হার এবং নারী শ্রমশক্তির অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে, বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় নেতৃত্ব দিচ্ছে। এই অসাধারণ অর্জনের জন্য, বাংলাদেশ 'বে অব বেঙ্গল মিরাকল' হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে এবং গ্লোবাল সাউথের নেতৃস্থানীয় দেশে পরিণত হয়েছে।

বাংলাদেশ ২০২৬ সালের মধ্যে এলডিসি (স্বল্পোন্নত দেশ) থেকে উত্তীর্ণ হওয়ার পথে রয়েছে এবং 'ভিশন ২০৪১' এবং 'সোনার বাংলা' বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ২০২৬ সালে মধ্যম আয়ের দেশ, ২০৩১ সালে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্যে উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে।

চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক এগিয়ে নিতে উভয় দেশের নেতাদের ভূমিকা রয়েছে। ২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট সি জিনপিং বাংলাদেশে ঐতিহাসিক রাষ্ট্রীয় সফর করেন। ওই সফরে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দুদেশের সম্পর্ককে 'সহযোগিতার কৌশলগত অংশীদারিত্বে' উন্নীত করেন। এটি দুই দেশের সম্পর্কের নতুন যুগের সূচনা করে। ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরের সময়, এই সম্পর্ক আরেকটি স্তরে উন্নীত হয়।

বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা, আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষায় সমর্থন এবং বাইরের হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করে চীন। সেই সঙ্গে স্বাধীনভাবে নিজস্ব উন্নয়নের পথ বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে বেইজিং। 'সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়' এই পররাষ্ট্র নীতি অনুসরণেও চীন বাংলাদেশকে সমর্থন করে। অন্যদিকে, বাংলাদেশও দৃঢ়ভাবে এক-চীন নীতি মেনে চলে এবং জাতীয় সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা ও উন্নয়ন স্বার্থ রক্ষায় চীনকে দৃঢ় সমর্থন করে।

চীন ও বাংলাদেশের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা অভিন্ন। দেশ দুটি একই ধরনের পররাষ্ট্রনীতি, মূল্যবোধ ও উন্নয়ন ধারণা মেনে চলে এবং সবসময় একে অপরকে বুঝতে পারে ও সমর্থন করে। বাংলাদেশের আধুনিকায়নে চীন বিশ্বস্ত সহযোগী এবং সক্রিয় অবদানকারী।

চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কের মূল শক্তি বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা। চীন গত ১৩ বছর ধরে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার। ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ চীন বাংলাদেশে ৩.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে, যা বাংলাদেশে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। চীন বাংলাদেশে সাতটি রেলপথ, ১২টি মহাসড়ক, ২১টি সেতু এবং ৩১টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করেছে। চীন যেসব বড় প্রকল্পে কাজ করেছে তার মধ্যে পদ্মা বহুমুখী সেতু, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল এবং দাশেরকান্দি স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট অন্যতম। এই প্রকল্পগুলো বাংলাদেশের জনগণের অনেক উপকারে এসেছে। বর্তমানে প্রায় এক হাজার চীনা কোম্পানি বাংলাদেশে কাজ করছে। এসব প্রতিষ্ঠানে ৫ লাখ ৫০ হাজার মানুষ কাজ করছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের প্রশংসা করে বলেছেন, এটি বাংলাদেশের উন্নয়নের নতুন দ্বার উন্মোচন করেছে এবং দেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক দুদেশের জনগণের মধ্যে গভীর বন্ধুত্বের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। গত বছরের আন্তর্জাতিক শিশু দিবসে, চীনের প্রেসিডেন্ট সি জিনপিং 'আলিফা চীন' নামে এক বাংলাদেশি শিশুর চিঠির উত্তর দিয়েছিলেন। চিঠিতে, তিনি আলিফাকে কঠোর পরিশ্রমে পড়াশোনা করতে, তার স্বপ্ন অনুসরণ করতে এবং বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যেকার বন্ধুত্বকে এগিয়ে নিয়ে যেতে উৎসাহিত করেছিলেন। এই শিশুর গল্পটি আমাদের দুদেশের মধ্যে ঘনিষ্ঠ বন্ধনের প্রতীক।

বর্তমানে, প্রায় ২০ হাজার বাংলাদেশি শিক্ষার্থী চীনে পড়ালেখা করছেন। গত এক বছরে, দুটি কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট এবং একটি কনফুসিয়াস ক্লাসরুম প্রায় তিন হাজার বাংলাদেশি শিক্ষার্থীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। চীনা ভাষা শেখার একটি ঢেউ বাংলাদেশের সর্বত্র বয়ে গেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্য সেন্টার ফর চায়না স্টাডিজ (সিসিএস) দুই দেশের থিঙ্ক ট্যাঙ্ক এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সহযোগিতার জন্য নতুন ও আরও বড় একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছে। এয়ার চায়না এবং চায়না সাউদার্ন এয়ারলাইনস এই মাসেই বেইজিং ও ঢাকার মধ্যে সরাসরি ফ্লাইট চালু করবে। প্রতি সপ্তাহে ৮০টি ফ্লাইটে ১৫ হাজারের বেশি যাত্রী চলাচল করতে পারবেন। এই নতুন ফ্লাইটের ফলে চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে কর্মীদের যাতায়াত এবং ব্যবসায়িক বিনিয়োগ বাড়বে। গত দুই বছর ধরে বাংলাদেশের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের করা 'বাংলাদেশে চীনের জাতীয় ভাবমূর্তি' শীর্ষক জরিপ অনুসারে, ৯০ শতাংশেরও বেশি মানুষ বিশ্বাস করেন চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক এখন ইতিবাচক অবস্থায় রয়েছে। এতে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে চীনের প্রতি সমর্থন ও বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাবের উল্লেখযোগ্য উন্নতি দেখা যায়।

চীন ও বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বিষয়েও একে অপরকে সাহায্য করে এবং সবার প্রতি ন্যায্যতা ও ন্যায়বিচার সমুন্নত রাখে। চীন টানা ২৫ বছর ধরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে 'শান্তির সংস্কৃতি' রেজুলেশনের জন্য বাংলাদেশের উদ্যোগকে সমর্থন জানাচ্ছে। এ ছাড়া, ব্রিকসের সদস্য হওয়ার জন্য বাংলাদেশের আবেদনেও চীন সম্মতি জানিয়েছে এবং দ্রুতই বাংলাদেশকে এই সংস্থার সদস্য হিসেবে দেখতে চায়। আন্তর্জাতিক শান্তি রক্ষা করতে বাংলাদেশের সৈন্যরা যে দারুণ কাজ করেছে, সেজন্য চীন তাদের প্রশংসা করে।

গণতন্ত্র, মানবাধিকার, নারীর ক্ষমতায়ন, জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশ রক্ষা এবং টেকসই উন্নয়ন—এই সব বিষয়ে চীন ও বাংলাদেশের অবস্থান অভিন্ন। জাতিসংঘ, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা এবং আসিয়ান ফোরামের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোতে দুই দেশ একসঙ্গে কাজ করে। ফিলিস্তিন-ইসরাইলের সংঘাত বা ইউক্রেনের যুদ্ধের মতো সমস্যায় চীন ও বাংলাদেশ একসঙ্গে কাজ করছে। পৃথিবীতে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে দুদেশ একযোগে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

রোহিঙ্গা সমস্যায় বাংলাদেশের সমস্যার কথা চীন উপলব্ধি করতে পারে এবং বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করে। প্রত্যাবাসনই এই সমস্যা সমাধানের একমাত্র উপায়। রাখাইন রাজ্যের বর্তমান পরিস্থিতিতে, চীন একটি রাজনৈতিক মীমাংসার জন্য মিয়ানমারের সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে যুক্ত করতে, রাখাইন রাজ্যে যুদ্ধবিরতি অর্জনে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে এবং রোহিঙ্গা জনগণের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া পুনরায় শুরু জন্য কোনো প্রচেষ্টাই বাদ রাখছে না।

সঠিকভাবে গঠিত অংশীদারিত্ব ভৌগোলিক দূরত্বকে ছাপিয়ে যায়; এটি আঠার চেয়ে আঠালো এবং ধাতু ও পাথরের চেয়ে শক্তিশালী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরের সময়, উভয় পক্ষ গুরুত্বপূর্ণ মতৈক্যে পৌঁছাবেন এবং অবকাঠামো, মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি, চীনে কৃষি পণ্য রপ্তানি, বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের উন্নয়ন, ডিজিটাল অর্থনীতি, দুর্যোগ প্রতিরোধ, দারিদ্র্য বিমোচন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা এবং সাংস্কৃতিক বিষয়ে আলোচনা করবেন। কিছু ক্ষেত্রে সহযোগিতা এবং সমঝোতা স্মারক সই হবে। চীন এই সফরকে দুই দেশের মধ্যে রাজনৈতিক পারস্পরিক বিশ্বাসকে আরও সুগভীর করার, উন্নয়ন কৌশলের সমন্বয়কে শক্তিশালী করার, ঐতিহ্যগত বন্ধুত্বকে সুসংহত করার এবং চীনা জাতির পুনর্জাগরণের স্বপ্ন এবং বাংলাদেশের 'ভিশন ২০৪১' বাস্তবায়নের জন্য একসঙ্গে কাজ করার সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করতে প্রস্তুত।

আমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরের পূর্ণাঙ্গ সাফল্য কামনা করছি। চীন-বাংলাদেশ বন্ধুত্ব দীর্ঘজীবী হোক!

 

ইয়াও ওয়েন: বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত

Comments

The Daily Star  | English
government decision to abolish DSA

A law that gagged

Some made a differing comment, some drew a political cartoon and some made a joke online – and they all ended up in jail, in some cases for months. This is how the Digital Security Act (DSA) and later the Cyber Security Act (CSA) were used to gag freedom of expression and freedom of the press.

13h ago