ইন্টারনেট বন্ধ, কারফিউতে বিপাকে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা

বিদেশি বিনিয়োগ
অলঙ্করণ: আনোয়ার সোহেল/স্টার ডিজিটাল গ্রাফিক্স

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সহিংসতার পাশাপাশি ইন্টারনেট বন্ধ ও চলমান কারফিউ বাংলাদেশের প্রতি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমিয়ে দিয়েছে।

নির্ভরযোগ্য বিনিয়োগের স্থান হিসেবে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হওয়ায় তা সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আসাকে প্রভাবিত করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

দেশে পণ্য উৎপাদনে বৈচিত্র্যকরণ, প্রযুক্তি স্থানান্তরে সক্ষমতা ও ২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে উন্নত অর্থনীতিতে পরিণত করার লক্ষ্য অর্জনে বিদেশি বিনিয়োগ প্রয়োজন।

২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত অর্থনীতিতে পরিণত হতে দেশকে বার্ষিক জিডিপির এক দশমিক ৬৬ শতাংশের সমপরিমাণ বিদেশি বিনিয়োগ আনতে হবে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল প্রায় ৪৫৯ বিলিয়ন ডলার।

বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে ও নির্ভরযোগ্য বিনিয়োগের স্থান হতে গেলে দেশের খ্যাতি থাকা জরুরি। সেই দৃষ্টিতে গত এক সপ্তাহে যে ক্ষতি হয়েছে তা মারাত্মক।

ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ফিক্কি) সভাপতি জাভেদ আখতার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আর্থিক ক্ষতির বাইরেও দেশ যে ভাবমূর্তির সংকটে পড়েছে তা পরিমাপ করা যায় না। কারণ গত কয়েক সপ্তাহে দেশের সুনাম মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।'

তিনি আরও বলেন, 'বিনিয়োগের নির্ভরযোগ্য স্থান হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান এখন প্রশ্নবিদ্ধ। এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো—স্থিতিশীল জাতি ও স্থিতিশীল অর্থনীতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশের সুনাম ফেরাতে কাজ করা ও পরিস্থিতি যাই হোক না কেন আর্থিক সুফল বয়ে আনা। দেশে থাকা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি ব্যবসা সহজ করাও গুরুত্বপূর্ণ।'

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সহিংসতার জেরে ইন্টারনেট বন্ধ করার পর তিনি এমন মন্তব্য করলেন। এই সংঘর্ষে কমপক্ষে ১৬১ জন নিহত ও বেশ কয়েক হাজার মানুষ আহত হয়েছেন। সেসময় সরকারি-বেসরকারি সম্পত্তি ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটে।

ফিক্কির সভাপতি আরও বলেন, 'সব কিছু বন্ধ করে দেওয়ায় গত সাত দিনে দেশের অর্থনীতিতে ১০ বিলিয়ন ডলারের বেশি ক্ষতির আশঙ্কা আছে।'

তার মতে, পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা ও ব্যবসায়িক কার্যক্রম উল্লেখযোগ্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ভোগ্যপণ্য শিল্প গত সপ্তাহে ১০০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে।

'সস্তা শ্রমের মতো ইতিবাচক দিক থাকা সত্ত্বেও দেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি সম্ভাব্য বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মনে আশঙ্কা তৈরি করবে।'

সাম্প্রতিক সংঘাত রপ্তানিমুখী শিল্প, ই-কমার্স, ফ্রিল্যান্সিং, রাইড-শেয়ারিং, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট ও সামাজিকমাধ্যমে আর্থিক কার্যক্রমের ওপর নির্ভরশীল অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

'যদিও সীমিত অনলাইন সংযোগের মাধ্যমে দেশে আর্থিক কার্যক্রম ধীরে ধীরে শুরু হচ্ছে, তবে পুরো কার্যক্রম এখনো শুরু হয়নি। অর্থনৈতিক কার্যক্রমের বড়জোর ৫০ শতাংশ শুরু করতে পেরেছি,' যোগ করেন তিনি।

তিনি মনে করেন, শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর পুরোপুরি কাজ শুরু করতে ব্রডব্যান্ড ও মোবাইল সংযোগ প্রয়োজন।

এছাড়াও, সবকিছু বন্ধ থাকায় ব্যবসায়ীরা বন্দর থেকে পণ্য খালাস ও সেখানে আটকে থাকা পণ্যের ক্ষতি পোষানোর বিড়ম্বনায় পড়েছেন।

তিনি আরও বলেন, 'অনেক বিনিয়োগকারী বর্তমানে অনিশ্চয়তার মধ্যে আছেন। কারণ তারা ব্যবসায়িক কার্যক্রম আবার শুরুর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। পণ্য খালাস, পরিচালনা ও ব্যবসা আবার শুরু করতে খরচ বাড়ছে।'

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই থেকে মে পর্যন্ত বিদেশি বিনিয়োগ তিন দশমিক আট বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। এটি এর আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় সাড়ে ছয় শতাংশ কম।

জাপান এক্সটার্নাল ট্রেড অর্গানাইজেশনের (জেটরো) কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ ইউজি আন্দো ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বাংলাদেশ ইন্টারনেট সংযোগ দিতে ব্যর্থ হওয়ায় বিদেশি বিনিয়োগের ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।'

তিনি আরও বলেন, 'কারফিউ শিথিল ও ইন্টারনেট সংযোগ শুরুর পর বাংলাদেশে জাপানি প্রতিষ্ঠানগুলো আবার কার্যক্রম শুরু করতে পারবে।'

কারণ জাপানের প্রায় ২০ শতাংশ প্রতিষ্ঠান দূরে থেকে কাজ করে বলে জানান তিনি। এছাড়াও, জাপানের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান নিরাপত্তার কারণে তাদের কর্মীদের সরিয়ে নিয়েছে।

আন্দোর মতে, এই মুহূর্তে বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য দুটি প্রধান বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। সবচেয়ে মৌলিক বিষয় হলো নিরাপত্তা। দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে, বিধিনিষেধ ছাড়াই ইন্টারনেট সুবিধা দিতে হবে।

'দেশের সাম্প্রতিক অস্থিরতার কারণে বিনিয়োগকারী ও ক্রেতারা আমাদের সঙ্গে ব্যবসা করা নিয়ে উদ্বিগ্ন। ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা বিদেশিদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারায় তাদের উদ্বেগ আরও বেড়েছে।'

পলিসি এক্সচেঞ্জ অব বাংলাদেশের (পলিসি এক্সচেঞ্জ) চেয়ারম্যান এম মাসরুর রিয়াজ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গত সপ্তাহের ঘটনায় অর্থনৈতিক প্রভাব ভয়াবহ হতে পারে। গত সপ্তাহে যা ঘটেছে তার সম্ভাব্য পুনরাবৃত্তি ও নিজেদের বিনিয়োগ নিয়ে কয়েকজন বিদেশি বিনিয়োগকারী উদ্বিগ্ন।'

তিনি মনে করেন, বিনিয়োগকারীরা উদ্বিগ্ন ছিলেন কারণ তারা ইন্টারনেট না থাকায় বিদেশি ক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি। আজকের দুনিয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ অপরিহার্য।

এম মাসরুর রিয়াজ আরও বলেন, 'রপ্তানি খাতে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ওভারটাইম খরচের কারণে লোকসান ও খরচ বেড়ে যাওয়া আশঙ্কা করছেন। কেননা, শ্রমিকদের গত ছয় দিনের উৎপাদন ক্ষতি পূরণ করতে হবে।'

তাদের এখন সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পণ্য সরবরাহ করতে উড়োজাহাজ ভাড়া করতে হবে। এটি খুবই ব্যয়বহুল বলে মন্তব্য করেন তিনি।

বন্দর থেকে সময় মতো পণ্য খালাস করতে না পারায় বাড়তি খরচের পাশাপাশি জরিমানাও গুনতে হচ্ছে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সস্তা শ্রমের মতো ইতিবাচক দিক থাকা সত্ত্বেও দেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি সম্ভাব্য বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মনে আশঙ্কা তৈরি করবে।'

তিনি আরও বলেন, 'সাম্প্রতিক ঘটনা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এ দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিয়েও প্রশ্ন তুলছে। ইতোমধ্যে তারা গ্যাস সংকটের পাশাপাশি ব্যবসার মুনাফা নিজ দেশে নেওয়ার সমস্যায় ভুগছেন।'

'বিদেশি বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্য হারে কমবে না' উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'তবে বিদ্যমান বিদেশি বিনিয়োগকারীরা একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এ দেশে তাদের ব্যবসার প্রসার বন্ধ রাখতে পারেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।'

বাংলাদেশ মালয়েশিয়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবীরেরও একই মত।

তিনি বলেন, 'দেশের সাম্প্রতিক অস্থিরতার কারণে বিনিয়োগকারী ও ক্রেতারা আমাদের সঙ্গে ব্যবসা করা নিয়ে উদ্বিগ্ন। ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা বিদেশিদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারায় তাদের উদ্বেগ আরও বেড়েছে।'

ইন্টারনেট সংযোগ চালুর পরও ধীর গতির কারণে যোগাযোগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ধীর গতির কারণে বর্তমানে ইনভয়েস ও ছবি পাঠানো যাচ্ছে না।

'এ ধরনের ঘটনা বাংলাদেশের ব্যবসাবান্ধব ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করেছে। বিদেশি বিনিয়োগকারী ও ক্রেতারা আমাদের সঙ্গে ব্যবসা করতে ক্রমেই সতর্ক হয়ে উঠছেন,' বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

CSA getting scrapped

The interim government yesterday decided in principle to repeal the Cyber Security Act which has been used to curb press freedom and supress political opposition.

2h ago