বাসে ডাকাতি ও যৌন নিপীড়ন: মামলার এজাহারে কী আছে?

ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে বাস ডাকাতির তিন দিন পর টাঙ্গাইলের মির্জাপুর থানায় মামলা হয়েছে।

ওই বাসের একজন যাত্রী মো. ওমর আলী (৫০) বাদী হয়ে শুক্রবার অজ্ঞাতনামা আট থেকে নয়জনকে আসামি করে মামলাটি দায়ের করেন। মামলা নম্বর ১৭। এতে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের (সংশোধিত ২০২০) ১০ এবং দণ্ডবিধির ৩৯৫ ও ৩৯৭ ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে।

ওমরের বাড়ি নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার চকবড়াইগ্রামে। তিনি পেশায় একজন ব্যবসায়ী। পুলিশকে তিনি জানিয়েছেন, ঢাকা থেকে বড়াইগ্রাম ফেরার জন্য গত ১৭ ফেব্রুয়ারি রাত আনুমানিক ১১টা ২৫ মিনিটের দিকে গাবতলী বাসস্ট্যান্ড থেকে রাজশাহীগামী ইউনিক রোড রয়েলস পরিবহনের একটি বাসে (ময়মনসিংহ-ব ১১-০০৬১) উঠেছিলেন।

টাঙ্গাইলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আবদুললাহ আল মামুন তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে গত সোমবার রাতে ঢাকার গাবতলী থেকে রাজশাহীর উদ্দেশে ছেড়ে আসা যাত্রীবাহী বাসে এই ঘটনা ঘটে।

মামলার এজাহারের একটি কপি দ্য ডেইলি স্টারের হাতে এসেছে। তাতে উল্লেখ করা হয়েছে, বাসটি রাত সাড়ে ১১টার দিকে আনুমানিক ৩০ থেকে ৩৫ জন যাত্রী নিয়ে গাবতলী থেকে রাজশাহীর উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেছিল। অনুমানিক পৌনে ১২টার দিকে হেমায়েতপুর বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে এবং আরও ১০ থেকে ১২ জন যাত্রী নিয়ে রওনা হয়।

সোমবার দিবাগত রাত ১টার দিকে বাসটি গাজীপুরের কালিয়াকৈর থানাধীন চন্দ্রা বাইপাসে এসে চা পানের বিরতির জন্য থামে। সেখানে প্রায় ১০-১৫ মিনিট বিরতির সময় আরও তিন-চারজন নতুন যাত্রী ওঠেন। আনুমানিক রাত দেড়টার দিকে বাসটি কালিয়াকৈরের হাইটেক সিটি পার্কে পাশে খাড়াজোড়া ফ্লাইওভার ব্রিজ পার হওয়ার পাঁচ-ছয় মিনিট পর হঠাৎ বাসে যাত্রী বেশে থাকা আট-নয়জন  ডাকাত একসঙ্গে দাঁড়িয়ে যান।

তারা চাকু ও চাপাতি হাতে যাত্রীদের হত্যার ভয় দেখিয়ে সবাইকে চুপ থাকতে বলেন। ডাকাতদের মধ্যে তিনজন পেছন থেকে সামনে গিয়ে চালকের গলায় ধারালো চাকু ধরে বলেন 'অনেক চালাইসছ আর গাড়ি চালানো লাগবো না'। এরপর দুজন ডাকাত চালককে টেনেহিঁচড়ে কিলঘুষি মারতে মারতে বাসের পেছনে নিয়ে যান এবং একজন চালকের আসনে বসে বাস চালিয়ে টাঙ্গাইলের দিকে যেতে থাকেন।

ওমর আরও উল্লেখ করেছেন, রাত পৌনে ২টার দিকে মির্জাপুরের সোহাগপাড়া ফুটওভার ব্রিজ থেকে প্রায় ১০০ গজ পশ্চিমে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে পৌঁছালে ছয়-সাতজন ডাকাত ধারালো চাকু ও চাপাতি হাতে যাত্রীদের ভয় দেখাতে শুরু করেন।

'তোদের সাথে টাকা পয়সাসহ যার যা কিছু আছে সব দিয়া দে' বলেই যাত্রীদের কাছ থেকে টাকা, মোবাইল ফোন, অলংকার ছিনিয়ে নেন। সে সময় তারা দুই থেকে তিনজন নারীকে যৌন নিপীড়ন করেন, উল্লেখ করেছেন ওমর।

বাসটি টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার নাটিয়াপাড়া নাছির গ্লাসের সামনে থেকে ইউটার্ন নিয়ে ঢাকার দিকে রওনা হয়। বাস নিয়ে ডাকাতরা প্রায় দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা কালিয়াকৈর, কোণাবাড়ীসহ গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরেছেন এবং এই সময়ের মধ্যে যাত্রীদের কাছ থেকে টাকা ও অন্যান্য মূল্যবান জিনিস ছিনিয়ে নিয়েছেন। রাত ৪টার দিকে আশুলিয়ার বাড়ইপাড়া এলাকায় নন্দন পার্কের সামনে বাস থামিয়ে ডাকাতরা নেমে যান।

তারা চালককে ভয় দেখিয়ে বলেন, '১০ কিলোমিটারের মধ্যে গাড়িটি কোথাও থামাইলে তোকে জানে মেরে ফেলবো, আমরা তোদের গাড়ির পিছনে পিছনে আছি'। পরবর্তীতে চালক বাস চালিয়ে চন্দ্ৰা মোড়ে এলে যাত্রীরা জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯-এ ফোন করে ঘটনার বিষয়ে পুলিশকে জানান। এর কিছুক্ষণের মধ্যে টহল পুলিশ আসে।

তারা মির্জাপুর থানায় যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। ওমর মির্জাপুর থানার ডিউটি অফিসারকে বিষয়টি মৌখিকভাবে জানিয়েছিলেন।

সোমবার রাতে মির্জাপুর থানার ডিউটি অফিসারের দায়িত্বে ছিলেন এএসআই মো. আতিকুজ্জামান।

এ বিষয়ে মির্জাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোশারফ হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ভোররাত ৫টার দিকে একজন লোক এসে ডিউটি অফিসারকে ডাকাতির কথা জানিয়েছিলেন। ডিউটি অফিসার তাকে বসতে বলেছিলেন। কিন্তু তিনি অপেক্ষা না করে চলে যান। তার পরিচয় বা ফোন নম্বর না থাকায় পরবর্তীতে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।'

বাসটি বড়াইগ্রাম মোড়ে পৌঁছালে ডাকাতির ঘটনায় জড়িত অভিযোগে তিন-চারজন যাত্রী নেমে স্থানীয় লোকজনের সহয়তায় চালক, তার সহকারী ও সুপারভাইজার পুলিশের হাতে তুলে দেন। বড়াইগ্রাম থানা পুলিশ প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় আদালতে পাঠান।

নাটোরের বড়াইগ্রাম আমলী আদালত সূত্রে জানা যায়, বড়াইগ্রাম থানার এসআই শরিফুল ইসলাম স্বাক্ষরিত চালান মূলে ঢাকা-রাজশাহী চলাচলকারী ইউনিক রোড রয়েলস বাসের চালক বাবলু ইসলাম (৩৫), চালকের সহকারী সুমন ইসলাম (৩৫) ও সুপারভাইজার মাহবুল আলমকে (৩৮) বুধবার বিকেলে আদালতে পাঠানো হয়। সন্ধ্যায় তাদের আদালতের সামনে হাজির করলে আদালত শুনানি শেষে জামিনের আদেশ দেন।

ওমর আলী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যেহেতু তিনজন বাসস্টাফ সন্দেহভাজন তালিকায় রয়েছেন, পুলিশ আমাকে বলেছে যে, তাদের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে মামলা (আসামি) করা হবে।'

বাদী আরও উল্লেখ করেছেন, ডাকাতদের বয়স অনুমানিক ২৫ থেকে ৩৮ বছর। প্রত্যেকে ফুল প্যান্ট পরে ছিলেন। কেউ জ্যাকেট, কেউ ফুল হাতা শার্ট, কেউ হাফ হাতা গেঞ্জি ও শার্ট পরে ছিলেন। একজন ডাকাত লম্বা, ফর্সা এবং একজন মোটা ও গায়ের রঙ শ্যামলা। অন্যান্যদের শারীরিক গঠন মাঝারি ধরনের ছিল। তারা সবাই ঢাকা ও আশেপাশের জেলার আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলছিলেন।

ডাকাতদের দেখলে চিনতে পারবেন বলেও জানান ওমর।

পুলিশের পরিসংখ্যান অনুসারে, অধিংকাশ অপরাধ সংঘটনের সূত্রপাত হয় সিরাজগঞ্জ অথবা গাজীপুর থেকে।

আবদুললাহ আল মামুন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের ৬৫ কিলোমিটার অংশে জেলা পুলিশের নিয়মিত টহল কার্যক্রম রয়েছে। এছাড়া কোনো অপরাধের খবর পেলে তাৎক্ষণিক বিশেষ চেকপোস্ট বসানো হয়।'

'তবে, মহাসড়কে চলা ২৪টি জেলার হাজার হাজার যানবাহনের মধ্যে কোন গাড়িতে অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে, সেটি বোঝা খুবই কষ্টসাধ্য,' বলেন তিনি।

মামুন আরও বলেন, 'এ ধরনের অপরাধ কমানোর ক্ষেত্রে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি পরিবহন মালিক-শ্রমিক ও যাত্রীদের সচেতনতা এবং করণীয় রয়েছে। বিশেষত, রাতে দূরপাল্লার বাসে নির্দিষ্ট কাউন্টার বা স্টপেজ ছাড়া রাস্তা থেকে যাত্রী না ওঠানো, অপরিচিতদের সঙ্গে ভাড়ায়চালিত প্রাইভেটকার বা মাইক্রোবাসে না ওঠা ইত্যাদি।'

'সোমবারের ডাকাতির ঘটনায় দেখা গেছে, স্টাফরা মাঝ পথ থেকে ডাকাতদলকে বাসে উঠিয়েছিলেন,' যোগ করেন তিনি।

এই পুলিশ কর্মকর্তা জানান, ডাকাতদের গ্রেপ্তারে জেলা পুলিশের কয়েকটি টিম কাজ করছে।

Comments

The Daily Star  | English

UP chairmen’s absence: People suffer amid service disruptions

The situation worsened after the launch of "Operation Devil Hunt" in early February

9h ago