আলুর জীবন্ত জাদুঘর যেখানে

পাত্রে সংরক্ষিত বিভিন্ন জাতের আলু। পাশে তাদের গুণাগুণ ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা সম্পর্কিত তথ্য। ছবি: স্টার

ভিটামিন 'এ' ও 'ডি' সমৃদ্ধ রক্তবর্ণের বিএডিসি আলু-৯ দেশের কৃষিতে নতুন হলেও ইতোমধ্যে তা কৃষকসহ স্বাস্থ্য সচেতন মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। 

আর এটা হয়েছে শুধু এর আকর্ষণীয় রঙের জন্য নয়, বরং প্রচুর স্বাস্থ্যকর উপাদান সমৃদ্ধ হওয়ার কারণে।

অনন্য এই আলুসহ মোট ৯০ জাতের আলুর দেখা মিলেছে সম্পূর্ণ নতুন ধারণার 'আলুর জীবন্ত জাদুঘরে'।

এই জাদুঘরের আয়োজক বিএডিসির অন্তর্গত দেশের সর্ববৃহৎ 'ডোমার ভিত্তি আলুবীজ উৎপাদন খামার'। 

আলুর জীবন্ত জাদুঘরের সাইনবোর্ড। ছবি: স্টার

নীলফামারী জেলার ডোমার উপজেলার প্রান্তিক সোনারায় গ্রামে এই জাদুঘর। নিজস্ব প্রাঙ্গণে স্থাপিত এ জাদুঘরটি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সবার জন্য উন্মুক্ত থাকে।

রক্তবর্ণের বিএডিসি আলু-৯ স্বাস্থ্য সচেতন মানুষের পছন্দের শীর্ষে থাকার মূল কারণ এর ভিটামিন 'এ' ও 'ডি'। এছাড়া, এতে আরও আছে অ্যানথোসিয়ানিন নামের একটি মূল্যবান উপাদান, যা একাধারে অ্যান্টি অক্সিডেন্ট,  মানসিক উত্তেজনা প্রশমনকারী, প্রদাহ নিরোধক এবং ক্যান্সার প্রতিরোধী।

আলুর জীবন্ত জাদুঘরের দুটি অংশ। একটি সরাসরি মাঠ পর্যায়। সেখানে বিভিন্ন আলুর চাষাবাদ পদ্ধতি সরাসরি কৃষকদের দেখানো হয়। 

অপর অংশটি মাঠ সংলগ্ন একটি কক্ষ। সেখানে প্রদর্শনীর সব ধরনের আলু আলাদা আলাদা পাত্রে রাখা আছে। সঙ্গে রয়েছে প্রতিটির গুণাবলী ও ব্যবহারের তথ্য সমৃদ্ধ পোস্টার ও লিফলেট। 

এ আয়োজন কৃষকসহ সব ধরনের দর্শনার্থীদের ব্যাপকভাবে আকৃষ্ট করছে।

দর্শনার্থীরা জাদুঘরের আলুখেত অংশটি ঘুরে দেখছেন। ছবি: স্টার

জাদুঘরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সুব্রত মজুমদার ডোমার ভিত্তি বীজ উৎপাদন খামারের সহকারী পরিচালক। তিনি সবসময় সেখানে উপস্থিত থেকে দর্শনার্থীদের সহযোগিতা করেন।

দ্য ডেইলি স্টারকে সুব্রত বলেন, 'এখানকার প্রতিটি জাতের আলুর হেক্টরপ্রতি গড় উৎপাদন ক্ষমতা ৪০-৪৫ টন পর্যন্ত। কতগুলো জাতের আলু যেমন, সান্তানা, প্রাডা, ইনোভেটর, আলকেন্দার, জিনারেড ইত্যাদি থেকে উন্নতমানের স্টার্চ তৈরি হয় যা ফার্মাসিউটিক্যাল, টেক্সটাইল ও পেপার ইন্ডাস্ট্রিতে বহুল ব্যবহৃত।'

এই কৃষিবিদ জানান, আলুর অন্যান্য জাত যেমন, সাবশাইন, কুম্বিকা, রাশিদা, কুইনানী, ব্রিআন্নাসহ আরও কতগুলো জাত রপ্তানি পণ্য হিসেবে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভূক্ত দেশগুলোসহ সিঙ্গাপুর, নেপাল, ভূটান ও অন্যান্য দেশে ব্যাপক চাহিদা আছে।

'অনেকগুলো জাতের আলু স্ন্যাকস জাতীয় খাদ্য, যেমন চিপস, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, ইনস্ট্যান্ট পুডিং ইত্যাদি তৈরিতে  ব্যাপক সমাদৃত,' বলেন তিনি।

আলুর অন্য কিছু জাত নারী-পুরুষের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যচর্চায়, যেমন ত্বক ও চুলের যত্ন, মুখের উজ্জ্বলতা বাড়ানোর কাজে ব্যাবহার করা হয় বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

সম্প্রতি সরেজমিনে আলুর জাদুঘর পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায়, পাশ্ববর্তী পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও ও নীলফামারী এলাকা থেকে অনেক দর্শনার্থী এসেছেন। 

ডোমার ভিত্তি আলু বীজ উৎপাদন খামার জাদুঘর পরিদর্শনে আসা কৃষকদের স্বাস্থ্যসম্মত বিএডিসি আলু-৯ এর চাষাবাদ পদ্ধতি জানাচ্ছেন কর্মকর্তা। ছবি: স্টার

পঞ্চগড়ের সাকোয়া গ্রাম থেকে আসা কৃষক সাদেকুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এখানে এই আলুর জীবন্ত জাদুঘর পরিদর্শনে এসে আমরা বিভিন্ন নতুন জাতের উচ্চ ফলনশীল আলু সম্পর্কে জানতে পারলাম। সেগুলোর আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতিও শিখে নিলাম যা আমাদের ব্যাপক কাজে আসবে।'

নীলফামারী সদরের ইটাখোলা গ্রামের কৃষক আব্দুল মান্নান শাহ্ ফকির বলেন, 'আলুর বহুমুখী ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় কৃষকদের প্রতিযোগিতামূলকভাবে উচ্চমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত হয়েছে। তাই আমি সামনের মৌসুমে আরও বেশি জমিতে আলু আবাদ করব।' 

জাদুঘর দেখতে আসা ঠাকুরগাঁয়ের কলেজশিক্ষক গোলাম মোস্তফা বলেন, 'বিশেষ ভিটামিন ও পুষ্টিগুণসম্পন্ন   আলু নিয়মিত ও পরিমিত পরিমাণ গ্রহণের মাধ্যমে আমি ওষুধ বা সাপ্লিমেন্ট সেবন না করেই সুস্থ জীবনযাপন করছি।'

কৃষকরা জানান, মাত্র এক দশক আগে হেক্টরপ্রতি আলুর উৎপাদন ছিল মাত্র ৭-৮ টন। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ গবেষণা করে জাত উন্নয়ন ও কৃষি প্রযুক্তি হস্তান্তরের মাধ্যমে সেই উৎপাদন হেক্টর প্রতি ৪০-৪৫ টনে উন্নীত হয়েছে, এটা এক ধরনের কৃষিবিপ্লব।

জানতে চাইলে ডোমার আলু বীজ উৎপাদন খামারের উপপরিচালক মো. আবু তালেব মিয়া ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আলু থেকে দেশের জন্য সর্ব্বোচ্চ লাভ পেতে কৃষি দপ্তর, খাদ্য, শিল্প ও বাণিজ্য দপ্তর এবং বেসরকারি খাতকে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে।'

Comments