সুতাং নদী: এক সময়ের সমৃদ্ধ জলপথ এখন বিষাক্ত বর্জ্যভূমি

সুতাং নদী | ছবি: মিন্টু দেশোয়ারা/স্টার

এক সময়ের সমৃদ্ধ জলপথ, হবিগঞ্জের সুতাং নদী এখন তীব্র পরিবেশগত সংকটের কবলে। কারখানার শিল্পবর্জ্য নদীটিকে বিষাক্ত জলাশয়ে পরিণত করেছে।

দূষণের মাত্রা এতটাই চরমে পৌঁছেছে যে, জলজ জীবন প্রায় নিশ্চিহ্ন। নদী দূষণে স্থানীয় বাসিন্দারাও সম্ভাব্য স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে জানিয়েছেন শঙ্কা।

হবিগঞ্জের নূরপুর গ্রামের বাসিন্দা জয়তারা বিবি বলেন, আমি বছরের পর বছর এই নদীর পানি ব্যবহার করেছি, কিন্তু এখন কাছে যেতেও ভয় পাই। দূষণ এতটাই তীব্র যে মানুষ তো দূরের কথা, পশুরাও কাছে যায় না।

সুতাং নদী | ছবি: মিন্টু দেশোয়ারা/স্টার

স্থানীয় রঞ্জিত পাল বলেন, 'আগে নদী থেকে মাটি এনে হাঁড়ি-পাতিল তৈরি করতাম, কিন্তু এখন আর পারছি না। পানি এতটাই দূষিত যে নদীতে নামা যাচ্ছে না।'

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) হবিগঞ্জ শাখার সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল সোহেল বলেন, 'সুতাং নদীতে এখন আর মাছ নেই। শিল্পদূষণের কারণে মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। গত ২২ ফেব্রুয়ারি নদীর ১২টি স্থানে ৩০ বারের বেশি জাল ফেলা হয়েছিল। বুল্লা নৌকা ঘাটে তিনটি ছোট পুঁটি মাছ পাওয়া গেল, বুল্লা মাছ বাজার পেরিয়ে কয়েকবার জাল ফেলে একটি ছোট টাকি মাছ আর বেলেশ্বরী ঘাটলা ও এর আশপাশে একাধিকবার জাল ফেলে পাওয়া গেল একটি খলসে মাছ, তাও মরা!'

'বেকিটেকা পূর্ব-পশ্চিমে একাধিকবার জাল ফেলে কিছুই পাওয়া গেল না। চড়িপুর, রাজিউড়া, সাধুরবাজার, কাটাখালী, গদাইনগর এলাকায় একাধিকবার জাল ফেলা হলে শুধু বর্জ্য উঠে এলো জালে।'

সুতাং নদী | ছবি: মিন্টু দেশোয়ারা/স্টার

তিনি বলেন, 'কলকারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য নিষ্কাশনের অন্যায় সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার জন্য নদীটিকে মেরে ফেলা হচ্ছে। দেশের ভয়াবহ দূষণের নদী হিসেবে সুতাং নদী পরিচিতি পেয়েছে।'

'সুতাংকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল এই অঞ্চলে বাঁশের সবচেয়ে বড় বাজার। এই নদী দিয়ে বাঁশের চালী নিয়ে আসা হতো সুতাং বাজারে। বর্ষাকালে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বাঁশ ব্যবসায়ীরা বাঁশ কিনে নদী পথে নিয়ে যেতেন দেশের বিভিন্ন জায়গায়। কিন্তু সেই ঐতিহ্য এখন আর নেই,' বলেন সোহেল।

স্থানীয় ব্যবসায়ী সুভাষ দাস বলেন, দরজা-জানালা বন্ধ থাকা সত্ত্বেও, দুর্গন্ধ এড়াতে পারি না। লাখাই অংশে পবিত্র স্নানের জন্য সুতাং নদীতে জড়ো হতো মানুষ। কিন্তু এখন, জল এত দূষিত যে, এই ঐতিহ্য ধরে রাখা অসম্ভব।

হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক সুতাং নদীর পানি ও মাছের ওপর একটি গবেষণা পরিচালনা করছেন। দীর্ঘদিন ধরে শিল্প দূষণের শিকার এই নদীর দূষণের মাত্রা নির্ধারণের জন্য গবেষকরা নদীর বিভিন্ন স্থান থেকে পানি, মাছ এবং পলির নমুনা সংগ্রহ করেছেন।

গবেষক দলের সদস্য এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের জলজ সম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রভাষক ইফতেখার আহমেদ ফাগুন বলেন, 'পরীক্ষাগারে বিশ্লেষণে ইতোমধ্যে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, পানি ও মাছের নমুনায় মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি রয়েছে। এছাড়া, শিল্পদূষণের ফলে নদীর পানির ভৌত-রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যগুলো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, ফলে নদীর নিম্নপ্রবাহে মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ছে।'

সুতাং নদী | ছবি: মিন্টু দেশোয়ারা/স্টার

তিনি জানান, নদীর পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের (ডিও) মাত্রা এতটাই কম, যা স্বাদুপানির মাছের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় মাত্রার চেয়ে অনেক নিচে।

গবেষকরা জানিয়েছেন, নদীর পানির পরিবাহিতা এবং মোট দ্রবীভূত কঠিন পদার্থ (টিডিএস) গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি।

নমুনা সংগ্রহের সময় গবেষকরা দেখতে পান যে, নদীর নিম্নপ্রবাহে মাছের সংখ্যা অত্যন্ত কম। বিশেষ করে শৈলজোড়া খালের সংযোগস্থলের আশেপাশের এলাকাটি সবচেয়ে উদ্বেগজনক, যেখানে শিল্পবর্জ্য নদীতে প্রবাহিত হয়। এই অঞ্চলে কোনো মাছ বা জলজ প্রাণী পাওয়া যায়নি।

গবেষণা প্রকল্পের প্রধান এবং পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক মো. শাকির আহম্মেদ বলেন, 'আমরা ইতোমধ্যে নিশ্চিত হয়েছি যে, পানি ও মাছের নমুনায় মাইক্রোপ্লাস্টিক রয়েছে। বর্তমানে ভারী ধাতুর উপস্থিতি নির্ণয়ের জন্য আরও পরীক্ষা চলছে।'

খোয়াই রিভার ওয়াটারকিপার তোফাজ্জল সোহেল বলেন, সুতাং নদী বাংলাদেশ-ভারতের একটি আন্তঃসীমান্ত নদী। এর দৈর্ঘ্য ৮২ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ৩৬ মিটার এবং প্রকৃতি সর্পিলাকার। সুতাং নদীর উৎপত্তি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের পাহাড়ি অঞ্চলে। সেখান থেকে হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। তারপর লাখাই উপজেলার কালনী নদীতে মিলেছে।

এই নদী বাঁচাতে দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে সুতাং এক সময় কেবল স্মৃতির অংশ হয়ে রয়ে যাবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া, নইলে এই অঞ্চলের জনজীবন আরও সংকটের মুখে পড়বে বলে মনে করেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

Comments

The Daily Star  | English

Gazipur Police Commissioner Nazmul Karim withdrawn

He was withdrawn in the face of a controversy over closing one lane of a highway while travelling from Dhaka to his workplace

1h ago