এসএমই উদ্যোক্তাদের কষ্ট কাটছেই না

এসএমই
অলঙ্করণ: স্টার

চলমান রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও ব্যাংক ঋণে উচ্চ সুদের হারের কারণে দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা (এসএমই) তাদের ব্যবসা পরিচালনা করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন।

অনেক উদ্যোক্তা জানিয়েছেন, কর্মী ছাঁটাই ও বেতন পরিশোধে দেরি করা ছাড়া তাদের হাতে বিকল্প খুব কম। অন্যরা বলছেন, ব্যবসা কমে যাওয়ায় তারা সময়মতো কিস্তি পরিশোধ করতে পারছেন না।

কারো ভাষ্য, তারা ব্যবসা চালাতে সঞ্চয় করা টাকা খরচ করছেন। কেউ কেউ বলেছেন, তারা টিকে থাকার জন্য ঋণ নিচ্ছেন বা মুনাফার হার কমিয়ে দিচ্ছেন।

ফরিদপুর জেলার আর কে মেটালের মালিক পরিতোষ কুমার মালো দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ব্যবসার পরিস্থিতি ভালো নয়। বিক্রি বেশ কমে গিয়েছে। আগে ২৫ জন কর্মী ছিলেন। গত কয়েক মাসে কমে ১৫ জনে নেমে এসেছে।'

'ঠিক মতো বেতন ও ওভারটাইম দেওয়া যাচ্ছিল না। বাধ্য হয়েই তাদের ছাঁটাই করতে হয়েছে,' যোগ করেন তিনি।

'সাধারণত মাস শেষ হওয়ার আগেই বেতন দিয়ে দিতাম। বর্তমান ব্যবসায়িক বাস্তবতায় তা এখন ১০ থেকে ১৫ তারিখে পরিশোধ করতে হচ্ছে।'

তিনি জানান, গত অক্টোবরে তিনি প্রায় পাঁচ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি করেছিলেন। ২০২৩ সালের একই মাসে তার বিক্রি ছিল প্রায় ৫০ লাখ টাকা।

এই পরিস্থিতিতে রূপালী ব্যাংক থেকে ৩৫ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছেন জানিয়ে তিনি আরও বলেন, 'ব্যবসা পরিচালনার জন্য ও পাশাপাশি অন্য এক নতুন প্রতিষ্ঠানে ঋণেরও একটি অংশ বিনিয়োগ করেছি।'

ক্রমাগত মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায় অনেক উদ্যোক্তা পণ্য বিক্রি বাড়াতে হিমশিম খাচ্ছেন।

দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি চলছে। ২০২৩ সালের মার্চ থেকে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি নয় শতাংশের বেশি।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য বলছে—খাদ্যপণ্য, বিশেষ করে চাল ও সবজির দাম বেড়ে যাওয়ায় গত অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি তিন মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশে পৌঁছে।

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ঠেকাতে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২২ সালের মে থেকে ব্যাংকগুলোকে যে হারে ঋণ দেয়, সেই হারে নীতি হার বাড়াচ্ছে। গত বছরের জুলাইয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণের সুদের হারের ঊর্ধ্বসীমা তুলে নেওয়ার পর সুদের হার ধীরে ধীরে বেড়েছে।

মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে গত ২২ অক্টোবর নীতি হার ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ২০২২ সালের মে মাসের পর তা এগারোবারের মতো বেড়েছে। তখন নীতি হার ছিল পাঁচ শতাংশ।

ঢাকার এসএমই প্রতিষ্ঠান সুআঁশ'র ম্যানেজিং পার্টনার জাকিরুল ইসলাম আকুল ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গত তিন মাসে শোরুম, কারখানা ভাড়া ও কর্মীদের বেতন মিলিয়ে প্রায় দুই লাখ টাকা ঘাটতিতে আছি। ওই টাকার ৫০ শতাংশ সঞ্চয় ও বাকিটা কাছের বন্ধুদের কাছ থেকে ঋণ হিসেবে নিয়েছি।'

তিনি জানান, ২০২৩ সালের অক্টোবরে বিক্রি কমে ১০ লাখ টাকা হয়। গত অক্টোবরে তা এক লাখ টাকায় নেমে আসে। সঞ্চিত টাকায় ব্যবসা করছেন। খরচ মেটাতে বন্ধুদের কাছ থেকেও টাকা ধার করতে হচ্ছে।

জাকিরুল ইসলাম আকুল আরও বলেন, 'পাটজাত পণ্য বিক্রির পিক সিজন অক্টোবর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত। তখন সারাদেশে এসএমই মেলা হয়। কিন্তু এবার পরিস্থিতি ভিন্ন।'

দিনাজপুরের উদ্যোক্তা শিউলি আক্তার ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সময়মতো কর্মীদের বেতন ও ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হিমশিম খাচ্ছি। সঞ্চয় ভেঙে ব্যবসা চালিয়ে নিতে হচ্ছে।'

২০২৩ সালের জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত প্রায় এক লাখ ১৭ হাজার টাকার পণ্য বিক্রি করেছিলেন শিউলি আক্তার। এ বছরের একই সময়ে বিক্রি কমে দাঁড়িয়েছে ৪৭ হাজার টাকা।

আগে তিনি মাসের ১০ তারিখের মধ্যে কর্মীদের বেতন ও কিস্তি পরিশোধ করতে পারতেন। গত চার-পাঁচ মাস ধরে তাকে বেতন ও কিস্তি পরিশোধে ১৫ তারিখ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়।

আট স্থায়ী কর্মীর পাশাপাশি বিক্রির মৌসুমে তিনি ৩৫ অস্থায়ী কর্মীকে কাজ দিতেন। এখন অস্থায়ী কর্মীদের কাজ দিতে পারছেন না।

নারীদের পোশাক ও নকশী কাঁথা বিক্রেতা জামালপুরের উদ্যোক্তা শাহাবিয়া জাহান সিদ্দিকা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ব্যবসার অবস্থা করুণ।'

আগে মাসে ছয়-সাত লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হতো। এখন তা এক লাখে নেমে এসেছে। আগে যে বেতন প্রতি মাসের ১ বা ২ তারিখে দিতাম এখন তা ১৪ বা ১৫ তারিখে দিতে হয়।

তিনি জানান, ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে গত মাসে ফিক্সড ডিপোজিট থেকে টাকা তুলতে হয়।

শাহাবিয়া জাহান সিদ্দিকার সাতজন স্থায়ী শ্রমিক ছিল। মন্দার কারণে একজনকে ছাঁটাই করতে হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বর্তমান পরিস্থিতিতে এসএমই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।'

'মূল্যস্ফীতির কারণে কাঁচামালের দাম অনেক বেড়ে যাওয়ায় পণ্যের দামও বেড়েছে। উদ্যোক্তারা সময়মতো কর্মীদের বেতন দিতে পারছেন না। সময়মতো কিস্তিও পরিশোধ করা যাচ্ছে না।'

তিনি আরও বলেন, 'যদিও অন্তর্বর্তী সরকার অনেক সমস্যা সমাধানে কাজ করছে, তবে এসএমইর সমস্যাগুলো সমাধানে নির্দিষ্টভাবে চেষ্টা করেনি।'

'বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে' উল্লেখ করে সেলিম রায়হান আরও বলেন, 'সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো এ ধরনের সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নিলে হয়তো পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হবে।'

পরিকল্পনা বিভাগের প্রতিবেদন বলছে, ২০১৮ সালে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) এসএমইর অবদান ছিল প্রায় ২৫ শতাংশ।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো পরিচালিত অর্থনৈতিক শুমারি ২০১৩ অনুসারে, দেশে এসএমইর সংখ্যা ছিল ৭৮ লাখ ৮০ হাজার।

Comments

The Daily Star  | English

Drive underway in Demra to recover Sada Pathor looted from Bholaganj

Rab claims to have found Bholaganj’s white stone stored in seven warehouses

1h ago