পলিব্যাগ নিষিদ্ধ করায় পরিবেশবান্ধব ব্যাগ ব্যবসায়ীদের সুদিন

বর্তমানে সুপারশপগুলো থেকে আরও ৩২ হাজার ব্যাগের অর্ডার পেয়েছেন মাহফুজা।
পরিবেশবান্ধব ব্যাগ
সুপারশপে পলিথিন ও পলিপ্রোপিলিন শপিং ব্যাগ নিষিদ্ধ করায় বাড়ছে পরিবেশবান্ধব ব্যাগের ব্যবহার। ছবি: প্রবীর দাশ/স্টার

এই তো গত সেপ্টেম্বরের শুরু পর্যন্ত মাহফুজা বেগমের সুরজু হ্যান্ডিক্রাফটস হাতে গোনা কয়েকজন ক্রেতার জন্য পাট-কাপড় দিয়ে পরিবেশবান্ধব, হালকা ও পুনর্ব্যবহারযোগ্য বাজারের ব্যাগ তৈরি করে আসছিল।

তবে তা নিয়মিত ছিল না। প্রয়োজন ক্রেতার।

গত মাসের মাঝামাঝি থেকে নিজের কারখানার ১০ মেশিন নিয়ে ব্যস্ত মাহফুজা। সব সুপারশপে পলিথিন ও পলিপ্রোপিলিন শপিং ব্যাগ নিষিদ্ধে সরকারের সিদ্ধান্তের কারণে তার এই ব্যস্ততা।

গত ১ অক্টোবর থেকে এ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হয়েছে।

এরপর থেকে সুপারমার্কেটগুলোয় ২০ হাজারের বেশি ব্যাগ সরবরাহ করেছে সুরজু হ্যান্ডিক্রাফটস।

বর্তমানে সুপারশপগুলো থেকে আরও ৩২ হাজার ব্যাগের অর্ডার পেয়েছেন মাহফুজা।

তার ভাষায়, 'পরিবেশবান্ধব ব্যাগ গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছিল। এগুলোর ব্যবহার সীমিত। তবে এখন ব্যাপক চাহিদা দেখতে পাচ্ছি।'

সুপারশপে পলিথিন বন্ধের আগে সুরজু হ্যান্ডিক্রাফটস মাসে প্রায় এক হাজার ব্যাগ তৈরি করত। তখন তার কারখানায় প্রতিদিন দুই-তিনটি মেশিন চলতো।

পরিবেশবান্ধব ব্যাগের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় অনেকের কাজের সুযোগ হয়েছে। মাহফুজা এখন ১৫ নারী কর্মীকে তাদের বাড়িতে বসেই ব্যাগ তৈরির কাজ দিচ্ছেন।

পরিবেশবান্ধব ব্যাগ তৈরির আরেক প্রতিষ্ঠান বেকি সেন্টারের মালিক তাহমিদুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, অন্তর্বর্তী সরকার সুপারমার্কেটে পচনশীল ব্যাগ ব্যবহার করতে বলার আগে তারা প্রচারণামূলক পণ্য তৈরি করতেন।

তিনি বলেন, 'নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হওয়ার পর থেকে সুপারস্টোরগুলোয় আমরা ৩০ হাজারেরও বেশি ব্যাগ সরবরাহ করছি।'

পরিবেশবান্ধব ব্যাগ
পাটের বস্তা তৈরিতে ব্যস্ত শ্রমিক। ছবি: রাশেদ সুমন/স্টার

কাপড়ের অভাব

মাহফুজা বেগম ও তাহমিদুল ইসলাম জানিয়েছেন, সুপারমার্কেটগুলোয় চাহিদা বেশি থাকলেও ব্যাগ তৈরিতে ব্যবহৃত কাপড়ের ঘাটতির কারণে তারা চাহিদা পূরণ করতে পারছেন না।

এ ছাড়াও, হঠাৎ করেই পাট ও সুতি কাপড়ের দাম বেড়ে গেছে বলে জানান তারা।

তাহমিদুল ইসলাম বলেন, 'প্রচুর চাহিদা থাকলেও সমস্যা হচ্ছে সুতি কাপড়ের অভাব।'

তিনি জানান, পলিব্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞার আগে এক গজ কাপড়ের দাম ৩২ টাকা হলেও এখন দাম ৩৮ থেকে ৪০ টাকা। 'ফলে কাপড়ের ব্যাগ তৈরির খরচ বেড়েছে।'

তার মতে, আরেকটি সমস্যা হলো—বেশিরভাগ সুপারমার্কেটগুলো ব্যাগের টাকা যত দেরিতে সম্ভব কারখানাগুলোকে দিতে চায়।

'কাপড় কিনতে হয় নগদ টাকায়। বেশিরভাগ সুপারস্টোর নগদ টাকায় ব্যাগ কিনতে চায় না।'

'মূলধনের অভাব দেখা দিয়েছে। পণ্য বিক্রির টাকা প্রতি সপ্তাহে পেলে কর্মীদের বেতন দিতে পারতাম। উৎপাদন চলমান রাখা যেত।'

মাহফুজা বেগম বলেন, 'ব্যাগ তৈরির প্রয়োজনীয় কাঁচামাল দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়েছে।'

ব্যবসায়ীরা বলছেন, বেশিরভাগ পাটজাত পণ্য প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান রপ্তানিযোগ্য কাপড় তৈরিতে বেশি মনোযোগী। কম দামের বাজারের ব্যাগের জন্য ব্যবহার করা কাপড়ের হঠাৎ চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় হওয়ায় তারা সেই চাহিদা মেটাতে প্রস্তুত না।

মাহফুজা জানান, তাদের তাড়াহুড়ো করে কাজ শুরু করতে হয়েছে, যাতে সুপারস্টোরগুলোয় দ্রুত ব্যাগ দেওয়া যায়।

দেশে খুচরা পণ্যের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান 'স্বপ্ন'র ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাব্বির এইচ নাসির ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এই নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নে সংকট তৈরি হয়েছে।'

তিনি আরও বলেন, 'প্রতিদিন আমাদের এক লাখ ব্যাগ দরকার। আমরা প্রায় এক হাজার থেকে দুই হাজার ব্যাগ পাই। চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ব্যাপক ব্যবধান। ক্রেতাদের ওপর অতিরিক্ত চাপ কমাতে ছয় টাকা থেকে ২০ টাকায় বাজারের ব্যাগ দিচ্ছি।'

'মাছ ও মাংসের জন্য দুটি কাগজের ব্যাগ ব্যবহার করতে হয়। এটা আমাদের জন্য ব্যয়বহুল। কিন্তু, দেশে মোম দেওয়া কাগজের ব্যাগ সহজে পাওয়া যায় না বলে এটা করতে হচ্ছে।'

তিনি আরও বলেন, 'যা প্রয়োজন তা হলো মোম দেওয়া কাগজের ব্যাগের উৎপাদন নিশ্চিত করা ও পাটের ব্যাগের সরবরাহ বাড়ানো।'

'গ্রাহকদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো দরকার। সব গ্রাহক এই উদ্যোগটি ইতিবাচকভাবে নিচ্ছেন না। আমরা তাদেরকে ব্যাগগুলো আবার ব্যবহারে উৎসাহ দিচ্ছি।'

'একসময় আমাদের পূর্বপুরুষরা ব্যাগ নিয়ে বাজারে যেতেন। পুরোনো অভ্যাস ফিরিয়ে আনতে প্রচারণার প্রয়োজন।'

সংকটের কারণ তারা ক্রেতাদের ব্যাগ সঙ্গে আনার অনুরোধ করছেন জানিয়ে তিনি আরও বলেন, 'সরকার পরিবেশবান্ধব ব্যাগের ব্যবহার ধীরে ধীরে বাড়াতে সরে যেতে উৎসাহিত করতে পারত।'

ইউনিমার্টের প্রধান নির্বাহী মুর্তজা জামান ডেইলি স্টারকে জানান, তারা কয়েকটি জায়গা থেকে ক্রেতাদের পুনর্ব্যবহারযোগ্য পাট ও কাপড়ের ব্যাগ দিচ্ছেন। কিন্তু, পর্যাপ্ত সরবরাহ পাচ্ছেন না।

প্রতিটি ব্যাগের সর্বনিম্ন দাম ২৯ টাকা হওয়ায় এর দাম কমানো যায়নি বলেও জানান তিনি। বলেন, 'সরকার যদি ব্যাগ তৈরির কাঁচামাল নিশ্চিত করতে পারে, তাহলে তা বড় সহায়তা হবে।'

জুট ডাইভারসিফায়েড প্রোডাক্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও ক্রিয়েশন প্রাইভেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাশেদুল করিম মুন্না ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পাটের ব্যাগের প্রতি মানুষের ব্যাপক আগ্রহ আছে।'

'কম দামের ব্যাগের জন্য কাপড় তৈরির প্রস্তুতি ছিল না কারখানাগুলোর। এ ধরনের ব্যাগ তৈরিতে আলাদা উপকরণ লাগে। উদ্যোক্তাদের আলাদাভাবে বিনিয়োগ করতে হয়।'

তিনি মনে করেন, পরিবেশবান্ধব বাজারের ব্যাগ ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার বিষয়ে সরকারের নিশ্চয়তা প্রয়োজন।

'সরকারের উচিত এমন প্রজ্ঞাপন জারি করা যাতে বলা হবে, এই নিষেধাজ্ঞা কমপক্ষে তিন বছর কার্যকর থাকবে। তাহলে পাটের দেশে বড় বাজার তৈরি হবে। অনেকে কাজের সুযোগ পাবেন।'

তার মতে, 'স্টোর পরিচালক ও ক্রেতাদের পরিবেশবান্ধব ব্যাগ ব্যবহারে উৎসাহিত করতে সুপারমার্কেটে বিক্রির ওপর ভ্যাট তুলে নেওয়ার বিষয়টিও বিবেচনা করা উচিত।'

Comments

The Daily Star  | English

March 7 belongs to people, not just AL: Anu Muhammad

Says any attempt to erase history won't be tolerated

18m ago