বন্যা-পরবর্তী পুনর্বাসনে ৯৮’র ‘বীজ প্রতারণা’ যেন ফিরে না আসে

জুলাই অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে ছাত্র-জনতা রাষ্ট্র সংস্কারের আওয়াজ তুলেছে। বন্যা-পরবর্তী রিহেবিলিটেশন কার্যক্রমসহ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও আমাদের কর্তৃত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গি এবং তৎপরতার সংস্কার প্রয়োজন।
ছবি: স্টার

১৯৮৮, ১৯৯১, ১৯৯৮, ২০১৭ ও ২০২৩ সালের মতো ২০২৪ সালের বন্যাও জনপরিসরের আলাপের বিষয় হয়ে ওঠে। তবে বিগত বন্যাগুলোর সময় বন্যার ভয়াবহতা, ত্রাণ-দুর্নীতি, সাহায্য না পাওয়া, ক্ষয়-ক্ষতির বিবরণ এবং রাষ্ট্র-জনতার অসহায়ত্ব নিয়ে বেশি আলাপ হতো। তবে সাম্প্রতিক বন্যায় ট্রান্সবাউন্ডারি-ডিক্টেরটরশিপ থেকে শুরু করে ন্যায্য পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা—সব নিয়েই বাহাস উঠেছে। যেন জুলাই ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান বহু আলাপের দুয়ার খুলেছে। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, তাপদাহ কিংবা অনাবৃষ্টির মতো আপদ বা হেজার্ড হলে অবশ্যই তা বাস্তুতন্ত্র এবং জনজীবনে বিপদ বা ভালনারাবিলিটি তৈরি করে। আপদ হলে বিপদ বাড়ে। তবে সবক্ষেত্রে সবার জন্য বিপদ বাড়ে না। যারা বেশি ঝুঁকিতে থাকে তাদের বেশি বিপদ হয়। অর্থনৈতিক, পরিবেশগত, সামাজিক, রাজনৈতিক নানাবিধ ঝুঁকি থাকতে পারে।

আপদ বা হেজার্ডকে আটকানো যায় না কিংবা নোটিশ দিয়ে বন্যাকে বন্ধ করা যায় না। আপদ হলে যাতে বিপদ না বাড়ে, এর জন্য প্রস্তুতি দরকার হয়। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, বাস্তুতন্ত্র ও রাষ্ট্রের প্রস্তুতি। কিংবা আন্তঃরাষ্ট্রিক, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক প্রস্তুতি। যত বেশি প্রস্তুতি তত বেশি ঝুঁকি কমানো সম্ভব। ঝুঁকি কমলে আপদ হলেও বিপদ কম হয়। তাই দেখা যায় সব ধরনের আপদে সবাই সমানভাবে দুর্গতিতে পড়ে না। কেউ কম, কেউ বেশি, কেউ ভয়াবহভাবে বেশি। আবার কারো কারো দুর্গতি জোর করে আড়াল করা হয়। সামাজিক প্রান্তিকতা, কাঠামোগত বৈষম্য, নিওলিবারেল করপোরেট বাজার কিংবা রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব জনগণ এবং বাস্তুতন্ত্র বা ইকোসিস্টেমের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে। তাই দেখা যায়, কেবলমাত্র ত্রাণ বা সহযোগিতা কিংবা অবকাঠামোগত উন্নয়ন করেও কোনোভাবেই কোনো আপদজনিত বিপদ ও ঝুঁকি সামাল দেওয়া সম্ভব নয়। এর জন্য দরকার সর্বস্তরে আমূল সংস্কার। বহুস্তরের সর্বজনীন, অংশগ্রহণ এবং অর্ন্তভূক্তিমূলক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা জরুরি।

তাহলে কী করতে হবে? দেশের সব প্রান্তের শ্রেণি-পেশা-বয়স-লিঙ্গসহ সব বর্গের মানুষকে যুক্ত করলেই কী এই ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা সম্ভব? না সম্ভব নয়। সবার অংশগ্রহণ অত্যন্ত মিনিংফুল হতে হবে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সবার কাজ ও অবদানকে স্বীকৃতি দিয়ে মর্যাদাজনক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। কিন্তু স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পার হলেও এই অর্ন্তভূক্তিমূলক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কাঠামোটি আমরা গড়ে তুলতে পারিনি।

কেন পারিনি? কারণ আমাদের ভেতর টিকে থাকা প্রবল হেজিমনি, ক্ষমতার দম্ভ, বাইনারি দৃষ্টিভঙ্গি আর কতৃর্ত্ব। বিগত সময়ের সব কর্তৃত্ববাদী রেজিমে আমরা তাই দেখেছি। বলা হয়, বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কাঠামো খুব শক্তিশালী এবং বিশ্বে উদাহরণমূলক। দুর্যোগ পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র দ্রুত সাড়া দেয়। দেখা যায়, কেবল কোনো আপদ বা হেজার্ড আঘাত করলে সেই দুর্যোগ পরিস্থিতিতে তৎপর হয় রাষ্ট্র। কিন্তু বাদবাকি সময়টা এক প্রশ্নহীন হাইবারনেশনে কাটায়। সব অঞ্চলের জন্য রাষ্ট্রের দুর্যোগ প্রস্তুতি ও ব্যবস্থাপনা সমানতালের নয়। তাই দেখা যায়, কেবল ঘূর্ণিঝড় উপদ্রুত উপকূলেই কেবল আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি হয়। কিন্তু খরাপ্রবণ বরেন্দ্র কিংবা আকস্মিক বন্যাপ্রবণ হাওরাঞ্চলে আশ্রয়কেন্দ্রের অভাব।

সাম্প্রতিক ফেনী, লক্ষ্মীপুর, খাগড়াছড়ি কিংবা নোয়াখালীর বন্যায় দেখা গেল দুর্যোগপ্রস্তুতির অভাবের কারণে জনজীবনে ভোগান্তি বেশি হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়েছে। দুর্যোগপ্রস্তুতির ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে দেশের সব ভৌগলিক ভিন্নতা ও সব সামাজিক বর্গকে সমান গুরুত্ব দিতে হবে। মানুষ, প্রাণপ্রকৃতি ও বাস্তুতন্ত্রের জানমাল সুরক্ষাকে অবজ্ঞা ও অবহেলার দৃষ্টিতে দেখার প্রবণতা বদলাতে হবে। দেশে ৩০টি অ্যাগ্রোইকোলজিক্যাল জোন, ১৭টি হাইড্রোলজিক্যাল জোন আছে। বরেন্দ্র, বিল, চর, উপকূল, বন, গড়, পাহাড়, সমতল এবং শহর এলাকা আছে। দুর্যোগের ধরন এবং ক্ষয়ক্ষতির ধরন দেশের সব অঞ্চলে এবং নানা সামাজিক বর্গের জীবনে একরকম নয়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার লোকায়ত জ্ঞান এবং জনগোষ্ঠীর তৎপরতাকে জানাবোঝা খুব জরুরি।

লোকায়ত দুর্যোগ প্রস্তুতি জ্ঞানকে জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কাঠামোতে আমরা এখনো যুক্ত করতে পারিনি। কর্তৃত্ববাদী জ্ঞানকাঠামো লোকায়ত জ্ঞানকে সর্বদাই কোণঠাসা করে রাখে। বর্তমানে বাংলাদেশে খুব কম গ্রামীণ সমাজ পাওয়া যাবে যেখানে খনার বচন সক্রিয়ভাবে অনুশীলন হয়। বহু লোকায়ত দুর্যোগ জ্ঞান ও প্রস্তুতির শক্তি নিদারুণভাবে নিখোঁজ হয়েছে। বর্তমানে গ্রামে গ্রামে খুব কম তরুণ খুঁজে পাওয়া যায় যারা বন্যা, খরা বা কোনো দুর্যোগের আগাম পূর্বাভাস পাঠ করতে জানে। দেশে খুব কম জায়গা আছে যেখানে স্থানীয় জেনেটিক রিসোর্স এবং প্রাকৃতিক সম্পদ টিকে আছে, যা কোনো এলাকার দুর্যোগ প্রস্তুতি এবং দুর্যোগ-পরবর্তী সংকট মোকাবিলায় টেকসই ভূমিকা রাখে।

তাহলে আমরা কীভাবে দুর্যোগ প্রস্তুতি নেবো বা মোকাবিলা করব? কিংবা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার নামে নিওলিবারেল মিথ্যা সলিউশনগুলো বারবার বৈধ করব? এসবকে মিথ্যা সলিউশন কোনোভাবেই দুর্যোগ-রেজিলিয়েন্ট সমাজকে বিকশিত করে না। বরং দুর্যোগ-ব্যবস্থাপনার নামে দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, মুনাফা, দখলদারিত্ব এবং করপোরেট বাজারকে জায়েজ করে। অঞ্চল ও জনগোষ্ঠীভিত্তিক লোকায়ত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা জ্ঞানগুলো কেন আমরা হারাতে বাধ্য হলাম তার তদন্ত জরুরি। রাষ্ট্র ও কর্তৃত্ববাদী রেজিমের ভূমিকা সেখানে কেমন ছিল তা খতিয়ে দেখাও জরুরি।

লস অ্যান্ড ড্যামেজ বিতর্ক এবং কমিউনিটি রেজিলিয়েন্স

প্রতিটি দুর্যোগের ক্ষেত্রে তিনটি পর্বে প্রস্তুতি খুব গুরুত্বপূর্ণ। দুর্যোগের আগে, দুর্যোগের সময় এবং দুর্যোগ-পরবর্তী প্রস্তুতি। বৈশ্বিক সেন্দাই ফ্রেমওয়ার্কের টার্গেট অনুযায়ী দুর্যোগের সময় দ্রুত সাড়া প্রদান এবং জানমাল রক্ষাই সর্বোচ্চ প্রায়োরিটি হিসেবে দেখা হয়। দুর্যোগ-পরবর্তী সময়ের আরেক প্রায়োরিটি হলো রিহেবিলিটেশন। কিন্তু কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ রিহেবিলিটেশন নিয়ে লম্বা তর্ক আছে। কারণ কৃষিগত রিহেবিলিটেশনের নামে অধিকাংশ সময় দুর্গত এবং নিঃস্ব মানুষকে কোনো সহযোগিতা নয়, বরং খুব কৌশলে টার্গেট করা হয়। বহুজাতিক কোম্পানির কনজিউমার বানানোর টার্গেট। দেখা গেছে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, শিলাবৃষ্টি, কোল্ড-ইনজুরি, খরা বা লবণাক্ততার কারণে ধানসহ বহু শস্যফসলের জাত হারিয়ে যায়। অনেক মাছ ও গবাদি প্রাণিসম্পদ হারিয়ে যায়। বহু প্রাণ-প্রজাতি নিখোঁজ হয়, বিচরণ অঞ্চল ত্যাগ করে। প্রতিটি দুর্যোগ প্রকৃতি ও সংস্কৃতিতে ক্ষয়ের দুঃসহ দাগ রেখে যায়।

এই ক্ষয়ক্ষতি কীভাবে রিহেবিলেট করা সম্ভব? কেবলমাত্র টাকা দিয়ে কি কোনো ক্ষয়ক্ষতি পূরণ করা সম্ভব? বস্তাবোঝাই তহবিল দিয়ে কি কোনোভাবেই বন্যার কারণে হারিয়ে যাওয়া কোনো ধান বা গানকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব? দুর্যোগের কারণে লবণাক্ত উপকূলের গ্রাম থেকে দেশজ লবণসহনশীল জাত হারিয়ে গেলে সেই এলাকার কৃষি রিহেবিলিটেশনের জন্য কোনোভাবেই প্যাকেটজাত হাইব্রিড বীজ কোনো টেকসই সমাধান নয়। বরং সেটি আরও নতুন সংকট ও দুর্গতি তৈরি করে। এর বহু প্রমাণ ও দুঃসহ যন্ত্রণার নজির আছে। তাহলে আমাদের দুর্যোগ পরবর্তী কৃষি-রিহেবিলিটেশন ব্যবস্থাপনা কী হতে পারে? মূলত লোকায়ত জ্ঞান এবং স্থানীয় জেনেটিক রিসোর্স-নির্ভর সুরক্ষা ও রিহেবিলিটেশন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। প্রতিটি দুর্যোগে বিপুল জেনেটিক রিসোর্স এবং লোকায়ত জ্ঞান ক্ষতিগ্রস্ত হয়, বহুকিছু হারিয়ে যায়।

অধুনা জলবায়ু-ডিসকোর্সে এর নাম দেওয়া হয়েছে লস অ্যান্ড ড্যামেজ (এলঅ্যান্ডডি)। এই এলঅ্যান্ডডি ইকোনমিক এবং নন-ইকোনমিক হয়। ইকোনমিক এলঅ্যান্ডডি নিয়ে কিছু আলাপ হলেও নন-ইকোনমিক এলঅ্যান্ডডি নিয়ে খুব বেশি আলাপ নেই। রাষ্ট্র কোনোদিন নন-ইকোনমিক লস অ্যান্ড ড্যামেজ নিয়ে কোনো তালিকা বা বিবরণ তৈরি করেনি। ২০২৪ সালের আগস্টে বন্যার কারণে কোনো ধান, বিশ্বাস, লোককথা, গান, লোকায়ত জ্ঞান বা দেশীয় বীজ হারিয়ে গেলে রাষ্ট্র কি জাতীয় ক্ষয়ক্ষতির প্রতিবেদনে এসব উল্লেখ করবে না? হারিয়ে যাওয়া এসব জেনেটিক ও কালচারাল রিসোর্স গ্রামীণ জনপদের ইতিহাস এবং আত্মপরিচয়ের অংশ। বন্যাদুর্গত অঞ্চলের দেশজ প্রাণসম্পদ ও লোকায়ত জ্ঞান কাঠামো সুরক্ষায় ছাত্র-জনতার জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী রাষ্ট্র কী ধরনের ব্যবস্থা নেবে? কোন ধরনের রিহেবিলিটেশন কর্মসূচি পরিকল্পনা করছে রাষ্ট্র? নাকি রাষ্ট্র ঠিক আগের কর্তৃত্ববাদী রেজিমের মতোই জনগণের জেনেটিক রিসোর্স ও জ্ঞান কাঠামোকে অবজ্ঞা করবে। দোকান থেকে প্যাকেটের বীজ কিনে গ্রাম সয়লাব করে দেবে? বন্যা-পরবর্তী কৃষি প্রণোদনার নামে বহুজাতিক বীজ কোম্পানির বাণিজ্যকে প্রমোট করবে? তাহলে বন্যা-পরবর্তী রিহেবিলিটেশন তৎপরতার ক্ষেত্রে কৃষিপ্রশ্নে অভ্যুত্থানের আগের ও পরের রাষ্ট্রের অমিল কোথায়? রাষ্ট্র সংস্কার প্রশ্নে এসব মৌলিক জিজ্ঞাসার উত্তরগুলো আমাদের খুঁজতে হবে। দুর্যোগ প্রস্তুতি এবং ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে দেশীয় জেনেটিক রিসোর্স এবং লোকায়ত জ্ঞান সুরক্ষার প্রসঙ্গ সংবিধানে যুক্ত করতে হবে। জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং কৃষিবিষয়ক রিহেবিলিটেশনের ক্ষেত্রে নিওলিবারেল কর্তৃত্বগুলো খারিজ হওয়া দরকার। জুলাই অভ্যুত্থানের ছাত্র-জনতার স্পিরিট এই ইফেক্টিভ ট্রান্সফর্মেশনে আমাদের শক্তি জোগাতে পারে।

গ্রাম থেকে কি দেশীয় জাত ও জ্ঞান হারিয়ে যাবে

বাংলাদেশে মৈতৈ, বিষ্ণুপ্রিয়া ও পাঙাল মণিপুরীদের প্রধান বসতি অঞ্চল মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ। আগস্টে বন্যায় আন্তঃসীমান্ত ধলাই নদীর পানিপ্রবাহে বন্যায় তলিয়ে গেছে বহু মণিপুরী গ্রাম ও কৃষিজমিন। কমলগঞ্জের ইসলামনগর ইউনিয়নের গঙ্গানগর গ্রামের ভূমেশ্বর সিংহ (৬৫) এ বছর আমন মৌসুমে প্রায় ৬০ শতক জমিতে পানিবিরন দেশি ধান চাষ করেছিলেন। এই জমি থেকে ধান পেতেন প্রায় ১৪০ পুরা (এক পুরা সমান পাঁচ কেজি)। এ ছাড়া তিনি বাকি জমিতে উফশী বিআর-১১ ও রঞ্জিত ধান চাষ করেছিলেন। আগস্টে বন্যায় তার সব ফসল তলিয়ে গেছে। পানিবিরন একটি গভীর পানির স্টিকি ধান জাত। ধান গাছ প্রায় চার ফুট লম্বা, ধান মোটা ও লম্বাটে, ধানে কালো দাগ আছে।

মণিপুরীদের ভেতর এই জাতটি চাষ করার প্রবণতা নতুন। মূলত আগের দিনে আমন মৌসুমে মধুমালতী, গাড়ই, নাগ্রাশাইল, ইন্দ্রশাইল, লাঠিহাল, সয়ামরা এবং বিভিন্ন ধরনের স্টিকি রাইস চাষ করতেন। সবচেয়ে বিখ্যাত সুগন্ধি স্টিকি রাইস ছিল চৌওয়া আমুগি। ধানটি কালো এবং চাল কালচে লাল। এই ধান মূলত কাবকের (খই) জন্য চাষ করা হতো। এ ছাড়াও সাদা বিরন ও পরীতন বিরন চাষ হতো আগে। কিন্তু কর্তৃত্ববাদী গ্রিন রেভ্যুলেশন প্রকল্পের কারণে মণিপুরী সমাজের কৃষিব্যবস্থাও আমূল পাল্টে যেতে বাধ্য হয়। নিদারুণভাবে হারিয়ে যেতে থাকে দেশি জাত। একইসঙ্গে নানামুখী উন্নয়ন ও পরিবেশগত সংকট এবং নিওলিবারেল আগ্রাসনও দেশি ধানবৈচিত্র্যকে নিখোঁজ করতে থাকে। বছর বছর উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে তলিয়ে যায় গ্রাম। জলবায়ু সংকটের কারণে আগস্টের বন্যার মতো অতিবর্ষণ এবং পাহাড়ি ঢলের প্রবণতা বাড়তে থাকে। চৌওয়া আমুগির মতো স্টিকি রাইস মণিপুরী সমাজের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য।

আগস্টের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক ভূমেশ্বরের বাবা নাতেক সিংহ কিংবা দাদু যাইমা সিংহ সেইসব স্টিকি রাইস আবাদ করতেন। কিন্তু গত ২০ বছরে নানামুখী পরিবর্তনের কারণে তাদের দরকার হয় পানিতে টিকে থাকার মতো জাত। আগের দিনে আউশ মৌসুমে চেংড়ি, কাচালত, ডুমাইয়ের মতো জাতগুলো মণিপুরী গ্রামেও চাষ হতো। পানিবিরন স্টিকি রাইস জাতটি তারা হাওর-জলাভূমি থেকে সংগ্রহ করেন। জলাবদ্ধ পানির ভেতর গাছটি বাঁচতে পারে, কিন্তু পুরো গাছ ডুবে গেলে পঁচে গিয়ে মারা যায়। আগস্টের বন্যায় তাই ঘটেছে, পানির উঁচু প্লাবন সব ডুবিয়ে দেয়। সবকিছুর সঙ্গে স্টিকি রাইস হারিয়ে মণিপুরী সমাজে এখন অন্য এক অস্থিরতা ও শঙ্কা।

একই গ্রামের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত আরেক প্রবীণ কৃষক নবীন্দ্র সিংহ (৭০) জানান, দেশি ধান জাতগুলো মণিপুরী সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত। স্টিকি রাইস দিয়ে চিনি তান, নাড়-তান, মারই তান, চাহাউ তান কিংবা যুবি তানের মতো ঐতিহ্যবাহী মণিপুরী পিঠা বানানো হয়। স্টিকি রাইসের কাবক (খই) অপোকপা, লাওহারাইবাসহ মণিুপরী রিচুয়াল ও বিয়েতে লাগে। ঐতিহ্যবাহী ইন্দ্রশাইল ও গচাশাইল ধানের 'চাক্কি চানাঙ (ভাতের মাড়)' দিয়ে 'চাক্কি চাবন (মন্ড)' বানানো হয়। ঐতিহ্যবাহী মণিপুরী তাঁতবয়নে দেশি ধানের চাক্কি চাবন ব্যবহৃত হয়। নবীন্দ্র সিংহের বাবা ব্রজধন সিংহ, দাদু নিথৌখম্বা সিংহ বা পইদাদু লেইসান সিংহরা দেশি জেনেটিক রিসোর্সগুলো যুগের পর যুগ রক্ষা করেছিলেন। 
কিন্তু নতুন মণিপুরী প্রজন্ম দেশি জেনেটিক রিসোর্স ও লোকায়ত জ্ঞান থেকে ক্রমেই বিচ্ছিন্ন হতে বাধ্য হচ্ছেন। তাহলে বন্যা-পরবর্তী রিহেবিলিটেশন কার্যক্রমে রাষ্ট্র এখন কী করবে? স্টিকি রাইসসহ দেশি জাতের বীজ ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের দিতে সরবরাহ করতে পারবে? বীজ পাবে কোথায়? রাষ্ট্র তো দেশি জাত সংরক্ষণ করে না। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র বরাবর যা করে তাই করবে। কোনো না কোনো বহুজাতিক কোম্পানির বীজ বিক্রিকে প্রমোট করবে। তাহলে এমনতর প্রশ্নহীন রিহেবিলিটেশন কি কোনোভাবেই জেনেটিক রিসোর্স ও জ্ঞানের ওপর কৃষকের সার্বভৌম মালিকানা প্রতিষ্ঠিত করতে পারে? কিংবা প্রতিনিয়ত ঘটতে থাকা জলবায়ু পরিবর্তনসহ নানামুখী সংকট কি কৃষকের জাত ছাড়া সামাল দিতে পারে? তাহলে দুর্যোগ প্রস্তুতি হিসেবে রাষ্ট্রের অবস্থান জনমুখী ও স্থানীয় বাস্তুতন্ত্র উপযোগী হতে হবে।

গঙ্গানগর গ্রামের প্রবীণ কৃষকেরা জানালেন, আগের দিনে কৃষক নিজের ঘরেই দেশি বীজ সংরক্ষণ করতে পারত। কিন্তু পরবর্তীতে উফশী ও হাইব্রিড আসার পর এটি আর সম্ভব হয়নি। 'থৗরি কনবা' নামের দেশি ধান জাত সংরক্ষণের এক লোকায়ত প্রযুক্তি ছিল আগে মণিপুরী গ্রামে। সেসব হারিয়েছে। একইসঙ্গে আলাপ হয় নোয়াখালীর সুবর্ণচরের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত বাঙালি কৃষক আলাউদ্দির মাজির (৫০) সঙ্গে। সমুদ্রগামী জেলে পেশা ছেড়ে বর্তমানে কৃষিকাজ করছেন। আগস্ট বন্যায় তার আড়াই একর জমির ধান নষ্ট হয়েছে। সবজি, পেঁপে ও ফলের বাগান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রাজাহাইল, পুটিহাইল, কালো হাইল, গুডি ধান আগে চাষ করলেও এখন মূলত উফশী আর হাইব্রিড চাষ করেন। এমনকি ঝলক ও আলোক নামের হাইব্রিড ধান বীজ কিনে তার এলাকায় বহু কৃষক প্রতারিত হয়েছেন বহুবার। এর আগেও ১৯৯১ ও ১৯৯৮ সালের বন্যায় তারা বহু দেশি জাত ও ফসল হারিয়ে ফেলেন। এখনো নারীরা দেশিজাতের চিচিঙ্গা, করলা, মিষ্টিকুমড়া, পাতিলাউয়ের বীজ ঘরে ঘরে সংরক্ষণ করেন। বন্যা-দুর্গতি কমলে তারা আবারও দেশি বীজের সন্ধানে নামবেন।

১৯৯৮ সালের বন্যা-পরবর্তী তৎপরতা যেন ফিরে না আসে

১৯৯৮ সালে দেশে বন্যা-পরবর্তী খাদ্য শস্যের ঘাটতি এড়াতে জাতীয় বীজ বোর্ড বেসরকারি কোম্পানির মাধ্যমে দুই হাজার ২০০ মেট্রিক টন হাইব্রিড বীজ আমদানির সুযোগ করে দেয়। এসিআই, গ্যাঞ্জেস, ম্যাকডোলাল্ড ও মল্লিকা সিড কোম্পানিকে কিছু চুক্তি ও শর্তসাপেক্ষে হাইব্রিড বীজ আমদানির অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। তারা কেউ শর্ত মানেনি। পরবর্তীতে দেখা গেছে, বহু কোম্পানিকে বীজ বাণিজ্যের জন্য নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে। মানহীন বীজ বিক্রি করে বহু কোম্পানি কৃষককে প্রতারিত করেছে। ২০১০ সালে বরেন্দ্র অঞ্চলে সিনজেনটা কোম্পানির হাইব্রিড সবল নামের টমেটো বীজ প্রতারণা এক্ষেত্রে বেশ আলোচিত। কারণ সিনজেনটার বিরুদ্ধে মামলা ও জনআন্দোলন হলেও রাষ্ট্র কৃষকের বীজ-ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে পারেনি।

জুলাই অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে ছাত্র-জনতা রাষ্ট্র সংস্কারের আওয়াজ তুলেছে। বন্যা-পরবর্তী রিহেবিলিটেশন কার্যক্রমসহ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও আমাদের কর্তৃত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গি এবং তৎপরতার সংস্কার প্রয়োজন। বন্যা-দুর্গত প্রতিটি অঞ্চলের জন্য কৃষকের মতামত ও অংশগ্রহণের ভেতর দিয়েই এলাকা উপযোগী প্রকৃতি ও সংস্কৃতিবান্ধব প্রণোদনা ও রিহেবিলিটেশন কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। দেশীয় জেনেটিক রিসোর্স এবং লোকায়ত জ্ঞান সুরক্ষাকে কমিউনিটির শক্তিশালী দুর্যোগ প্রস্তুতি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া জরুরি। গ্রামে গ্রামে দেশি শস্যফসলের বীজ ব্যাংক এবং দেশব্যাপী কৃষক-কৃষক বীজ বিনিময় তৎপরতাকে অন্যতম রাষ্ট্রীয় কৃষিকর্মসূচি হিসেবে যুক্ত করা দরকার। আগস্টের বন্যায় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের ক্ষয়ক্ষতিও ব্যাপক। আমাদের দেশজ জাতগুলো দুর্যোগ মোকাবিলায় বেশি সক্ষম। এক্ষেত্রেও দেশীয় জাত ও লোকায়ত প্রাণিসম্পদ ব্যবস্থাপনাকে অগ্রাধিকার দেওয়া জরুরি।

পাভেল পার্থ: বাস্তুতন্ত্র ও বৈচিত্র্য বিষয়ক গবেষক, লেখক

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English

Talks with Yunus: UN chief reaffirms support for Bangladesh's reforms

United Nations Secretary-General Antonio Guterres met with Chief Adviser Prof Muhammad Yunus in New York today

3h ago