সংকটে বেসরকারি এয়ারলাইনস: তিন দশকে ১০টির মধ্যে টিকে আছে ২টি

জ্বালানির উচ্চ মূল্য, অতিরিক্ত সারচার্জ এবং অপারেটরদের ভাষায় প্রতিকূল নীতিমালার কারণে দেশের বেসরকারি এয়ারলাইনস খাত টিকে থাকার লড়াইয়ে হিমশিম খাচ্ছে। গত তিন দশকে ১০টি বেসরকারি এয়ারলাইনস যাত্রা শুরু করলেও বর্তমানে চালু আছে মাত্র দুটি—ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স এবং এয়ার অ্যাস্ট্রা।

কয়েক সপ্তাহ ধরে ফ্লাইট বন্ধ থাকার পর আগামী ২১ মে থেকে নভোএয়ার পুনরায় ফ্লাইট চালু করার পরিকল্পনা করলেও তীব্র আর্থিক সংকটের মুখে রয়েছে, যা এই খাতের বিপজ্জনক অবস্থাকেই আরও স্পষ্ট করে তুলছে। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুরোনো নীতিমালা, অতিরিক্ত ফি এবং সরকারি সহায়তার অভাবে এ খাতটি ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ছে। এর মধ্যেই আন্তর্জাতিক এয়ারলাইনসগুলো এখানে নিজেদের আধিপত্য আরও মজবুত করেছে। বর্তমানে তারা প্রায় ৭৫ শতাংশ যাত্রী পরিবহন নিয়ন্ত্রণ করছে, ফলে স্থানীয় অপারেটরদের ক্রমশ ছোট হতে থাকা বাজারে টিকে থাকার লড়াই করতে হচ্ছে।

এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, বাংলাদেশের বাজারে বিদেশি এয়ারলাইনসগুলো যেখানে সফলভাবে ব্যবসা করছে, সেখানে স্থানীয় এয়ারলাইনসগুলোর অবস্থা শোচনীয়। এর প্রধান কারণ হলো দেশের এভিয়েশন নীতিমালা এই খাতের বিকাশে সহায়ক নয়।'

বর্তমানে ঢাকা থেকে যাতায়াতকারী ৩৯টি বিদেশি এয়ারলাইনসের বিপরীতে বাংলাদেশ বিমানসহ মাত্র তিনটি দেশীয় এয়ারলাইনস ফ্লাইট পরিচালনা করছে। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) তথ্য অনুসারে, গত বছর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে ১ কোটি ২৪ লাখ যাত্রী ভ্রমণ করেছেন, যা ২০২৩ সালে ছিল ১ কোটি ১৬ লাখ।

স্থানীয় এয়ারলাইনসগুলো কেন এগোতে পারছে না— জানতে চাইলে নভোএয়ারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মফিজুর রহমান বলেন, 'অযোগ্যতা এবং দুর্বল ব্যবস্থাপনার জন্য প্রায়শই উদ্যোক্তাদের দায়ী করা হয়। এটি আংশিকভাবে সত্য হতে পারে। তবে এটাও বিবেচনা করা উচিত যে, তারা এমন একটি খাতে বিনিয়োগ করেন, যেখানে সরকারের প্রতিটি স্তর বেসরকারি এয়ারলাইনসের প্রতি অনুকূল তো নয়ই, বরং অনেক ক্ষেত্রে বিরূপ আচরণ করে।'

মফিজুর রহমান, যিনি এভিয়েশন অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের মহাসচিবও তিনি বলেন, বেবিচকের নিয়মকানুন পুরোনো এবং আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

তিনি বলেন, বেসরকারি এয়ারলাইনসের উপর আরোপিত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর তাদের পরিচালন ব্যয়ের ৫০ শতাংশ। শিল্পসংশ্লিষ্টরা বেবিচক, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, কর কর্তৃপক্ষ এবং অন্যান্য সরকারি সংস্থাগুলোর কাছে প্রতিকারের জন্য বারবার আবেদন জানালেও এসব আবেদন গুরুত্ব পায় না।

এয়ার অ্যাস্ট্রার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইমরান আসিফ বলেন, 'তিনটি এয়ারলাইনসের প্রধান নির্বাহী হিসেবে আমার ১৫ বছরের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে, আমি বিশ্বাস করি তিনটি পদক্ষেপ দেশের এয়ারলাইনস শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করতে সাহায্য করতে পারে। এগুলো হলো—জ্বালানির দামের সমন্বয়, ফি ও সারচার্জ সংক্রান্ত নীতিমালায় সংস্কার এবং দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা।'

উচ্চ ফি, সারচার্জ

এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্থানীয় এয়ারলাইনসে বকেয়া ফি-র ওপর বছরে সর্বোচ্চ ৭২ শতাংশ পর্যন্ত সারচার্জ জমা হতে পারে।

ভারতে বার্ষিক সারচার্জ ১২ থেকে ১৮ শতাংশের মধ্যে; পাকিস্তানে মাত্র ২ শতাংশ, সিঙ্গাপুরে ৮ শতাংশ এবং ওমানে ১০ শতাংশ।

বাংলাদেশ এভিয়েশন অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন দীর্ঘদিন ধরে মাসিক ৬ শতাংশ হারে ধার্য এই সারচার্জ বাতিল করে তা যৌক্তিক হারে নির্ধারণের দাবি জানিয়ে আসছে সরকারের কাছে।

'একবার সারচার্জের ফাঁদে পড়লে, সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে,' বলেন ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের মুখপাত্র কামরুল ইসলাম।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সারচার্জের চাপ বাড়তে থাকায় জিএমজি এয়ারলাইন্স, ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ এবং রিজেন্ট এয়ারওয়েজ তাদের ফ্লাইট পরিচালনা বন্ধ করে দিয়েছে।

বেবিচকের তথ্য অনুসারে, ২০২০ সালে সর্বশেষ কার্যক্রম বন্ধ করা রিজেন্ট এয়ারওয়েজের বকেয়া সারচার্জের পরিমাণ ২৮৩ কোটি টাকা। ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের ৩৫৫ কোটি এবং জিএমজি এয়ারলাইন্সের ৩৬৮ কোটি টাকা।

এছাড়াও বিমান অবতরণ ও পার্কিং ফিও অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় এখানে অনেক বেশি।

উদাহরণ হিসেবে কামরুল ইসলাম বলেন, কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরে একটি বোয়িং বিমানের অবতরণ ফি ১৫ হাজার টাকা। অথচ একই বিমান হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামলে সেই ফি দাঁড়ায় ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা।

জেট ফুয়েলের উচ্চ মূল্য

এভিয়েশন খাতসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, যেহেতু এয়ারলাইনস সংস্থাগুলোর মোট পরিচালন ব্যয়ের ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ জেট ফুয়েলের পেছনে খরচ হয়, তাই জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশীয় এয়ারলাইনসগুলো বাণিজ্যিকভাবে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছে না।

মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বাংলাদেশে জেট ফুয়েলের দাম প্রতি লিটারে শূন্য দশমিক ৭৬ ডলারে দাঁড়িয়েছে, যেখানে সিঙ্গাপুরে তা ছিল শূন্য দশমিক ৪৯ ডলার; মালয়েশিয়ায় শূণ্য দশমিক ৫০ ডলার; কাতার ও থাইল্যান্ডে শূন্য দশমিক ৫১ ডলার; ওমানে শূন্য দশমিক ৫৩ ডলার; এবং চীনে শূন্য দশমিক ৫৮ ডলার।

এ প্রসঙ্গে এয়ার অ্যাস্ট্রার প্রধান নির্বাহী ইমরান আসিফ বলেন, 'এমিরেটস বা সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের মতো বড় সংস্থাগুলো, যারা দীর্ঘ পথের ফ্লাইট পরিচালনা করে, তারা বাংলাদেশে ফুয়েল নেয় না জ্বালানির বেশি দামের কারণে। কিন্তু স্থানীয় এয়ারলাইনসগুলোকে বাধ্য হয়েই ২০-৩০ শতাংশ বেশি দামে জ্বালানি কিনতে হয়।'

তিনি আরও বলেন, 'এখানে জেট ফুয়েলের দাম খোলাবাজার নীতিমালা বা স্বতন্ত্র মূল্য নির্ধারণকারী সংস্থার পরামর্শ মতো নির্ধারণ হয় না। এতে দাম নিজেদের ইচ্ছামতো নির্ধারণ করার সুযোগ থাকে।

তিনি আরও বলেন, 'আমাদের দেশের এয়ারলাইনসগুলোকে অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটের জন্য জেট ফুয়েল কেনার সময় ৪২ দশমিক ৬২ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়। অথচ ভারতে এই শুল্ক ৪ শতাংশেরও কম।'

দক্ষ জনশক্তির অভাব, ভুল কৌশল

স্থানীয় বেসরকারি এয়ারলাইনস প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কর্মীবাহিনী গড়ে তোলার জন্য মূলত বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স এবং বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর প্রাক্তন কর্মীদের উপর নির্ভর করে কারণ দেশে দক্ষ এভিয়েশন পেশাদার তৈরি ও প্রশিক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর অভাব রয়েছে।

ইমরান আসিফ বলেন, পাইলট, টেকনিশিয়ান এবং ইঞ্জিনিয়ারসহ স্থানীয় এয়ারলাইনসগুলোর কর্মীবাহিনীর বেশিরভাগই এই প্রাক্তন কর্মীদের নিয়ে গঠিত।

তিনি আরও বলেন, 'বর্তমান পরিস্থিতি এভিয়েশন শিল্পের জন্য একেবারেই অনুকূল নয়। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া প্রশিক্ষণ সুবিধা না থাকলে একটি শক্তিশালী, প্রতিযোগিতামূলক এভিয়েশন খাত গড়ে তোলা সম্ভব নয়।'

বেশ কয়েকটি বেসরকারি বিমান সংস্থায় কাজ করা বিমান বিশেষজ্ঞ এ টি এম নজরুল ইসলাম বলেন, বন্ধ হয়ে যাওয়া এয়ারলাইনসগুলো ত্রুটিপূর্ণ বিপণন কৌশল অনুসরণ করেছিল এবং তাদের বেশিরভাগই অনুপযুক্ত উড়োজাহাজ ও ভুল রুট বেছে নিয়েছিল।

তার যুক্তির সমর্থনে তিনি ঢাকা-দুবাই রুটে ফ্লাইট পরিচালনার জন্য জিএমজি এয়ারলাইন্সের ৫৪০ আসনের বোয়িং-৭৪৭ কেনার কথা উল্লেখ করেন যা বাণিজ্যিকভাবে অকার্যকর প্রমাণিত হয়েছিল।

তিনি উল্লেখ করেন যে সঠিক পরিকল্পনা এবং বাজার বিশ্লেষণে মনোযোগ না দিলে কোনও বাংলাদেশি এয়ারলাইনস একটি নির্দিষ্ট সময়ের বেশি টিকে থাকতে পারবে না।

নিয়ন্ত্রক সংস্থা কী বলছে

বেবিচকের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মঞ্জুর কবির ভূঁইয়া বলেন, স্থানীয় এয়ারলাইনসগুলোর জন্য নির্ধারতি ফি গত কয়েক বছরে বাড়ানো হয়নি।

উচ্চ সারচার্জ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি তখনই প্রযোজ্য হয় যখন কোনো এয়ারলাইনস নির্ধারিত ফি না দেয়। এই হার নির্ধারণ করে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। আমরা শুধু সেটি অনুসরণ করি। আমার জানা মতে, তারা সারচার্জ কমানোর বিষয়টি বিবেচনা করছে। এছাড়া ল্যান্ডিং ও কার্গো চার্জসহ কিছু ফি কমানোর জন্য আমরা সুপারিশ করেছি। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে মন্ত্রণালয়।'

নিয়ন্ত্রক সংস্থার নীতিমালা বেসরকারি এয়ারলাইনসগুলোর জন্য অনুকূল নয়—এই অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'আমাদের কোনো নিয়মই বেসরকারি বিমান সংস্থার বিপক্ষে যায় এমন নয়।'

জেট ফুয়েলের উচ্চমূল্যের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বেবিচক ইতিমধ্যেই বিষয়টি সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলোকে জানিয়েছে।

তিনি আরও বলেন, এভিয়েশন খাতকে এগিয়ে যেতে আমরা  সর্বাত্মক চেষ্টা করছি। কিন্তু কোনো এয়ারলাইনস প্রশাসনিক জটিলতা বা আর্থিক সংকটের কারণে টিকতে না পারলে আমাদের কিছু করার থাকে না।'

Comments

The Daily Star  | English

Opening aid corridors, leasing out ports not this govt’s job

Making decisions on a “humanitarian corridor” to Rakhine and leasing out container terminal of Chittagong Port to foreign companies are not the interim government’s job, said BNP acting chairman Tarique Rahman last night.

2h ago