আলুচাষিদের বাঁচাবে কে

হিমাগারে জায়গা নেই। ভাড়াও বেশি। নিরূপায় কৃষক উৎপাদিত আলু রেখেছেন সড়কের পাশে। শুক্রবার রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলার মহিষখণ্ড গ্রাম থেকে তোলা ছবি। আলোকচিত্রী: আজাহার উদ্দিন/স্টার

বাজারে আলুর দাম এখন উৎপাদন খরচের চেয়ে কম। অন্যদিকে হিমাগারের ভাড়া যেমন বাড়িয়েছেন এর মালিকরা, তেমনি মোট উৎপাদনের তুলনায় হিমাগারের সংখ্যাও অপ্রতুল। তাই জেলায় জেলায় কৃষকের ঘরে-মাঠে-উঠানে কিংবা সড়কের পাশে এখন আলুর স্তূপ।

কৃষকদের আশা ছিল, এবার তারা বেশি দামে আলু বিক্রি করতে পারবেন। কিন্তু লম্বা অপেক্ষার পরও দাম না বাড়ায় জমা করে রাখা আলু গরমে-বৃষ্টিতে পঁচতে শুরু করেছে।

হিমাগারের ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে কোথাও কৃষকরা রাস্তায় আলু ফেলে প্রতিবাদ জানিয়েছেন, কোথাও প্রত্যাশিত দাম না পেয়ে উৎপাদিত আলু গরুকে খাওয়ানোর খবরও এসেছে গণমাধ্যমে।

এমন পরিস্থিতিতে চাষিদের বাঁচাতে সরকারের পক্ষ থেকে ধান-চালের মতো আলুর ন্যুনতম সহায়ক মূল্য নির্ধারণ করা ও তাদের কাছ থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ আলু কেনা এবং ছোট ও প্রান্তিক চাষিদের জন্য হিমাগারগুলোতে জায়গা সংরক্ষিত রাখা উচিত ছিল বলে মনে করেন লেখক, গবেষক গওহার নঈম ওয়ারা। পাশাপাশি সংরক্ষণজনিত সমস্যার টেকসই সমাধানে সরকারি উদ্যোগের বাইরে 'অহিমায়িত মডেল ঘর' নির্মাণে সহযোগিতার হাত বাড়াতে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাকে এগিয়ে আসার আহ্বানও জানিয়েছেন তিনি।

সেইসঙ্গে 'আইন ভেঙে' হিমাগারের ভাড়া বাড়ানোর জন্য মালিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া এবং উদ্বৃত্ত আলু রপ্তানির জন্য নতুন বাজার খোঁজার তাগিদও এসেছে এই গবেষকের কাছ থেকে।

আর কৃষি বিপণন অধিপ্তরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) নাসির-উদ-দৌলা বলছেন, নিজ নিজ উদ্যোগে প্রাকৃতিক উপায়ে আলু সংরক্ষণের বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারলে কৃষকরা এমন ক্ষতি অনেকটা পুষিয়ে উঠতে পারবেন। এক্ষেত্রে ব্যক্তিমালিকানার হিমাগারগুলোর ওপর নির্ভরশীলতাও কমে আসবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

সরকারি হিসাব অনুসারে, সংরক্ষণের অভাবে প্রতিবছর উৎপাদিত আলুর ৩০ শতাংশ নষ্ট হয়। ছবি: আজাহার উদ্দিন/স্টার

সাধারণত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ থেকে হিমাগারে আলু সংরক্ষণ শুরু হয়। এই কার্যক্রম চলে জুলাই পর্যন্ত। এরপর আলু খালাস (খুচরা বাজারে সংরক্ষিত আলু বিক্রি) শুরু হয়, যা চলে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত। তারপর বাজারে নতুন আলু আসতে শুরু করে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের ইতিহাসে রেকর্ড পাঁচ লাখ ২৪ হাজার হেক্টর জমিতে আলু চাষ হয়েছে। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় তা ১৫ শতাংশ বেশি।

চলতি মৌসুমে মোট উৎপাদন ১ কোটি ২০ লাখ টন হবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন (বিসিএসএ)। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রাক্কলন ১ কোটি ৬ লাখ টন।

ডিএই'র হিসাবে, দেশে আলুর বার্ষিক চাহিদা প্রায় ৯০ লাখ টন। এর মধ্যে হিমাগারের ধারণক্ষমতা ৪৫ লাখ টনের মতো। আর সরকার মনে করে, হিমাগার সুবিধার অভাবে মোট উৎপাদনের প্রায় ৩০ শতাংশ আলু নষ্ট হয়। 

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার আগ্রহে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর আলুর বহুমুখী ব্যবহার, সংরক্ষণ ও বিপণন উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে রংপুর বিভাগসহ দেশের ১৬টি জেলায় ৪৫০টি অহিমায়িত মডেল ঘরে আলু সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়। গত অর্থবছরে রংপুর জেলায় ৭৫টি অহিমায়িত মডেল ঘরের মধ্যে ৪৫টিতে আলু সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। সরকারি খরচে একেকটি ঘর নির্মাণে ব্যয় হয় দেড় লাখ টাকার মতো।

নওগাঁর এক চাষির বিকল্প আলু সংরক্ষণের ঘর। ছবি: গওহার নঈম ওয়ারা

অধিদপ্তরের ভাষ্য, এটি একটি বিজ্ঞানসম্মত মিনি কোল্ড স্টোরেজ। অধিদপ্তরের নিজস্ব নকশার এমন একেকটি ঘর ১৫ বছর পর্যন্ত ব্যবহারের উপযোগী থাকে। তা ছাড়া এসব ঘর থেকে চাষি ইচ্ছেমতো আলু বিক্রি করতে পারেন। ভাড়া টাকা সাশ্রয় হয়।

কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) নাসির-উদ-দৌলা বিষয়টি নিয়ে বলেন, 'এই প্রকল্পটি চলমান আছে। আমরা অনেকদূর এগিয়ে গিয়েছি। প্রায় ৭৯ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। প্রকল্পটি পুরোপুরি শেষ হলে অন্তত আলু-পেঁয়াজ নিয়ে কোনো চিন্তা থাকবে না। যখন দাম কমবে কৃষক তা সংরক্ষণ করবে। দাম বাড়লে বিক্রি করতে পারবে।'

এ ব্যাপারে লেখক-গবেষক গওহার নঈম ওয়ারা বলেন, 'এমন একেকটা ঘরে কৃষক পাঁচ হাজার, ছয় হাজার টন আলু রাখতে পারে। সেটাই আমাদের করতে হবে আলটিমেটলি।'

এ সময় হিমাগারের ভাড়া বৃদ্ধি নিয়েও সমালোচনা করেন এ গবেষক। বলেন, 'সরকারের আইনই আছে যে, কোল্ড স্টোরেজগুলো তাদের ইচ্ছেমতো দাম বাড়াতে পারবে না। এবার তারা প্রেস কনফারেন্স করে দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। এদের তো জেলে পাঠানো উচিত। কারণ তারা আইন মানেনি। তারা আঁতাত করে এটা করেছে। এক্ষেত্রে কৃষককে একটা পার্টি হিসেবে রাখতে হতো।'

গত ৮ ফেব্রুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে ভাড়া বাড়ানোর ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন (বিসিএসএ)। হিমাগারে সংরক্ষণে কেজিপ্রতি ভাড়া নির্ধারণ করা হয় ৮ টাকা। আর প্রতি বস্তায় ৫০ কেজি আলু রাখার বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়। যদিও আগে কৃষকরা ৭০ কেজির বস্তা ৩৫০ টাকায় কোল্ড স্টোরেজে রাখতেন। এতে কেজিপ্রতি ভাড়া পড়ত ৫ টাকা। কিন্তু নতুন নিয়মে কেজিপ্রতি ভাড়া ৬০ শতাংশ বেড়ে দাঁড়ায় ৮ টাকায়। যদিও হিমাগার মালিকদের দাবি, কেজিপ্রতি ভাড়া ৭ থেকে বাড়িয়ে ৮ টাকা করা হয়েছে।

এ বিষয়ে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক নাসির-উদ-দৌলা বলেন, 'এটা (কৃষি) মন্ত্রণালয় করেছে। এখানে আমাদের কোনো লোক ছিল না। মিনিস্ট্রি একটা টিম করে দিয়েছিল। টিম অন্যদের সঙ্গে মিটিং করে এটা করেছে।'

চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের ইতিহাসে রেকর্ড পাঁচ লাখ ২৪ হাজার হেক্টর জমিতে আলু চাষ হয়েছে। ছবি: আজাহার উদ্দিন/স্টার

এছাড়া আলু নিয়ে বাংলাদেশে বিদ্যমান পরিস্থিতির সঙ্গে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের তুলনা করেন গওহার নঈম ওয়ারা। তিনি বলেন, 'পশ্চিমবাংলার যে কৃষকরা আলু বিক্রি করতে পারেনি তা নির্ধারিত মূল্যে কিনে নিয়েছে সেখানকার সরকার। কোল্ডস্টোরেজগুলোকে বলেছে, "যে বাড়তি খরচ হচ্ছে বলে তোমরা দাবি করছ, সেটা আমাদের দেখাবে। ওই খরচটা আমরা দেব। তুমি কৃষকের ওপর আলাদা চার্জ করতে পারবে না।" এই পদক্ষেপগুলো তো আমরাও নিতে পারতাম।'

আলু সংরক্ষণে প্রাকৃতিক ঘর নির্মাণের ব্যাপারে এই গবেষকের ভাষ্য, 'সরকারের এই ঘর করতে যে খরচ হচ্ছে সেটা যদি তারা কৃষকের ওপর ছেড়ে দেয় সেটা মাত্র ৮০ হাজার টাকায় করা সম্ভব।'

এ কাজে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোকেও এগিয়ে আসার আহ্বান জানান গওহার নঈম ওয়ারা। বলেন, 'পিকেএসএফের কাছে, মাইক্রোক্রেডিট ফাইন্যান্স অর্গানাইজেশনগুলোর কাছে হাজার হাজার কোটি টাকা আছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আছে। সুদমুক্ত ঋণ হিসেবে দিলে কৃষক টাকাটা দ্রুত শোধ করে দিতে পারে। ব্র্যাকের মতো অর্গানাইজেশন যদি আসে সে একাই পারবে। এটা তো তাদের ব্যবসা। তারা তো ক্ষুদ্রঋণ নিয়েই কাজ করে। কম সুদে টাকাটা দিয়ে সে উঠিয়ে নিতে পারবে।'

বেসরকারি উদ্যোগে আলু সংরক্ষণে প্রাকৃতিক ঘর তৈরির একটি উদাহরণও তুলে ধরেন এ লেখক। বলেন, 'রাজশাহী প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক নিজেরা একটা ফান্ড তৈরি করে গাইবান্ধায় গিয়ে এমন ঘর বানানো শুরু করেছে। এটাকে আরও পরিচিত করতে হবে। মানুষকে জানাতে হবে যে এটা এভাবে করা সম্ভব; ছোট ছোট কৃষক সমাবেশের মাধ্যমে, প্রচারণার মাধ্যমে।'

দেশে আলুর বার্ষিক চাহিদা প্রায় ৯০ লাখ টন। এর মধ্যে হিমাগারের ধারণক্ষমতা ৪৫ লাখ টনের মতো। রাজশাহীর তানোর উপজেলার কালিগঞ্জ এলাকা থেকে তোলা। ছবি: আজাহার উদ্দিন/স্টার

তিনি আরও বলেন, 'এই ঘরের ডিজাইনটা পাবলিক করে দেওয়া উচিত। ইভালুয়েশন হওয়া উচিত। এর ভেতর দিয়ে খরচটা কমিয়ে আনা যেতে পারে। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গেও এটা শেয়ার করা উচিত। এখান থেকে যারা বের হচ্ছেন তাদের অনেকেই তো কৃষি কর্মকর্তা হবেন। তাদেরও এটা জানা উচিত।'

এর পাশাপাশি উদ্বৃত্ত আলু রপ্তানির জন্য নতুন বাজার খোঁজার তাগিদ দেন তিনি। বলেন, 'আলু রপ্তানির জন্য নতুন বাজার খুঁজতে হবে। সেটা নেপাল হতে পারে, শ্রীলঙ্কা হতে পারে। এ জন্য সেই মানের আলুও উৎপাদন করতে হবে।'

ভারতে উত্তরপ্রদেশের পর দ্বিতীয় বৃহত্তম আলু উৎপাদক রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ। ছোট ও প্রান্তিক চাষিদের আলু বাধ্য হয়ে কম দামে বিক্রি এড়াতে এবার কুইন্টাল-পিছু আলুর ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ৯০০ টাকা স্থির করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার এবং চাষিদের কাছ থেকে ১১ লাখ টন আলু কেনার পরিকল্পনা করেছে।

এছাড়া গত বারের মতো এ বছরেও রাজ্যের হিমাগারগুলোতে যে ৮০ লাখ টনের মতো আলু মজুতের ব্যবস্থা আছে, তার ৩০% সংরক্ষিত রাখা হয়েছে প্রান্তিক ও ছোট চাষিদের জন্য।

বিষয়টি নিয়ে গওহার নঈম ওয়ারা বলেন, 'চাষিদের অনেকটা ক্ষতি এর মধ্যেই হয়ে গেছে। চাষিদের বাঁচাতে বাংলাদেশে সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরনের ব্যবস্থা আগেই নেওয়া উচিত ছিল।'

Comments

The Daily Star  | English

Cops get whole set of new uniforms

The rules were published through a gazette yesterday, repealing the previous dress code of 2004

1h ago