চা শ্রমিক দিবস: ১০৪ বছর পরও স্বীকৃতির অপেক্ষা

ফাইল ফটো। ছবি: মিন্টু দেশোয়ারা/ স্টার

১৯২১ সালের ২০ মে, ব্রিটিশদের অত্যাচার থেকে মুক্তি পেতে সিলেট অঞ্চলের প্রায় ৩০ হাজার চা-শ্রমিক নিজের জন্মভূমিতে ফেরার চেষ্টা করেন। কিন্তু চাঁদপুরের মেঘনাঘাটে তাদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে চা শ্রমিকদের হত্যা করা হয়। সেই থেকে এই দিনটি 'চা-শ্রমিক দিবস' হিসেবে পালন করে আসছেন চা-শ্রমিকরা। কিন্তু ১০৪ বছর পেরিয়ে গেলেও এই দিনটি এখনো পায়নি সরকারি স্বীকৃতি।  

চা শ্রমিকদের এই রক্তাক্ত ইতিহাস তুলে ধরতে এবং দিবসটি স্মরণে প্রতি বছরই নানা আয়োজনে ২০ মে পালন করে থাকেন চা শ্রমিকেরা। বিভিন্ন চা বাগানে অস্থায়ী শহীদ বেদিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ, চা-শ্রমিক সমাবেশ এবং প্রতিবাদ সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে দিবসটি পালিত হয়। এ সময় শ্রমিকদের প্রধান দাবিগুলো থাকে মজুরি বৃদ্ধি, ভূমি অধিকার এবং চা-শ্রমিক দিবসের সরকারি স্বীকৃতি। তবে এবার এর সঙ্গে চা শ্রমিক হত্যার ইতিহাস পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করার দাবিও যুক্ত হয়েছে।

খাদিম চা-বাগানের সভাপতি সবুজ তাতি বলেন, 'আমাদের পূর্বপুরুষদের মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে এখানে আনা হয়েছিল। অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে যখন তারা নিজ জন্মভূমিতে চলে যেতে চেয়েছিলেন, ওই সময় তাদের গুলি করে হত্যা করা হয়। শত শত চা-শ্রমিককে হত্যা করে মেঘনা নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। অথচ ১০৪ বছরেও আমাদের পূর্বপুরুষদের এই হত্যাকাণ্ডের দিনটি সরকারি স্বীকৃতি পায়নি। আমরা চাই এই দিনটি সরকারিভাবে পালিত হোক।

চা শ্রমিক নেতা গীতা রানী কানু বলেন, 'চা হচ্ছে রপ্তানিমুখী পণ্য। এ খাত থেকে আয় হওয়া বৈদেশিক মুদ্রা দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছে। অথচ যারা এই চা উৎপাদন করেন, সেই শ্রমিকরা এখনো সমাজে অবহেলিত। তাদের পক্ষে কথা বলার কেউ নেই।'

বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়নের মনু-ধলই ভ্যালী কার্যকরী পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নির্মল দাস পাইনকা বলেন, চা-শ্রমিক দিবসটি শতবছরেও স্বীকৃতি না পাওয়ায় তারা হতাশ। এছাড়াও মজুরি বৃদ্ধি, ভূমির অধিকার, চিকিৎসা, শিক্ষা ও আবাসন সুবিধাসহ অবহেলিত চা-শ্রমিকদের বিভিন্ন দাবি উত্থাপন করা হলেও স্থায়ী কোনো সমাধান আজও আসেনি। বারবার দাবি করেও শুধু আশ্বাসেই সীমাবদ্ধ থেকেছে।

হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের 'প্রতীক থিয়েটার' প্রতিবছর এ দিনটি ঘিরে নাট্য আয়োজন করে। এবার ঢাকার শিল্পকলা একাডেমিতে সন্ধ্যা ৭টায় মঞ্চস্থ হবে 'নিজভূমে পরবাসী' নাটকটি।

থিয়েটারের সভাপতি সুনীল বিশ্বাস বলেন, 'বাংলাদেশে অনেক দিবস আছে। কিন্তু এত বড় একটি অন্যায় হলো, তাদের নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করা হলো। অথচ আমাদের এই দিবসটি চা-শ্রমিক দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি।'

চা শ্রমিকদের ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৮৫৪ সালে পরীক্ষামূলকভাবে সিলেটের মালিনীছড়া বাগানে চা চাষ শুরু করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। সে সময় বৃহত্তর সিলেটে চা বাগান তৈরির জন্য আসাম, উড়িষ্যা, বিহারসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে তাদের ভালো থাকার কথা বলে শ্রমিকদের নিয়ে আসা হয়। তবে ভুল ভাঙতে বেশি সময় লাগেনি চা শ্রমিকদের।

পাহাড় পরিষ্কার করে চা বাগান তৈরি করতে গিয়ে হিংস্র পশুর কবলে পড়ে কত শ্রমিকের জীবন গেছে তার হিসাব নেই। এছাড়া ব্রিটিশদের নির্মম অত্যাচার তো ছিলই। এসব নির্যাতনের প্রতিবাদে সেসময় চা শ্রমিক নেতা পন্ডিত গঙ্গাচরণ দীক্ষিত ও পন্ডিত দেওসরণ 'মুল্লুকে চল' (দেশে চল) আন্দোলনের ডাক দেন।

১৯২১ সালের ২০ মে সিলেট অঞ্চলের প্রায় ৩০ হাজার চা শ্রমিক সিলেট থেকে হেঁটে চাঁদপুর মেঘনা স্টিমার ঘাটে পৌঁছান। তারা জাহাজে চড়ে নিজ দেশে ফিরে যেতে চাইলে গোর্খা সেনারা গুলি চালিয়ে শতশত চা শ্রমিককে হত্যা করে। যারা পালিয়ে এসেছিলেন তাদেরকেও আন্দোলন করার অপরাধে নির্যাতনের শিকার হতে হয়। এরপর থেকেই প্রতি বছর ২০ মে চা শ্রমিক দিবস হিসেবে দিনটি পালন করছেন চা শ্রমিকরা।

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাবেক সাধারণ সম্পাদক রামভজন কৈরি বলেন, বারবার দাবি জানানো এবং অনেক আন্দোলনের পরও ১০৪ বছরেও স্বীকৃতি পায়নি দিবসটি। আমরা প্রতি বছরই রাষ্ট্রীয়ভাবে দিবসটি পালনের আহ্বান জানালেও এ ব্যাপারে সরকারি কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ছে না।

Comments

The Daily Star  | English

US, Bangladesh to hold next tariff talks on July 29

If held in person, the team led by commerce adviser will leave for the USA on July 27

36m ago