বর্ষবিদায় এবং বর্ষবরণ উৎসব: প্রকৃতির সঙ্গে সংস্কৃতির সন্ধি

ছবি: অর্কিড

এক বিকশিত কৃষিজগত থেকে আমরা ক্রমশই বিচ্ছিন্ন ও উৎখাত হচ্ছি। এর স্পষ্ট প্রমাণ মেলে আমরা যখন বর্ষবিদায় ও বরণের কৃত্য-পরব নিয়ে অযথা তর্ক তুলি। বর্ষবিদায় ও বরণের পরবকে বুঝতে হলে আমাদের বুঝতে হবে স্থানীয় ইকোসিস্টেম এবং ঋতুচক্র। গ্রামীণ জনগোষ্ঠী কীভাবে ভিন্ন ভিন্ন ঋতুতে ইকোসিস্টেমের জেনেটিক রিসোর্সের সঙ্গে তার কালচারাল রিলেশনশিপ তৈরি করে তা বুঝতে হবে। কয়লাবিদ্যুৎ তৈরি করে দুনিয়ার বৃহত্তম বাদাবনকে হুমকির মুখে ফেলার মতো বাহাদুরি কাজ এইটা না। হাতিদের সংসারের কথা বাছবিচার না করে কেইপিডেজ হস্তান্তরের মতো একতরফা সিদ্ধান্ত এই কালচারাল রিলেশনশিপ না।

প্রাণ-প্রকৃতির সাথে নিম্নবর্গের এই সম্পর্ক অতি জটিল। আর তাই বর্ষবিদায়ে পাহাড়ে কেউ পাজোন রাধে, আর সমতলে রাধে তিতাশাক। কেউ ভাতজরা ফুল থেকে বুঝে বছর শেষ, কেউ দেখে ভাঁট ফুল, কেউ দেখে নাগেশ্বর আবার কেউ খুঁজে শাল। এগুলি প্রকৃতি ও সংস্কৃতির সহস্র বছরের জটিল মিথষ্ক্রিয়া। এইসব হিন্দু না মুসলমানের এমন পাতানো বাইনারি দিয়ে জনগণের ইতিহাস ও আখ্যান আড়াল করা যায় না। গ্রামীণ নিম্নবর্গের সংস্কৃতির শক্তিকে একমাত্র ভয় পায় লুটেরা নিপীড়ক কর্তৃত্ববাদ। প্রতিটি ঋতুর সন্ধিক্ষণ, শুরু ও শেষকে, মানুষের সমাজ কৃত্য-পরবের ভেতর দিয়ে মান্য করেছে। প্রাণ ও প্রকৃতি সুরক্ষার সমষ্টিগত বার্তা দেয় আমাদের বর্ষবিদায় ও বরণের পরবগুলো। আর সেটাই হলো চলমান নিওলিবারেল ব্যবস্থার জন্য প্রচন্ড হুমকি।

ছবি: প্রবীর দাশ

বৈশাখে ভাটিপরব, জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় মাসে কর্মাদি, শ্রাবণে করন্ডি, ভাদ্রে কারাম, আশ্বিনে দাসাই, কার্তিকে জালাবর্ত, অগ্রহায়ণে ওয়ান্না, পৌষে পুষরা, মাঘে বাঘাই শিরণী, ফাল্গুনে ঘাটাবান্ধা আর চৈত্রে চইতপরব বা চৈত্রসংক্রান্তি। এক এক ঋতুতে প্রকৃতি নানা প্রাণের ভেতর দিয়ে তার সমাপনী ও শুরুর নির্দেশনা জানায়। প্রকৃতির নয়া শস্য ফসল গ্রহণ ও ব্যবহারের জন্য অনুমতি প্রার্থনা ও আর্শীবাদের তরে নানা সমাজ আয়োজন করে নানা কৃত্য। ফাল্গুন-চৈত্রে ভাঁট, ভাটজরা বা বিজু ফুল, শাল, মহুয়া, মিষ্টিকুমড়া, বিলিম্বি, ভেন্না, আমরুল, নাগেশ্বর, পলাশ, কাঁঠালিচাপা, দোলনচাঁপা, কনকচাঁপা ফুটে। মাঠেঘাটে তিতাশাকের বিস্তার হয়। তিতা, টক, মিঠা, নোনতা, ঝাল নানা স্বাদের পত্র-পুষ্প-ফল দেখা দেয় প্রকৃতিতে। প্রতিটি মাসের শেষ এবং আরেকটি নতুন মাসের শুরুর যে সন্ধিক্ষণ এটি এই বাংলা অঞ্চলের নিম্নবর্গের সমাজে খুব গুরুত্বপূর্ণ সময়কাল। আর একে ঘিরেই বিকশিত হয়েছে জনসংস্কৃতির নানা আয়োজন। গীতরঙ্গের নানা ব্যঞ্জনা। সন্ধিক্ষণের সঙ্গে বৈরিতা নয়, করতে হবে সৃজনশীল সন্ধি। আর সন্ধি করবার জন্য ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের মনস্তাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক অঙ্গীকার জাগিয়ে রাখতে হবে।

বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণকে ঘিরে দেশের নানাপ্রান্তে আয়োজিত হয় চৈত্রসংক্রান্তি, গাজন, দেল, নীলপূজা, চড়ক, হালখাতা, নববর্ষ ও বৈশাখীমেলা। চাকমাদের বিজু উৎসব ফুলকিজু, মূল বিজু, গজ্জাপজ্জ্যে তিন পর্বে বিভক্ত। তঞ্চংগ্যা, পাঙাল বা মুসলিম মণিপুরী এবং বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীরা আয়োজন করেন বিষু। রাঙামাটির গুর্খা ও অহমিয়ারা এ সময় বিহু পরব আয়োজন করেন এবং কোচদের কাছেও এ পরবের নাম বিহু। হাজংদের অনেকেই হংঅরানী পরব আয়োজন করেন। বম আদিবাসীরা আয়োজন করেন চাপচার কুত উৎসব। মারমাদের সাংগ্রাইং, ত্রিপুরাদের বৈসু বা বৈসুক, রাখাইনদের সাংগ্রেং, চাকদের সাংগ্রাইং, ম্রোদের চানক্রান, খিয়াংদের সাংলান বর্ষবরণ উৎসব আয়োজিত হয় এ সময়েই। ভাওয়াল ও মধুপুরগড়ের বর্মণ ও কোচ আদিবাসীরা সন্যাসীপূজা, গাজন, চড়কপূজার মাধ্যমে চৈত্রসংক্রান্তি পালন করেন। সিলেট অঞ্চলের চা বাগানের আদিবাসীদের অনেকেই এসময় পালন করেন দন্ডবর্ত। উল্লিখিত বর্ষবিদায় ও বরণের পরবগুলি মোটামুটি একইসময়ে আয়োজিত হয়, বাংলা চৈত্র মাসের শেষে এবং বৈশাখের শুরুতে। তবে 'বৈ-সা-বি' বলে কোনো উৎসব পৃথিবীর কোথাও নাই। বৈসু, সাংগ্রাইং এবং বিজু উৎসব তিনটির নাম থেকে প্রথম বাংলা বর্ণটি নিয়ে এমন উদ্ভট ও জাত্যাভিমানী প্রবণতা তৈরি হয়েছিল। মান্দি/গারো এবং খাসি এ দুটি ম্যাট্রিলিনিয়াল সমাজের ক্ষেত্রে বর্ষবিদায় ও বরণ পরবের সময়কাল একদমই আলাদা। মান্দি বর্ষগণনা অনুযায়ী বছরের শেষ মাসের নাম ওয়াচেংজা (ফেব্রুয়ারি) এবং শুরুর মাস গালমাকজা (মার্চ)। মান্দিদের ক্ষেত্রে গালমাকদুয়া পরব আয়োজিত হয় মার্চ-এপ্রিলে, যদিও এটি বর্ষবরণ কৃত্য নয়। আবার মাগুরছড়া খাসিপুঞ্জিতে নভেম্বর মাসে আয়োজিত হচ্ছে খাসি বর্ষবিদায় উৎসব 'সেং কুটস্মেম'। ম্রোদের ক্ষেত্রেও বর্ষবিদায়ের অনুষ্ঠান প্রাতলা পই/নিংচ্চুর পই কোথাও আয়োজন হয় মে মাসে।

ছবি: রাজীব রায়হান

প্রতিটি ঋতু বেশ কিছু নির্দেশনা নিয়ে আসে; প্রকৃতির নির্দেশনা। গ্রামীণ নিম্নবর্গ হাজার বছর ধরে প্রকৃতির এসব নির্দেশনা মান্য করেছে, করে তুলেছে জীবনের আরাধ্য। বিকশিত হয়েছে বর্ষবিদায় ও বরণের মতো বহু কৃত্য এবং উৎসব। জুলাই গণঅভ্যুত্থান জনসংস্কৃতির এই পরিসর বিকাশের জন্য জনআওয়াজ তুলেছে। রাষ্ট্রকে এই জনআকাঙ্ক্ষা গুরুত্ব দিয়েই সাংস্কৃতিক সংস্কার ও রূপান্তরকে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বহুত্ববাদী চেহারায় রূপ দিতে হবে।

তিতা শাক ও সবজি

মিশ্র তিতাশাক ও সবজি ছাড়া বাঙালি কী আদিবাসী সমাজে বর্ষবিদায় কৃত্য হয় না। গিমা তিতা, নাইল্যা, গিমা, দন্ডকলস, আমরুল, থানকুনি, নিম, নিশিন্দা, তেলাকুচা, মালঞ্চ, কানশিরা, বাসক, ঘৃতিকাঞ্চন, শেফালি, কলমি, হেলেঞ্চা, ঘুম, আদাবরুণ, পিপুল, গন্ধভাদালি, কাঁটাখুদি, ক্ষেতপাপড়া এমন ১৩ থেকে ২৯ রকমের তিতা স্বাদের শাক খাওয়ার চল আছে দেশের নানা জনপদে। পাহাড়ে চাকমারা তিতকরলা, তিত্তুলগুলো, হনাগুলো, বনআলু, কচু, বাঁশকোড়লসহ নানা পাহাড়ি সবজি দিয়ে রান্না করেন 'পাজন'। প্রায় ৩০ থেকে ১০৭ রকমের মিশ্র সবজি এই রান্নাকে চাক ভাষায় বলে 'কাইনবোং', মারমারা বলেন 'হাং-র' এবং ত্রিপুরারা বলেন 'মৈজারবং'।

কাঁচা আম

গাছে গাছে গুটি আম বেশ পুষ্ট হয়ে ওঠে এ সময়। বছরের প্রথম আম খাওয়ার অনুমতি চাওয়া হয়। রবিদাস জনগোষ্ঠীর ভেতর হাজরা-কৃত্যের মাধ্যমে বর্ষবিদায় পালিত হয়। এদিন যবের ছাতু ও কাঁচা আম একত্রে মিশিয়ে আম-ছাতুয়া খাওয়া হয়। চড়ক ও বাইশাখী পূজায় অনেক সময় কাঁচা আম লোহার ত্রিশূলে গেঁথে রাখা হয়। রবিদাস সমাজ তাদের জুতা বানানোর উপকরণ যেমন, শাবল, কাঁচি, ছুরি, বাটাল দেওকুড়ি নামক ধর্মস্থলে রাখে। এ সময় ঢাক, ঢোল, খাজরি, ঝাঝর বাজানো হয়।

শাল-মহুয়া

ফৗগুন (ফাল্গুন) মাস থেকেই শুরু হয় সাঁওতালি বর্ষ। বাহা পরব পালিত হয় এ মাসেই। এ সময় গাছে গাছে সারজম, ইচৗক, মুরুপ্ আর মহুয়া ফুল ফোটে। বাহা পরবের মাধ্যমে সাঁওতাল সমাজ এসব ফুলের মধু পান ও ব্যবহারের অনুমতি প্রার্থনা করে। বাহার আগে এসব ফুলের ব্যবহার সামাজিকভাবে নিষেধ।

বিজু ফুল

পাহাড়ে বিজু বা ভাতজরা ফুল ফুটলেই বিজুর সময় হয়। অনেকে একে বেই ফুলও বলেন। এ সময় বিজু পাখি পাহাড়ে পাহাড়ে ডাকে। ফুল বিজু, মূল বিজু ও গয্যাপয্যা দিন এ তিন পর্বে বিভক্ত বিজুর ফুলবিজু দিয়ে। পাহাড়-টিলা-বন ও গ্রাম ঘুরে ঘুরে শিশু, কিশোর ও নারীরা সংগ্রহ করেন ভাতজরা ফুল। মালা গাঁথা, শুভেচ্ছা বিনিময় ও ঘর সাজাতে লাগে এই বুনো ফুল।

কাইনকো

কাইকনো বা নাগেশ্বর ফুলও বর্ষবিদায় ও বরণের প্রকৃতির চিহ্ন। চাকরা সাংগ্রাইংয়ের সময় কাইনকো ফুল সংগ্রহে মুখরিত হয়ে ওঠেন। 'পাইংছোয়েত' বা ফুল দিন পর্বে দিন গ্রামে গ্রামে আয়োজিত হয় পেকো (গিলা), গ্যাং (লাটিম), মাইকানিকছা (কানামাছি) নামের নানান চাক খেলা। সাংগ্রাইংয়ের দ্বিতীয় দিন হলো আক্যাই। এদিনে পাড়ার যুবসম্প্রদায় বাইক (ঢোল), লাংহোয়াক (ঝাঁঝ) ও হ্নে (বাঁশী) বাজিয়ে সবাই ক্যাং বা মন্দিরে যায়।

চড়ক গাছ ও গাজনের দল

চৈত্র সংক্রান্তির সর্বাধিক পরিচিত চিহ্ন হলো গ্রামাঞ্চলে ঘুরে বেড়ানো গাজন, দেল, নীল বা চড়কের দল। লাল সালু কাপড় পরিধান করে এবং শিব-গৌরি সেজে, কেউবা মুখোশ চাপিয়ে মাগন সংগ্রহ করেন। চড়ক পূজার শালকাঠের চড়ক গাছ এবং নীল কাঠও এক অনন্য চিহ্ন।

গ্রামীণ মেলা

চৈত্র সংক্রান্তি ও পহেলা বৈশাখে গ্রাম জনপদের আদি মেলা গুলোও এক ধরনের জনচিহ্ন। গাজীপুর, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা, নাটোর, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, চট্টগ্রামসহ দেশের নানাপ্রান্তে কিছু প্রাচীন মেলা এখনো টিকে আছে। চট্টগ্রামের কদলপুওে এক প্রাচীন বিজু মেলার কথা জানা যায়, যা, বহু আগেই বিলুপ্ত হয়েছে।

রাষ্ট্র নয়, জনগণই চিহ্নের খাদেম

আমরা ক্রমান্বয়ে প্রকৃতির জটিলসব চিহ্নরেখা থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। ঋতুর অদলবদল এবং ঐতিহাসিক ব্যাকরণ ধরতে পারছি না। আর তাই বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ নিয়ে তৈরি হচ্ছে এক অপরিচিত নয়া তর্কের তল এবং নানা অধিপতি চিহ্নের বাহাদুরি। দেশের গ্রামীণ নিম্নবর্গের কৃষি উৎপাদন এবং ইকোসিস্টেমের সঙ্গে তাদের ঐতিহাসিক সম্পর্ককে অবজ্ঞা করে বারবার নানা বাইনারি ন্যারেটিভ এবং বলপ্রয়োগ চাপানোর চেষ্টা চলছে। চৈত্রসংক্রান্তি কিংবা পহেলা বৈশাখ মানে হলো কোনো ঋতু শেষ হয়ে আরেক ঋতুতে প্রবেশের সন্ধিক্ষণ। আর এই সন্ধিক্ষণের সাথে মিতালী ও বন্ধুত্ব তৈরি করা জরুরি, কোনো সংঘাত বা দ্বন্দ্ব নয়। জনগণ প্রকৃতিকে পাঠ করেছে যেসব সাংস্কৃতিক চিহ্নের ভেতর দিয়ে রাষ্ট্রকে সেই সংস্কৃতি বিকাশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
 

পাভেল পার্থ: গবেষক ও লেখক

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English

JnU second campus: Project stalled amid bureaucratic hurdles

The construction of Jagannath University’s long-awaited second campus in Keraniganj has stalled due to bureaucratic delays.

4h ago