চট্টগ্রামের উন্মুক্ত নালা যেন মৃত্যুফাঁদ

পাঁচ বছরে অন্তত ১৪ জনের মৃত্যু
চট্টগ্রাম মহানগরীর সড়কের পাশের উন্মুক্ত নালা যেন মৃত্যুফাঁদ। ছবিটি গতকাল দুপুরে মুরাদনগর এলাকা থেকে তোলা। ছবি: রাজীব বায়হান/স্টার

উন্মুক্ত নালায় পড়ে একের পর এক মৃত্যু যেন নিয়তিতে পরিণত হয়েছে চট্টগ্রামের বাসিন্দাদের। সবশেষ গত শুক্রবার রাতে চট্টগ্রামের কাপাসগোলা এলাকায় খোলা নালায় পড়ে ছয় মাসের শিশু নিখোঁজের ১৪ ঘণ্টা পর তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়

সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, নগরীর এক হাজার ৬০০ কিলোমিটার নালা-নর্দমা আর খালের মধ্যে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (চউক) আওতায় রয়েছে ৩০০ কিলোমিটার। বাকিটা রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের।

চট্টগ্রামে নালায় পড়ে নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা এই প্রথম নয়। ২০২১ সালের ২৫ আগস্ট মুরাদপুর মোড়ে বৃষ্টির মধ্যে খোলা নালায় পড়ে নিখোঁজ হন সবজি বিক্রেতা সালেহ আহমেদ। দীর্ঘ সময় উদ্ধার অভিযান চালিয়েও তার মরদেহ পাওয়া যায়নি।

একই বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর নাগরীর আগ্রাবাদ এলাকায় হাঁটার সময় নালায় পড়ে মারা যান বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সেহেরীন মাহবুব সাদিয়া।

২০২২ সালে ষোলশহর এলাকায় শিশু কামাল নালায় পড়ে নিখোঁজ হয় এবং তিন দিন পর মুরাদপুর থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়।

২০২৩ সালের ২৮ আগস্ট আগ্রাবাদ রঙ্গীপাড়া এলাকায় দেড় বছর বয়সী শিশু ইয়াছিন আরাফাত নালায় পড়ে নিখোঁজ হয়। নিখোঁজের ১৬ ঘণ্টা পর তার মরদেহ উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস।

২০২৪ সালের জুনে গোসাইলডাঙ্গা এলাকায় সাত বছরের শিশু সাইদুল ইসলাম নালায় পড়ে নিখোঁজ হয় এবং পরদিন নাছির খাল থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়।

মায়ের কোল থেকে ছিটকে এই নালায় পড়ে গিয়েছিল ছয় বছরের শিশুটি। পরে বাঁশের বেড়া দেওয়া হয়েছে। ছবিটি গতকাল দুপুরে তোলা। ছবি: রাজীব রায়হান/স্টার

নগরবাসীর অভিযোগ, নগরীর অধিকাংশ খালের দুই পাশে নিরাপত্তা বেষ্টনী না থাকা, নালার ওপর স্লাব না থাকায় খাল ও নালাগুলো মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে।

এ পর্যন্ত নগরীর নালা-খাল কিংবা ড্রেনে পড়ে ঠিক কতজনের মৃত্যু হয়েছে, তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যা নেই সিটি করপোরেশন কিংবা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কাছে।

গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে অন্তত ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে দুইজনের মরদেহের খোঁজ আজও মেলেনি।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে খাল-নালায় পড়ে ডুবে মারা যান পাঁচজন। ২০২২ সালে একজন, ২০২৩ সালে তিনজন, ২০২৪ সালে নিখোঁজ ও মারা যান চারজন। আর গতকাল নগরীর চকবাজারে নিখোঁজ হয় ছয় মাসের শিশু সেহরিশ।

কাপাসগোলা এলাকার বাসিন্দা জাহিদ হোসেন বলেন, 'শুধু উন্মুক্ত নালায় নয়, পুরো শহরের অধিকাংশ নালা-খালই এখন মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। এত প্রাণ যাওয়ার পরও কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেই। কেউ মারা গেলে কয়েকদিন বেশ হাঁক-ডাক চলে। এরপর চাপা পড়ে যায় নিরাপদ নগরীর গড়ার দাবি।'

নালায় পড়ে শিশু নিহত হওয়ার পর শনিবার সকালে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, 'নগরীর ৩৬টি খালে জলাবদ্ধতা প্রকল্পের কাজ করছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। বাকি একটি খালে কাজ করছে সিটি করপোরেশন। প্রকল্পের কাজগুলো দ্রুত এগিয়ে চলেছে। আশা করছি দ্রুত সময়ের মধ্যে খালের দুই পাশে নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করা হবে।'

মায়ের কোল থেকে ছিটকে এই নালায় পড়ে গিয়েছিল ছয় বছরের শিশুটি। পরে বাঁশের বেড়া দেওয়া হয়েছে। ছবিটি গতকাল দুপুরে তোলা। ছবি: রাজীব রায়হান/স্টার

তিনি আরও বলেন, 'উন্মুক্ত নালায় রিটার্নিং ওয়াল তৈরির জন্য আমরা উদ্যোগ নিয়েছি। কাজ চলমান রয়েছে। শুক্রবার রাতে কাপাসগোলা এলাকার যে স্থানে দুর্ঘটনা ঘটেছে সেখানে বাঁশ দিয়ে নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করে দিয়েছে সিটি করপোরেশন।'

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা বিভাগের উপ প্রধান পরিচ্ছন্নতা কর্মকর্তা প্রণব কুমার শর্মা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নগরীর জলাবদ্ধতা প্রকল্পের কাজ শেষ হলে নালাগুলোতে স্লাব দিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হবে।'

গত পাঁচ বছরে চট্টগ্রামে নালায় পড়ে কতজনের মৃত্যু হয়েছে? এর কোনো পরিসংখ্যান সিটি করপোরেশনে আছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমাদের কাছে এমন কোনো তথ্য নেই।'

নগর পরিকল্পনাবিদ ইঞ্জিনিয়ার দেলোয়ার মজুমদার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা সিটি করপোরেশনকে আগেও বলেছি রাস্তার পাশের নালা, খাল, জলাশয়গুলোতে নিরাপত্তা বেষ্টনী করে দিতে। কিন্তু আমাদের কথা কেউ শোনেনি। প্রতি বছর চট্টগ্রামে এমন দুর্ঘটনা ঘটছে। এটা দুঃখজনক। অন্তত রাস্তার পাশের নালা, খাল, জলাশয়গুলোতে নিরাপত্তা বেষ্টনী গড়ে তোলা হলে এমন দুর্ঘটনার হার কমে যাবে।'

Comments