জিঞ্জিরা গণহত্যার ভয়াল স্মৃতিতে আজো শিউরে ওঠেন প্রত্যক্ষদর্শীরা

জিঞ্জিরা গণহত্যায় শহীদ এক তাঁতি | ছবি: রশীদ তালুকদার

'খালের পাড় ধইরা বাড়ির পিছন দিয়া মিলিটারি বাড়িত আয়া ঢুকলো। আমরার চার ভাতিজার মইধ্যে তিন ভাতিজাই তহন ঘরের মধ্যে ঘুমাইয়া আছিল, আরেক ভাতিজা ডরে আগেদি পালাইয়া গেছেগা। বাকি তিনজনে আর পালাইবার সুযোগ পায় নাইক্কা। মিলিটারি ঘরে ঢুইক্কাই ব্রাশফায়ার করল। কলাগাছের লাহান বেকটি চিৎ হইয়া পড়লো।'

'লগেই ছিল আমার ভাবি। তিন পোলার লাশ দেইখাই ভাবিও নগদে অজ্ঞান হইয়া গেলোগা'—ভয়াল সেই স্মৃতি স্মরণ করতে করতে হঠাৎ যেন খেই হারিয়ে ফেলেন এরশাদ সরদার।

গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী এরশাদ সরদার | ছবি: আহমাদ ইশতিয়াক/স্টার

কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন তিনি।  তারপর ভাঙা গলায় ফের বলেন, 'মিলিটারি আওনের খবর হুইনাই তো আমি লুঙ্গি কাছা মাইরা লোড় পাইড়া (দৌড় দিয়ে) পাশের ঘরের চৌকির তলে যাইয়া ঢুকছি। হাঁড়ি-পাতিল থাকনে আর দেখবার পারি নাইক্কা। খালি আল্লারে ডাকতাছি, যেন মিলিটারি আমারে না দেখে। ওরা যে সময় ঘরে আয়া ঢুকলো, আমার আরেক চাচতো ভাতিজারেও গুলি কইরা মারলো। অয়ও সেই জায়গায় শেষ।'

ঐ যে ওর বাপেরে—আঙুলের ইশারায় পাশের ঘরের দাওয়ায় বসা একজনকে দেখালেন এরশাদ।

তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, 'ওর বাপের কি শরীর আছিল। ব্যায়াম করতো, মুগুর ভাজাইতো। গুলি খাইয়া রক্তে পুরো ঘর ভাসাইয়া নিয়া গেল।' ততোক্ষণে চোখ ভিজে এসেছে এরশাদ সরদারের।

অন্যদিকে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন ওবায়দুল হক। বাবাকে কখনো স্বচক্ষে দেখার সৌভাগ্য হয়নি তার। ভয়াল সেই সকালে বাবাকে যখন চিরতরে হারিয়েছিলেন ওবায়দুল, তখন তিনি মায়ের গর্ভে। মায়ের কাছে বাবার কথা শুনেছেন। পরিবারের এই চারজন ছাড়াও সেদিন এরশাদ সরদার একাই অন্তত কুড়িখানেক লাশ মাটিচাপা দিয়েছেন, জানান এই প্রতিবেদককে।

শুধু এক সরদার বাড়ির দৃশ্যই এটি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের ২ এপ্রিলের ভোর কেরানীগঞ্জবাসীর জন্য যেন এক সাক্ষাৎ মৃত্যু পরোয়ানা নিয়ে হাজির হয়েছিল। কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে রানীগঞ্জের জিঞ্জিরা, কালিন্দী ও শুভাঢ্যা ইউনিয়নের গ্রামগুলো হয়ে উঠেছিলো রক্তাক্ত এক প্রান্তর।

এই খাল ধরেই শুভাঢ্যা ইউনিয়নে প্রবেশ করেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী | ছবি: আহমাদ ইশতিয়াক/স্টার

ইতিহাসবিদ, পুরান ঢাকার স্থানীয় বাসিন্দা ও মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একাত্তরের ২৫ মার্চ ভয়াল কালরাত্রির গণহত্যার পর প্রাণ বাঁচাতে ঢাকার বেশিরভাগ বাসিন্দাই ঢাকা ছাড়তে শুরু করেন। এর মধ্যে বহু বাসিন্দাই নিরাপদ আশ্রয়স্থলের কথা ভেবে বুড়িগঙ্গা নদীর অপর পাড়ের কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরা, শুভাঢ্যা ও কালিন্দী ইউনিয়নের গ্রামগুলোতে আশ্রয় নেন। তাদের বিশ্বাস ছিল, পাকিস্তানি সেনারা নদীর এ পাড়ে আসবে না।

অন্যদিকে হিন্দু অধ্যুষিত এই অঞ্চলটি ছিল আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রধান দুর্গ। জিঞ্জিরা দিয়েই ঢাকা ছেড়েছিলেন তাজউদ্দীন আহমেদের মতো আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতারা। আশ্রয় নিয়েছিলেন শাজাহান সিরাজ, তোফায়েল আহমেদ, সিরাজুল আলম খানের মতো প্রভাবশালী ছাত্রনেতারাও।

এরই মধ্যে গোয়েন্দা মারফতে পাকিস্তানি বাহিনী জানতে পারে জিঞ্জিরাতে ছাত্রনেতাদের মাধ্যমে গোপনে সংগঠিত হচ্ছে আওয়ামী লীগ। ফলে অপারেশন সার্চলাইটের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জাহানজেন আরবাব জিঞ্জিরায় নতুন এক অপারেশনের সিদ্ধান্ত নেন। অপারেশনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ব্রিগেডিয়ার জেনারেল বশীরকে।

সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ১ এপ্রিল মধ্যরাতে পাকিস্তানি বাহিনী ভারী গোলাবারুদ নিয়ে ঘাঁটি গাড়ে বুড়িগঙ্গা তীরবর্তী মিটফোর্ড হাসপাতালে। মর্টার আর মেশিনগান বসানো হয় পরী বিবির মসজিদের ছাদে। ভোরের আগেই গানবোট দিয়ে সেনা নামানো হয় জিঞ্জিরা, কালিন্দী ও শুভাঢ্যা ইউনিয়নের গ্রামগুলোতে।

২ এপ্রিল আনুমানিক ভোর পাঁচটার দিকে পরী বিবির মসজিদের ছাদ থেকে ফ্লেয়ার ছুড়ে অপারেশন শুরুর সংকেত দেন ব্রিগেডিয়ার রশিদ। পাকিস্তানি সেনারা প্রথমে জিঞ্জিরা ও বড়িশুর বাজার গান পাউডার দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। এরপর শুরু করে নৃশংস এক হত্যাযজ্ঞ।

গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী ও দক্ষিণ মান্দাইলের বাসিন্দা জুলহাস মিয়া ডেইলি স্টারকে বলেন, '২৫ মার্চের পরে মিলিটারি আমাগো জিঞ্জিরা আইলেও যেন আমরা আগেভাগে খবর পাইয়া পলাইবার পারি, এর লাইগা ঘাটে ঘাটে পাহারা বহাইছিলাম। ২ তারিখ ভোরে পাহারা দেওনের লাইগা ঘাটে আয়া দেখি সদরঘাটের থুনে (কাছে) মিলিটারি পাঁচটা গানবোট লইয়া আমাগো ঘাটে আয়া থামলো। বোট থেইকা নাইমাই আমাগোরে জিগাইলো "নারিকেলবাড়িয়া কিধার হ্যায়? মন্টু বাড়ি কিধার হ্যায়?" ওরা মোস্তফা মহসীন মন্টুর বাড়ির খোঁজ করছিল। আমি তো বুঝবার পারছি। লগে লগে লোড় পাড়লাম (দৌড় দিলাম)। বাড়িত আয়া দেখি বেবাক মানুষ বুইজা গেছে গা।'

মুক্তিবাহিনীর ঢাকা জেলা কমান্ডার ও তৎকালীন ছাত্রনেতা মোস্তফা মোহসীন মন্টু | ছবি: আহমাদ ইশতিয়াক/স্টার

জিঞ্জিরা গণহত্যার পূর্বাপর ও পরবর্তী স্মৃতির কথা স্মরণ করতে গিয়ে মুক্তিবাহিনীর ঢাকা জেলা কমান্ডার ও তৎকালীন ছাত্রনেতা মোস্তফা মোহসীন মন্টু ডেইলি স্টারকে বলেন, '২৫ মার্চ গণহত্যার পরপরই আমি কেন্দ্রীয় ছাত্রনেতা ও জাতীয় নেতাদের নিয়ে কেরানীগঞ্জে চলে আসি। জাতীয় নেতারা চলে গেলেও কেন্দ্রীয় ছাত্রনেতারা তখনো আমার সঙ্গে ছিল। ওরা আমাদের সংগঠিত হওয়ার খবর পেয়েছিল। ১ এপ্রিল সন্ধ্যার দিকে মিটফোর্ড হাসপাতালের এক ডাক্তারের মাধ্যমে গোপনে খবর পেলাম, বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি অফিসার হাসপাতাল রেকি করে দূরবীন দিয়ে কেরানীগঞ্জ পর্যবেক্ষণ করেছে। প্রচুর গোলাবারুদ ছাদেও তুলেছে। শুনেই আমরা আমাদের পয়েন্টগুলোতে খবর পৌঁছালাম। বুঝলাম আক্রমণ আসন্ন, কিন্তু বুঝতে পারিনি এতোটা দ্রুত আক্রমণ চালাবে।

মোস্তফা মোহসীন মন্টু আরও বলেন, 'রাত ২টার দিকে মিলিটারি গোপনে গানবোট নিয়ে খাল দিয়ে ঢুকে অবস্থান নিয়ে নেয়। রাত ৩টার দিকে খবর পেলাম, জিঞ্জিরার দিকে আর্মি নামছে। ভোর ৪টার দিকে পরী বিবির মসজিদের ছাদ থেকে ফ্লেয়ার ছুড়ে অপারেশন শুরুর সিগনাল দিলো। ওরা ততোক্ষণে কাঁটাতার আর বাঁশ দিয়ে অস্থায়ী ঘেরাওয়ের মতো করে রেখেছিল, যেন সামনের দিক থেকে আর্মি গুলি করলে মানুষ পিছন দিকের বিলের দিক দিয়ে পালাতে না পারে।'

'কিছু আর্মি তখন কাঁটাতার বরাবর দাঁড়িয়ে ফায়ার শুরু করল। মানুষজন যখন প্রাণের ভয়ে গুলির মুখে একদিক থেকে অন্যদিকে যাচ্ছে তো অপরদিক থেকেও ফায়ারিং চলছেই। একটানা তিন ঘণ্টা গুলি চালালো ওরা। এরপর সকাল সাড়ে ১১টা পর্যন্ত বাড়ি বাড়ি গিয়ে তল্লাশি করেও বহু মানুষকে হত্যা করল তারা।'

গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী জুলহাস মিয়া গণহত্যার স্মৃতি স্মরণ করতে গিয়ে এই প্রতিবেদককে বলেন, 'পলাইয়া যখন বোরহানীবাগ গ্রামের মসজিদে সামনে আয়া থামলাম, দেখি মসজিদে হাজার হাজার মানুষ। মসজিদের লগের বাড়িতে তখন মিলিটারি আগুন লাগাইয়া দিছে। একজন লোড় পাইড়া আয়া কইলো—"ঐ বাড়িত মিলিটারি সাতজন মানুষ মারছে"। আমি তখন বাড়ির দিকে ছুটলাম। চারপাশে খেতে, মাঠে, বাগানে, এমন কোনো জায়গা খুঁইজা পাওন যাইবো না, যেহানে মানুষের লাশ পাওন যায় নাই। বাড়িত আয়া দেখি পুকুরপাড়ে কয়েকটা লাশ পইড়া আছে। গুলি খাইছে যারা, ওগোরে আমরা নৌকার ঘাটে লয়া নৌকা দিয়া মিটফোর্ড হাসপাতালে পাঠাইলাম।'

গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিক সাইফুল ইসলাম | ছবি: আহমাদ ইশতিয়াক/স্টার

জিঞ্জিরা গণহত্যার অন্যতম প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন পূর্ব মান্দাইল গ্রামের বাসিন্দা সাংবাদিক সাইফুল ইসলাম। ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'সে দৃশ্য আসলে বর্ণনা করার মতো না। কেউবা দৌড়াতে গিয়ে গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়ছে, কেউবা জীবনের শেষ মুহূর্তে "পানি পানি" চিৎকার করছে। কারও বুলেটের আঘাতে পেটের ভুঁড়ি বেরিয়ে গেছে। আমাদের বাড়ির পাশের হিন্দুবসতি পুরোটাই জ্বালিয়ে দিয়েছে মিলিটারি। মিলিটারি আসার খবর পেয়ে বেশ কয়েকজন দৌড়ে গিয়ে পুকুরের পাশে জঙ্গলে লুকালো। আমার আব্বা বারবার বলা সত্ত্বেও ওরা উঠে আসেনি। মিলিটারি চলে যাওয়ার পর আমরা গিয়ে দেখলাম. তাদের একজনও বাঁচতে পারেনি। সবার লাশ পড়ে আছে।'

সাইফুল ইসলামের দাবি সেদিন অন্তত পাঁচ হাজার লোককে হত্যা করেছে পাকিস্তানি বাহিনী।

মান্দাইল ডাক সড়কের পাশের এই পুকুর পাড়ে পাকিস্তানি সেনারা ব্রাশফায়ারে ৬০ জনকে হত্যা করেছিল | ছবি: আহমাদ ইশতিয়াক/স্টার

১৯৭২ সালের ৩ এপ্রিল দৈনিক বাংলায় 'জিঞ্জিরায় নারকীয় তাণ্ডব' শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছিল সাইফুল ইসলামের একটি প্রতিবেদন। পরবর্তীতে প্রতিবেদনটি স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রের অষ্টম খণ্ডে সংযুক্ত করা হয়। প্রতিবেদনটির প্রথম অংশ ছিল এমন—'অবশেষে ভোর হলো। কেরানীগঞ্জবাসী তখন ঘুমে অচেতন। সহসা শোনা গেল কামান আর মর্টারের শব্দ। …গ্রামের পর গ্রাম তারা জ্বালিয়ে দিল। মেশিনগান আর টমিগানের প্রচণ্ড আওয়াজে সকলে বিচলিত। সমানে চললো জিঞ্জিরা সুভাড্যা ও কালিন্দী ইউনিয়নের লোকদের উপর গুলী, অগ্নিসংযোগ লুণ্ঠন, ধর্ষিতা হলো কেরানীগঞ্জের মা বোনেরা। প্রত্যেকটি ঘর আক্রান্ত হলো তিনটি ইউনিয়নের। অবশেষে হত্যাযজ্ঞের সমাপ্তি ঘটলো। বর্বর বাহিনী কুখ্যাত ব্রিগেডিয়ার বশীরের নির্দেশ মতো থেমে গেল। রেখে গেল এক রক্তাক্ত কাহিনী।'

মনু মিয়ার ঢালে নির্মিত গণহত্যায় শহীদ স্মৃতিসৌধ | ছবি: আহমাদ ইশতিয়াক/স্টার

স্থানীয় সূত্র জানায়, ২ এপ্রিল জিঞ্জিরার কেবল এক মনু মিয়ার ঢালেই হানাদারেরা সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ারে চার শতাধিক মানুষকে হত্যা করেছিল। পরবর্তীতে মনু মিয়ার ঢালেই কেরানীগঞ্জের শহীদদের স্মরণে স্মৃতিসৌধটি নির্মিত হয়েছিল। এদিন মান্দাইল ডাক সড়কের পাশে এক পুকুর পাড়ে পাকিস্তানি সেনারা একসঙ্গে ব্রাশফায়ারে ৬০ জনকে হত্যা করেছিল। অন্যদিকে কালিন্দীর এক বাড়িতে ১১ জন নারীকে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি বাহিনী।

জিঞ্জিরা গণহত্যায় জিঞ্জিরা ইউনিয়নের পরে পাকিস্তানি সেনারা সবচেয়ে বেশি মানুষ হত্যা করেছিল শুভাঢ্যা ইউনিয়নে। গণহত্যার সময় মধ্য শুভাঢ্যা গ্রামের মসজিদে আশ্রয় নিয়েছিলেন গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী কবি নির্মলেন্দু গুণ।

'জিঞ্জিরা জেনোসাইড ১৯৭১' গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, "আমি যখন মসজিদের প্রাঙ্গণে পৌঁছলাম ততোক্ষণে সেই মসজিদটি লোকে লোকারণ্য মসজিদের সামনের পাকা উঠানের ওপর বেশ ক'টি মৃত ও অর্ধমৃত পুরুষের দেহ পড়ে আছে। কেউ চিৎ হয়ে, কেউ বা উবু হয়ে আছে। কারও দিকে কেউ তাকাচ্ছে না। ঐ সব মৃত বা অর্ধমৃতরা যেন জীবিতদের কেউ নয়। তাদের দেহ থেকে রক্ত বেরুচ্ছে অঝরে।"

মধ্য শুভাঢ্যা গ্রামের গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন সত্তরোর্ধ্ব বাসিন্দা সহদেব চন্দ্র মণ্ডল | ছবি: আহমাদ ইশতিয়াক/স্টার

মধ্য শুভাঢ্যা গ্রামের গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন সত্তরোর্ধ্ব বাসিন্দা সহদেব চন্দ্র মণ্ডল। ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'ভোরের দিকে জিঞ্জিরা খাল দিয়াই মিলিটারি আমগো গ্রামে আয়া ঢুকছিল।  আমরা বাঁচবার পারলেও আমগো লগে যারা ছিল, অনেকে গুলি খাইয়া পইড়া মইরা গেল। কয়েক দিন পর বাড়ি ফিরা আয়া দেখি, খালি লাশের গন্ধ। কিছু লাশ জলের স্রোতে ভাইসা গেলেও চারদিকে খালি লাশ আর লাশ পইড়া গেল। শিয়াল কুকুরে টানতাছে।'

শুভাঢ্যা ইউনিয়নের পার গেণ্ডারিয়া গ্রামের বাসিন্দা মোহাম্মদ আলমাস জানান, তিনি বাড়ির আশেপাশে গুনে গুনে অন্তত ৩০টি লাশ পেয়েছিলেন।

পৈশাচিক এই গণহত্যার পরও পাকিস্তানি সামরিক প্রশাসন গণহত্যা নিয়ে ব্যাপক মিথ্যাচার চালিয়েছিল। ২ এপ্রিল রাতে পাকিস্তানি টেলিভিশন প্রচারিত সংবাদে বলে 'বুড়িগঙ্গা নদীর অপর পাড়ে কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরায় আশ্রয় গ্রহণকারী বিচ্ছিন্নতাবাদী দুষ্কৃতিকারীদের কঠোর হাতে দমন করা হয়েছে।' ৩ এপ্রিল পাকিস্তানি সামরিক পক্ষপাতদুষ্ট মর্নিং নিউজ পত্রিকায় শিরোনাম ছিল "Action against miscreants at Jinjira" অর্থাৎ 'জিঞ্জিরায় দুষ্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ।'

এই প্রসঙ্গে তার জাহানারা ইমাম 'একাত্তরের দিনগুলি' গ্রন্থে লিখেছিলেন, 'মর্নিং নিউজের একটি হেডলাইনের দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসেছিলাম। অ্যাকশন এগেইনস্ট মিসক্রিয়ান্টস অ্যাট জিঞ্জিরা—জিঞ্জিরায় দুষ্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ। গতকাল থেকে লোকের মুখে মুখে যে আশঙ্কার কথাই ছড়াচ্ছিল, সেটা তাহলে সত্যি? কদিন ধরে ঢাকার লোক পালিয়ে জিঞ্জিরায় গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছিল। গতকাল সকাল আর্মি সেখানে কামান নিয়ে গিয়ে গোলাবর্ষণ করেছে। বহু লোক মারা গেছে।'

জিঞ্জিরা গণহত্যায় ঠিক কত সংখ্যক মানুষ শহীদ হয়েছেন, তা কখনোই পুরোপুরি জানা যায়নি। কেউ দাবি করেন তিন হাজার, কারও দাবি চার কিংবা পাঁচ হাজার নিরীহ মানুষকে নৃশংস কায়দায় হত্যা করেছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। তবে সংখ্যা যাই হোক, গণহত্যার ৫৪ বছর পরেও পৈশাচিকতা ও নৃশংস সেই হত্যাকাণ্ডের দুঃসহ স্মৃতি আজো শহীদ স্বজন ও প্রত্যক্ষদর্শীদের তাড়িয়ে বেড়ায়।

Comments

The Daily Star  | English

The Daily Star, HSBC honour high achievers in O- and A-Level exams

To commemorate the victims of the July Uprising, the programme began with a one-minute silence, followed by the rendition of the national anthem

56m ago