বিদেশফেরত ২ ভাইয়ের কারখানা থেকে জুতা যাচ্ছে বিদেশে

রংপুরের তারাগঞ্জে বিদেশফেরত দুই ভাইয়ের হাতে গড়া জুতার কারখানা। ছবি: সংগৃহীত

সুন্দর ভবিষ্যতের আশায় মো. সেলিম ও হাসানুজ্জামান হাসান প্রায় ৩০ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন। তারা সেখানে নির্মাণ ব্যবসায় সাফল্য পেয়েছিলেন। কিন্তু, দেশে ফেরার তাগিদ উপেক্ষা করতে পারেননি।

নিরাপদ ও আরামদায়ক জীবন পেছনে ফেলে তারা দেশে ফেরেন ভালোকিছু করার আশায়। পরে দেশের উত্তরাঞ্চলে হিমাগার ও জুতার কারখানা গড়ে তোলেন।

রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার দূরে রংপুরের তারাগঞ্জে তাদের গড়ে তোলা কারখানার নন-লেদার জুতা ইউরোপ ও ভারতে রপ্তানি হচ্ছে। তাদের রপ্তানির তালিকায় আরও আছে পোল্যান্ড, তুরস্ক, আরব আমিরাত, জার্মানি ও কানাডা। প্রতিষ্ঠানটি এখন যুক্তরাষ্ট্রে জুতা রপ্তানির চেষ্টা করছে।

তাদের কারখানায় এখন প্রায় তিন হাজার শ্রমিক কাজ করছেন। তাদের বেশিরভাগই নারী।

২০০৭ সালে সম্ভাব্য বিনিয়োগের জন্য সাড়ে তিন কোটি টাকা নিয়ে দেশে ফিরে আসেন দুই ভাই। শুরু হয় দিন বদলের পালা। যদিও সেই সময় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ছিল। তবুও তাদের লক্ষ্য ছিল—দেশের জন্য কিছু একটা করা।

২০০৯ সালে সেলিম ও হাসান নীলফামারীতে বীজ ও আলুসহ অন্যান্য কৃষি পণ্যের জন্য হিমাগার করেন। ২০১২ সালে রংপুরের মিঠাপুকুরে দ্বিতীয় হিমাগার গড়ে তোলা হয়।

তারা শিগগির জুতা তৈরির দিকে ঝোঁকেন। যাতে নারীদের কাজের সুযোগ হয়।

২০১৭ সালে তারাগঞ্জের ঘনিরামপুর এলাকায় সাড়ে নয় একর জমির ওপর ব্লিং লেদার প্রোডাক্টস লিমিটেড নামে জুতার কারখানা গড়ে তোলেন তারা।

সে সময় কাঁচামাল ও দক্ষ জনবলের অভাব ছিল জানিয়ে হাসান বলেন, 'স্বপ্ন ছিল এলাকায় কাজের সুযোগ সৃষ্টি করা এবং বিদেশফেরত হিসেবে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা।'

সম্প্রতি তারা জুতার দ্বিতীয় কারখানা করেছেন।

কিন্তু তাদের শুরুটা খুব সহজ ছিল না। হাসান জানান, তারা ব্যবস্থাপনা ও প্রযুক্তিগত সমস্যায় পড়েছিলেন। এর একটি কারণ তাদের কারখানাটি রাজধানী ঢাকা থেকে অনেক দূরে।

এ ছাড়াও, জুতা তৈরি ও রপ্তানির অভিজ্ঞতার অভাব ছিল আরেক চ্যালেঞ্জ।

২০২০ সালে তারা জুতা তৈরি শুরু করেন। প্রাথমিকভাবে প্রতিদিন ৩০০ জোড়া জুতা তৈরি করতেন। ২০২১ সালে প্রতিষ্ঠানটি বিশ্ববাজারে প্রবেশ করে।

হাসান আরও বলেন, 'গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ইউরোপ ও ভারতে কৃত্রিম কাপড়ের জুতা রপ্তানি থেকে ৩২০ কোটি টাকা আয় হয়।'

এ দিকে, বার্ধক্যজনিত জটিলতায় কয়েক বছর ভোগার পর ২০২৩ সালে মারা যান বড়ভাই সেলিম।

ছোটভাই হাসানের ভাষ্য, 'এমন কঠিন সময়ে ব্যবসা চালানো কঠিন ছিল।'

গত শুক্রবার রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কাজী মো. ওয়াহিদুল ইসলাম ব্লিং লেদারের দ্বিতীয় কারখানা উদ্বোধন করেন। বিশ্বমান নিশ্চিত করতে তাইওয়ান ও ইতালি থেকে যন্ত্রপাতি কেনা হয়।

প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে ৯০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে রূপালী ব্যাংক।

স্থানীয়ভাবে কাজের সুযোগ সৃষ্টির ক্ষেত্রে নতুন এই কারখানা মাইলফলক সৃষ্টি করেছে। বর্তমানে কারখানা দুটিতে প্রায় দুই হাজার ৯০০ জন কাজ করছেন।

'কারখানাগুলো এই অঞ্চলে বেকারত্ব কমাতে সহায়তা করছে' উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'মাত্র পাঁচ-ছয় বছর আগেও এই এলাকার পুরুষরা কাজের খোঁজে বাইরে যেত। নারীরা ঘরের কাজ করতেন। এখন দৃশ্যপট নাটকীয়ভাবে বদলে গেছে।'

দ্বিতীয় কারখানা চালু হওয়ায় প্রতিদিন প্রায় ১৫ হাজার জোড়া জুতা তৈরি করা হচ্ছে। ২০২৬ সালের মধ্যে দৈনিক ৫০ হাজার জোড়া জুতা উৎপাদনের লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে বলে জানান হাসান।

ব্লিং লেদার প্রোডাক্টস লিমিটেডের শ্রমিক হামিদা খাতুন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এক বছরেরও বেশি আগে কারখানায় কাজ শুরু করি। এই চাকরির আগে আমরা রিকশা-ভ্যানচালক স্বামীর আয়ের ওপর নির্ভর করতাম। এখন মাসে ১০ হাজার টাকা আয় করি। আমাদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে।'

'পরিবারে অবদান রাখতে পারছি। অনেক আনন্দ হচ্ছে।'

চার বছর আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ ও সর্বশেষ সম্প্রসারণের পর ব্লিং লেদার এখন ২০২৮ সালের মধ্যে ৭০০ কোটি টাকার রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে।

কিন্তু হাসানের কাছে জীবন শুধু মুনাফার বিষয় নয়। জাতি গঠনে অবদান রাখার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ।

Comments

The Daily Star  | English
Govt Guarantees To Loans of State Enterprises

Sovereign guarantee rules to be revised

The government plans to amend the existing sovereign guarantee guidelines to streamline the process and mitigate fiscal risks if public entities fail to make repayments on time, according to a finance ministry report.

12h ago