বিষাক্ত মাটি, বিপন্ন জীবন

মাদারীপুরে অবৈধ ইটভাটার সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। সরকারি নিয়মনীতি উপেক্ষা করে বছরের পর বছর ধরে গড়ে উঠছে এসব ভাটা। জেলার ৭৬টি ইটভাটার মধ্যে অধিকাংশেরই বৈধ কাগজপত্র নেই। পরিবেশ আইন অমান্য করে চলা এসব ইটভাটার মালিকদের বিরুদ্ধে কর ফাঁকির অভিযোগও রয়েছে।
ইটভাটায় প্রধান জ্বালানি হিসেবে কয়লা ব্যবহারের নিয়ম থাকলেও বাস্তবে বেশিরভাগ ভাটায় ব্যবহার হচ্ছে কাঠ। সরেজমিনে সদর উপজেলায় অন্তত ১০টি ইটভাটা ঘুরে এই চিত্র দেখা গেছে। সেই সঙ্গে, ইট তৈরিতে কেটে নেওয়া হচ্ছে কৃষিজমির উপরিভাগের উর্বর মাটি। অথচ আইন অনুযায়ী ইট তৈরিতে এ ধরনের মাটির ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ।
ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০১৩-এর ৫ নম্বর ধারায় বলা আছে, ইট প্রস্তুত করার উদ্দেশ্যে কৃষিজমি বা পাহাড় বা টিলার মাটি কেটে ইটের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। এই আইনের ১৫ ধারায় বলা হয়েছে, যিনি এই আইনের ৫ ধারা লঙ্ঘন করবেন, তাকে দুই বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক দুই লাখ টাকা জরিমানা করা হবে।
জ্বালানির কাঠ সংগ্রহের জন্য কিছু ভাটার ভেতরেই অবৈধ করাত কল (স-মিল) স্থাপন করা হয়েছে। নদীপথে মাদারীপুরের বিভিন্ন এলাকা ও বরিশালসহ আশপাশের জেলাগুলো থেকে ইটভাটায় পোড়ানোর জন্য কাঠ আনা হয়।
অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে জেলায় বিভিন্ন সময় অভিযান চললেও জরিমানা দিয়ে আবার তারা কার্যক্রম শুরু করছে। অনেকক্ষেত্রে তদারকি না থাকায় আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছেন তারা। যে অনিয়মের কারণে ভ্রাম্যমাণ আদালত জরিমানা করে, জরিমানার পর সেই অনিয়ম আরও বেড়ে যায়।

এ ব্যাপারে স্থানীয় প্রশাসনের ভাষ্য, লোকবলের অভাবে তারা নিয়মিত অভিযান চালাতে পারেন না।
মাদারীপুর সদর উপজেলায় ইটভাটা আছে ৪০টি। এসব ইটভাটায় ইট তৈরির জন্য কৃষকদের বেশি মুনাফার লোভ দেখিয়ে রাতের বেলা ফসলি জমির উপরিভাগের মাটি কেটে নেওয়া হচ্ছে। ভূমিদস্যুদের ঠেকাতে উপজেলা ভূমি অফিসের তৎপরতাও অনেক কম। গত ছয় মাসে দুটি অভিযান পরিচালনা করে দুইজনকে দেড় লাখ টাকা জরিমানা করেছে তারা।
মাটি কাটার জন্য জমি দখল
কিছু ইটভাটা মালিকের বিরুদ্ধে জোরপূর্বক জমি দখলেরও অভিযোগও উঠেছে। ইটভাটা মালিকরা প্রভাবশালী হওয়ায় অনেক সময় ভুক্তভোগীরা ভয়ে মুখ খুলতে চান না। আওয়ামী লীগের সাবেক এক সংসদ সদস্যের ভাই ইটভাটা মালিক সমিতির শীর্ষ পদে থাকায় কেউ কোনো ভাটার বিরুদ্ধে কথা বলতে চাইতেন না।
অন্তত ১২টি ইটভাটা রয়েছে সদর উপজেলায় পাচঁখোলা ইউনিয়নে। আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকার পাশে থাকা ইটভাটাগুলোর ধোঁয়া ও ধুলার কারণে বাড়ছে শ্বাসকষ্টসহ নানা স্বাস্থ্যঝুঁকি। ইটবোঝাই ভারী ট্রলি চলাচলের ফলে ভেঙে যাচ্ছে রাস্তা, বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা। ৫ মার্চ সকালে সদর উপজেলার পুরান বাজারের কাটপট্টি এলাকায় ইটবাহী একটি ট্রাক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ঢুকে পড়লে দুজন আহত হন।
তথ্য অধিকার আবেদনে ইটভাটার সংশ্লিষ্ট তথ্য
বিগত দুই বছরের অবৈধ ইটভাটার অভিযানের বিষয়ে জানতে তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করলে পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসন, কর ও ভ্যাট অফিস কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে পারেনি।
পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, মাদারীপুরে ইটভাটা রয়েছে ৭৬টি। এর মধ্যে ১২টি ইটভাটার ছাড়পত্র দেওয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। পরিবেশের ছাড়পত্র না থাকা এবং অনিয়মের কারণে ইতোমধ্যে পরিবেশ অধিদপ্তর জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় ১৮টি ইটভাটায় অভিযান চালিয়ে আনুমানিক ৩০ লাখ টাকা জরিমানা করেছে।
অন্যদিকে, মাদারীপুরে কতগুলো অবৈধ ইটভাটা রয়েছে, তার সঠিক হিসাব নেই জেলা প্রশাসনের কাছে। তারা জানিয়েছে, ৩৬টি ইটভাটার বৈধ লাইসেন্স রয়েছে। গত ২ বছরে ১৫টি ইটভাটাকে ৯ লাখ ৭৪ হাজার ৮০০ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

মাদারীপুর জেলা কর কমিশনার প্রসেনজিত চাকমা জানান, ইটভাটা থেকে আশানুরূপ ট্যাক্স পাওয়া যাচ্ছে না। লাইসেন্স নবায়ন করলে ট্যাক্স বাড়বে। জেলা প্রশাসককে বিষয়টি জানানো হয়েছে।
সম্প্রতি সরেজমিনে মাদারীপুর সদর উপজেলার আড়িয়াল খাঁ সেতু সংলগ্ন, মাদারীপুর পুরাতন ফেরিঘাট ও পাচঁখোলা এলাকার ইটভাটাগুলো পরিদর্শন করে দেখা গেছে, বেশিরভাগ ইটভাটায় জ্বালানি হিসেবে গাছের গুড়ি ও কাঠ ব্যবহার হচ্ছে। বিশেষ করে পাচঁখোলা এলাকার ইটভাটাগুলোতে কয়লা ব্যবহার করতে দেখা যায়নি। এই এলাকার পাশেই রয়েছে মাদারীপুরের পুরান বাজার আবাসিক এলাকা। কুমার ও আড়িয়াল খাঁ নদের পাশেই ইটভাটাগুলো গড়ে উঠেছে।
এই এলাকায় এক সারিতে অন্তত ১২টি ইটভাটা দেখতে পাওয়া যায়। এখানকার অধিকাংশ ইটভাটাকে অনিয়ম ও বৈধ লাইসেন্স না থাকায় জরিমানা করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর।
এলাকার এপিবি, এআরজি, জেএসবি, এমআরকে ও এসবিএসসহ কয়েকটি ইটভাটায় গিয়ে দেখা গেছে, ইটভাটার সম্মুখে এলোপাথাড়িভাবে গাছের গুঁড়ি ও কাঠ ফেলে রাখা হয়েছে।
এপিবি ইটভাটায় গিয়ে দেখা যায়, শ্রমিকরা কাঁধে করে কাঠ তুলে নিয়ে চুল্লির ভেতরে ফেলছেন। ইটভাটায় কাঠ পোড়ানোর ছবি তুলতে গেলে, এই ভাটার মালিক মো. পলাশ প্রতিবেদককে দেখে তেড়ে আসেন। তিনি ইটভাটার ছবি তুলতে নিষেধ করেন ও ছবি ডিলিট করতে বলেন।
তিনি বলেন, 'কার অনুমতি নিয়ে ছবি তুলেছেন? মাদারীপুরের সাংবাদিকরা তো নিউজ করতে আসে না, আপনি কেন এসেছেন?' পরে তিনি প্রতিবেদন না করতে অনুরোধ করেন। তিনি আরও বলেন, 'সব নিয়ম মানার পরেও ২০০৩ সাল থেকে পরিবেশ অধিদপ্তর আমাদের লাইসেন্স দিচ্ছে না।'
এপিবি ও জেএসবি ইটভাটাতেও চুল্লিতে গাছ ফেলতে দেখা গেছে। জেএসবিসহ কয়েকটি ইটভাটায় গিয়ে দেখা যায়, নদীতে ট্রলার বোঝাই করে কাঠ আনা হয়েছে। নদীপথে বরিশালসহ অন্যান্য জেলা থেকে গাছ নিয়ে আসা হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেএসবি ইটভাটার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শ্রমিক। কাঠ কাটার জন্য রীতিমতো স'মিল বসানো হয়েছে এখানে।

জেএসবি ইটভাটার মালিক সোবাহান মিয়া বলেন, ইটভাটায় অনেক শ্রমিক কাজ করে, তাদের রান্নাবান্নার জন্য জ্বালানি কাঠের প্রয়োজন হয়। মূলত সেজন্যই ইটভাটায় গাছ ও কাঠ রাখা হয়েছে। আর যে স-মিল দেখেছেন, সেগুলো মূলত এই শ্রমিকের রান্নার কাঠ কাটার জন্য ব্যবহৃত হয়। ইটভাটার জন্য কয়লা ব্যবহার করা হয়।
তিনি আরও বলেন, সরকার হুটহাট করে ইটভাটার ওপর নতুন নিয়ম চাপিয়ে দিচ্ছে। এ জন্য তারা ঠিকমতো লাইসেন্সও পাচ্ছেন না। তারা সব নিয়ম মেনে ইটভাটা নির্মাণ করেছেন।
তিনি আরও বলেন, একটি আইন রয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এক কিলোমিটারের আশেপাশে কোনো ইটভাটা নির্মাণ করা যাবে না। ভাটা নির্মাণের পর হুট করে এক কিলোমিটারের ভিতরে একটি মাদ্রাসা বা কিন্ডারগার্টেন হয়ে যায়। এখন তার দাবি, কোনো ইটভাটার এক কিলোমিটার মধ্যে যেন নতুন করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করা না হয়।
এআরজি ইটভাটার ম্যানেজার রাজিব কাজী বলেন, কিছুদিন আগে প্রশাসন এসে তার ভাটায় অনিয়ম দেখিয়ে আড়াই লাখ টাকা জরিমানা করেছে। ভ্যাট, ট্যাক্স দেওয়া ও পূর্বের লাইসেন্স থাকার পরও তারা ভাটার লাইসেন্স নবায়ন করে দিচ্ছে না। এখানকার অনেক ইটভাটার পরিবেশ অধিদপ্তরের লাইসেন্স নেই। বাধ্য হয়ে লাইসেন্স ছাড়াই ভাটা চালাতে হচ্ছে।
ইটভাটায় জমি দখলের শিকার মাদারীপুরের ইনকাম ট্যাক্স আইনজীবী সিরাজুল হক বলেন, তিন বছর আগে তার ছেলে ৩২.৭৯ শতাংশ জমি কেনেন। এর মধ্যে কয়েক শতাংশ জায়গা দুটি ইটভাটা দখল করে রেখেছে।

জমি দখলের বিষয়ে এই আইনজীবী বলেন, বারবার বলার পরেও ইটভাটার মালিক তার জমি ছাড়ছেন না। তারা তাদের জমি কিনে নিতে চাইছেন। কিন্তু তারা জমি বিক্রি করতে চান না। এ জন্য তিনি জবরদস্তি জমি দখলে রেখেছেন। পরিবেশ অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অভিযোগ করেও কোনো সমাধান পাওয়া যাচ্ছে না।
তার ভাষ্য, একজন আইনজীবী হয়েও যদি আমার জমি বেদখল হয়ে যায় তাহলে বুঝতেই পারছেন সাধারণ মানুষ কতটা অসহায়। তিনি আরও বলেন, কেএইচবি ইটভাটার পরিবেশগত লাইসেন্স নেই। এমনকি এই ইটভাটায় কাঠও পোড়ানো হচ্ছে।
জমি দখলের অভিযোগের ব্যাপারে কেএইচবি ইটভাটার মালিক কাজী হেমায়েত হোসেন বলেন, সিরাজুল হক খামখেয়ালিভাবে তার নামে মিথ্যা অভিযোগ করেছেন। তার এই ভাটার বয়স ২০ বছরের বেশি। সিরাজুল হক মাত্র দুই-তিন বছর হলো জমিটুকু কিনেছেন। এখন তিনি বেশি দামে তার কাছে জমি বিক্রি করতে চাইছেন। তিনি কেন বাজার মূল্যের চেয়ে বেশি দামে জমি কিনবেন? তাছাড়া ওই জমির দুই পাশে রয়েছে তার দুটি ইটভাটা। তাই জমিটি ছাড়লে তার ইটভাটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
জানতে চাইলে মাদারীপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক এস এম শরীফুর রহমান বলেন, 'ইটভাটাতে কোনভাবেই জ্বালানি হিসেবে গাছ বা গাছের কাঠ ব্যবহার করা যাবে না। তবে কিছু ইটভাটাতে স-মিল বসানো হয়েছে, বিষয়টি আমার নজরে এসেছে। জেলা প্রশাসনকে সঙ্গে নিয়ে খুব শিগগির এই ভাটাগুলোতে অভিযান চালাব। লোকোকলের সংকটে নিয়মিত অভিযান চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।'
এ বিষয় জানতে মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক মোছা. ইয়াসমিন আক্তারকে মুঠোফোনে কয়েকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
Comments