কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যোগসূত্র নিয়ে হারারির নেক্সাস

হারারির এই ‘নেক্সাস’ এক চিমটি ফ্যাক্ট আর বাকিটা ফিকশনের নামান্তে অদ্ভুত এক পরিবেশনা। তবে সমাজের বিপরীতে তথ্য প্রযুক্তিকে দেখার ক্ষেত্রে তার চিন্তাটা নিঃসন্দেহে অভিনব এবং গুরুত্ব বহন করে।

কোনো চ্যাটবট কী আসলেই সাহিত্যিক দিক থেকে নতুন কিছু সৃষ্টি করতে পারে? কিংবা নানাদিক থেকে ধারণা দেওয়ার পর একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নির্দেশিত সফটওয়্যার যে চিত্রকর্ম তৈরি করে তার সৃষ্টিশীলতাকে কীভাবে দেখবেন? এমনি নানা প্রশ্ন আমাদের কাছে নতুন নয়।  ব্যক্তি হিসেবে ইউভাল নোয়াহ হারারির যে মনোবৃত্তি, তার রাজনৈতিক অবস্থান থেকে তাকে একপাশে না রাখলে তার লেখাগুলোর বিচার যথাযথ সম্ভব নয়।

পাথর যুগের শিকারী ও সংগ্রাহক মানুষের জীবনযাত্রায় প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ড আবর্তিত হয়েছিল শুধু খেয়ে পরে বাঁচার তাড়নাকে সামনে রেখে। আমরা কাগজে কলমে তার প্রথম যৌক্তিক প্রস্ফূটন দেখি হেনরি রাইডার হ্যাগার্ডের প্রখ্যাত 'অ্যালান অ্যান্ড দ্যা আইস গডস' এর নামান্তে। সেটা যদি হয় ফিকশন সেখানে হারারির এই 'নেক্সাস' এক চিমটি ফ্যাক্ট আর বাকিটা ফিকশনের নামান্তে অদ্ভুত এক পরিবেশনা। তবে সমাজের বিপরীতে তথ্য প্রযুক্তিকে দেখার ক্ষেত্রে তার চিন্তাটা নিঃসন্দেহে অভিনব এবং গুরুত্ব বহন করে।

স্যাপিয়েন্সের মূল ভিত্তি মনে হয়েছিল সাংস্কৃতিক বিবর্তনের আলোকে বৃদ্ধিমত্তার বিকাশকে তুলে ধরা। পাশাপাশি 'হোমো ডিউস' কিংবা 'টুয়েন্টি ওয়ান লেসন্স ফর দা টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি' ছিল স্যাপিয়েন্সের হিসেবে অনেকটাই সরলরৈখিক। আর 'নেক্সাস: এ ব্রিফ হিস্টরি অব ইনফর্মেশন নেটওয়ার্কস ফ্রম স্টোন এইজ টু এ আই' অনেকটাই বিপ্রতীপ। আমরা এতোদিন তথ্যকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে তার ব্যাপারে যে 'নিষ্পাপ দৃষ্টিভঙ্গি' হাজির করেছিলাম হারারির চিন্তা ঠিক সেটাকেই চ্যালেঞ্জ করেছে মধ্যযুগের ইউরোপের বাস্তবতার আলোকে। আমরা সেখানে দেখি গুটেনবার্গের ছাপাখানা শুধু বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ ঘটিয়েছিল এমন নয়। তার বিপরীতে 'ডাইনি শিকারীদের' জঘন্য ও মর্মান্তিক চিন্তাধারাকেও বিস্তৃত করেছিল দেশজুড়ে।

ছাপানো বই সামনে রেখে ইউরোপীয়দের ভৌগোলিক সম্প্রসারণবাদের নীতি বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের নানা সম্ভবনাকে কাত করে ফেলেছিল এমন কিছু ভুতুড়ে চিন্তা যা সভ্যতার বিপরীতে মানব মনের উপর চেপে বসেছিল সিন্দাবাদের ভূতের মতো। তারা তথ্যকে সামনে রেখে অনেক সময় একটি খড়ের টুকরাকেও পরিণত করেছিল ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের দানবে। তাই তথ্যের নিষ্পাপ দৃষ্টিভঙ্গির ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করার উপযুক্ত কারণ পাওয়া যায়। পূর্বতন ধারণার আলোকে তথ্য ছিল দুর্দান্ত একটা জিনিস, এবং এটি যত বেশি আমাদের কাছে আছে ততই ভাল ও যৌক্তিক। বেশিরভাগ মানুষ আগে বিশ্বাস করেছেনব তথ্য যার হাতে সত্যটাও তার পক্ষে এবং তথ্যের সাথে তর্ক করা কঠিন। ফলাফল হিসেবে তথ্যনির্ভরতার এই ধারণা অনুমিতভাবে কোনো জাতি, ব্যক্তি কিংবা গোত্রকে অনেকটা অনিচ্ছাকৃতভাবেই হুট করে পূর্ব নির্ধারিত কোনো রাজনৈতিক প্রজ্ঞার দিকে নিয়ে যায়। কারণ তখনকার সমাজে বিশ্বাস ছিল তথ্যের অবাধ প্রবাহ অনিবার্যভাবে সত্যের দিকেই কেবল নিয়ে যায়।

১৯৮৭ সালের দিকে ব্রুনো লাতুর 'সায়েন্স ইন অ্যাকশান' শীর্ষক গ্রন্থে তথ্য ও বিজ্ঞান নিয়ে যেভাবে নতুন একটি ধারণার উত্তরণ ঘটান সেখানে ক্ষেত্রবিশেষে তথ্যও অপাংক্তেয় হয়ে গিয়েছিল। আমরা বুঝতে শুরু করে প্রেক্ষিতের বাস্তবতায় তথ্যও এমন একটি প্রস্তাব হয়ে যেতে পারে যা কেউ বিশ্বাস করে না। ঠিক তেমনিভাবে আমাদের এটাও মেনে নিতে হয় যে E=mc2 এর মতো সূত্রগুলো বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যতটা গুরুত্বপূর্ণ হোক না কেনো রাজনৈতিক মতপার্থক্যের সমাধান করার ক্ষেত্রে এর কোনো ভূমিকাই নাই।

আমরা বিশ্বের নানা দেশের স্বৈরাচারী, সর্বগ্রাসী এবং ফ্যাসিবাদী সরকারের ইতিহাস পর্যালোচনা করতে গেলে দেখি তথ্য সংগ্রহ ও নিয়ন্ত্রণে তাদের প্রচেষ্টা কতটুকু ছিল। তারা মূলত বিভিন্ন গণমানুষের তথ্য সংগ্রহ করে তাদের উপর প্রভাব বিস্তার করতে চেয়েছে। তাদের কাছে তথ্য ছিল জনদলনের মূল হাতিয়ার এবং স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতাকাঠামোকে শক্তিশালী করে তোলার মূল পাথেয়। তথ্যের অবাধ প্রবাহ সামনে রেখে একটি আধুনিক কম্পিউটার ও ডাটা এনালিসিস যন্ত্র কী কী করতে পারে তারা আমরা জানি। এর সমান্তরালে আমাদের 'চিন্তাকাঠামো' ঠিক এতটুকু কী গম করতে পারে? উত্তর হবে খুব সম্ভবত 'না'।

ইইভাল নোয়াহ হারারি ঠিক এখানেই গুরুত্বপূর্ণ মাধ্য হিসেবে 'AI' তথা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় প্রত্যাবর্তনের যুক্তি খুঁজেছেন। তিনি মনে করেন বিপণন মাধ্যম হিসেবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যতটা চিত্তাকর্ষক তার কর্মকাণ্ডের পরিসর ঠিক ততটাই জটিল। আর সে হিসেবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যান্ত্রিক পরিকাঠামোও তার উপর অর্পিত দায়িত্ব ও আরোপিত ক্ষমতা সম্পর্কে অদ্ভুতভাবে বিশ্বাসী বলে প্রতীয়মান। অন্যদিকে স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতা  কাঠামোকে শক্তিশালী করে তোলার ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উপর নির্ভরশীলতায় সফলতা শতভাগ। কারণ আগে থেকে সেট করে দেওয়া প্রোগ্রামের বাইরে কেউ এখনও কোনো একটি চ্যাটবটকে নতুন ধারণা তৈরি করতে দেখেনি। এমনকি এই চ্যাটবটগুলো নতুন ধারণা তৈরির সম্ভবনাও রাখে না। তাই চ্যাটবট কিংবা এই জাতীয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নির্দেশিত যান্ত্রিক পরিকাঠামোতে 'নির্দেশ প্রদান' ও 'আদেশ পরিপালনের' বাইরে তেমন কিছুই করার থাকে না।

মধ্যযুগের ইউরোপে ছাপাখানার মাধ্যমে ছড়ানো গুজব ডাইনিশিকারীদের ভয়াবহতা বাড়িয়ে দিয়েছিল আরও কয়েক ধাপ। তাদের অসুস্থ প্রচারের মাধ্যমে বেড়ে গিয়েছিল হিংস্রতাও। আর সেদিক থেকে চিন্তা করলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরাসরি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নিয়ন্ত্রণ ও সম্প্রচার ব্যবহৃত হলে তা দৃশ্যত ভীতিজনক অর্জন বলেই প্রতীয়মান।

বিজ্ঞানীরা এই বিষয়টি বুঝতে পেরে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কমান্ডে কিছু স্বতন্ত্র সক্ষমতা যুক্ত করতে চেয়েছিলেন। আর এগুলোর মধ্যেই ভীতিকর সম্ভাবনা খুঁজে বের করেছেন হারারি। তিনি শুরুতে আশাবাদী যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আলোকেও শিল্পকর্ম তৈরি করা যেতে পারে। এগুলো কেবল তার প্রশিক্ষণ ডেটাতে বিদ্যামান প্যাটার্নগুলির সম্ভাব্য পুনর্মিলন নয় তার বাইরেও নতুন কিছু সৃষ্টির সক্ষমতা রাখে। যার মাধ্রমে শক্তিশালী কম্পিউটারগুলিও তার মধ্যে বিদ্যামন 'ডাটা সোর্স' কাজে লাগিয়ে উপযুক্ত সাংস্কৃতিক উদ্ভাবন করতে পারে। তবে এই উদ্ভাবনের বাইরে শঙ্কার যে সম্ভাবনা সেটাকে উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ নাই।

পাথর যুগের প্রাথমিক পর্বে মানুষ ছিল 'শিকারী ও সংগ্রাহক'। কারও মতে তারা উদ্ভিজ উপাদাবন সংগ্রহ করতে তেমন একটা সংগ্রাম করেনি যতটা করতে হয়েছিল শিকার ধরতে গিয়ে। তারপর মধ্যপ্রস্তুর যুগের সুক্ষ্মফলার অস্ত্র তাদের শিকারমুখী করে। হলোসিনের বৃষ্টিবহুল অস্থিতিশীল প্রতিবেশ ও আবহাওয়া তাদের বাধ্য করেছিল স্থায়ী আবাসনে। তারা এই সময় জীবনের মূলমন্ত্র হিসেবে গ্রহণ করে কৃষিকাজ কিংবা বিভিন্ন পশুর গৃহপালনের নতুন ধারাকে। হারারির মতে 'কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নতুন সারবত্তা কিংবা সর্বেসর্বা' অবস্থানও শুরুতে আশাবাদী করেছে। তবে তা অনেক শঙ্কার দিকেও দৃষ্টি ফেরাতে আমাদের বাধ্য করে।

মধ্যযুগের ইউরোপে ছাপাখানার মাধ্যমে ছড়ানো গুজব ডাইনিশিকারীদের ভয়াবহতা বাড়িয়ে দিয়েছিল আরও কয়েক ধাপ। তাদের অসুস্থ প্রচারের মাধ্যমে বেড়ে গিয়েছিল হিংস্রতাও। আর সেদিক থেকে চিন্তা করলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরাসরি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নিয়ন্ত্রণ ও সম্প্রচার ব্যবহৃত হলে তা দৃশ্যত ভীতিজনক অর্জন বলেই প্রতীয়মান। এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষকে তাড়িত ঐশ্বরিক ক্ষমতার কাছাকাছি। ধারা যাক  একজন এআই ওভারলর্ড নতুন কোনো ভাইরাস তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার কর্মক্ষমতা অনেকটা নিউক্লিয়ার চেইন বিক্রিয়ার মতো। তাকে দমন করার ক্ষমতা স্বাভাবিক মানুষের জন্য নিতান্তই সীমিত হয়ে যেতে পারে। একইভাবে তথ্যসন্ত্রাস চালিয়ে দাঙ্গা বাধানোর মতো ভয়াবহ কাজ করার ক্ষেত্রেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে যা নিঃসন্দেহে কোনো নতুন মহামারী সৃষ্টির সক্ষমতা রাখে। 

নানা সমস্যা চিহ্নিত করে তার বাইরে কিছু সম্ভাবনাকে নিজের মতো করে বর্ণনা দেওয়ার মধ্য দিয়ে হারারি শেষ করেছেন তার 'নেক্সাস: এ ব্রিফ হিস্টরি অব ইনফর্মেশন নেটওয়ার্কস ফ্রম স্টোন এইজ টু এ আই'। তিনি হঠাৎ করে  'সিলিকন কার্টেন' এর রেফারেন্স টেনে 'AI-এর তুলনায় ভূ-রাজনীতির সমস্যা' কে বড় করে দেখিয়েছেন। ফায়ারওয়ালের মাধ্যমে এক্সট্রাপোলেটিং করে চীনের বেশিরভাগ নাগরিককে গুগল এবং উইকিপিডিয়ার মতো সাইটগুলিতে প্রবেশ করতে বাধা দেওয়া কিংবা চৈনিক ও মার্কিন কম্পিউটার সিস্টেমগুলির মুখোমুখি অবস্থানের সমালোচনাও করেছেন তিনি।

ইউক্রেনে ভ্লাদিমির পুতিনের আক্রমণকে তিনি হিংসাত্মক এবং অযৌক্তিক বলে নানা তথ্যের মারপ্যাঁচে বোঝাতে চাইলেও সেখানে বিদ্যমান বীভৎস 'ইউক্রেনীয় জাতীয়তাবাদ' নিয়ে মুখে কুলুপ আঁটা ছিল তার। তিনি ইউরোমাইদান আন্দোলনের পাশবিকতা নিয়েও কোনো টুঁ শব্দ করেন নাই। তাই বিশ্ব ইতিহাসের একটি পক্ষপাতমূলক বয়ান তৈরিতে হারারি সর্বক্ষেত্রে কম্পিউটারকে দায়ী করতে গিয়ে যাচ্ছেতাইরকম সরলীকরণের আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি এলগরিদম এবং এআইকে শক্তিশালী অফিসিয়াল রেগুলেশনের স্বপক্ষে নানা যুক্তি তুলে ধরেছেন। পাশাপাশি এদের সমান্তরালে শক্তিশালী স্ব-সংশোধনী প্রক্রিয়াসহ উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার উপরেও আলোকপাত করে গিয়েছেন নানা ক্ষেত্রে।

বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক আন্দোলনে ফেসবুক-টুইটারের হ্যাশট্যাগ, মিয়ানমারের সংঘাত ও গণহত্যায় ফেসবুক নিউজফিডের ব্যবহার কিংবা রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারে 'ফেস রিকগনিশন' প্রযুক্তির বহুধা ব্যবহার নিয়ে শঙ্কার কথা জানালেও ঘুরে ফিরে তার সেই চিরাচরিত উপসংহার থেকে মুক্ত নয় বইটি। ক্ষেত্রবিশেষে 'স্বজন হারানোর বেদনা কী তা আমি জানি' টাইপের বস্তাপচা উপসংহারের চেষ্টা করেছেন ফ্যাসিবাদী রোমানিয়ার ইহুদিদের দুর্দশার প্রসঙ্গ টেনে। ঘুরে ফিরে ফিলিস্তিনের গণহত্যাকে জায়েজ করার অসুস্থ ইঙ্গিতও ছিল তথ্য ও তত্ত্বকথার মারপ্যাঁচে। সে হিসেবে একজন দুর্দান্ত আখ্যান লেখক হিসেবে হারারি তার নামের প্রতি সুবিচার করেছেন। তবে তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ কিংবা ইতিহাস লেখকের নৈতিকতার প্রশ্নে তিনি নিজের পূর্বতন সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করতে পারেননি উপরন্তু আরও নিত্য নতুন সীমাবদ্ধতা সৃষ্টি করেই সাজিয়েছেন সাম্প্রতিক সুপাঠ্য বেস্টসেলার গ্রন্থ 'নেক্সাস: এ ব্রিফ হিস্টরি অব ইনফর্মেশন নেটওয়ার্কস ফ্রম স্টোন এইজ টু এ আই'।

Comments

The Daily Star  | English

Matia Chowdhury no more

Awami League presidium member and former minister Matia Chowdhury breathed her last around 12:30pm

27m ago