সরকারি চাকরি আইন সংশোধনে কর্মচারীদের আপত্তি

'সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮' সংশোধন করে বিলুপ্ত ১৯৭৯ সালের বিশেষ আইনের বিধান যুক্ত করার উদ্যোগের প্রতিবাদ জানিয়েছে সচিবালয়ের একাধিক কর্মচারী সংগঠন।
বুধবার 'সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদ' এবং 'আন্তঃমন্ত্রণালয় কর্মচারী অ্যাসোসিয়েশন' যৌথ বিবৃতি দিয়ে এই উদ্যোগ থেকে বিরত থাকতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
আইন সংশোধনের লক্ষ্যে প্রস্তাবিত অধ্যাদেশটি আজ বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে উত্থাপন করা হতে পারে।
প্রসঙ্গত, দাপ্তরিক কাজে বিঘ্ন সৃষ্টিকারী কর্মচারীকে তদন্ত ছাড়াই আট দিনের নোটিশে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া যাবে—এমন বিধান করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদন পেলে রাষ্ট্রপতির অনুমতির পর অধ্যাদেশ আকারে প্রকাশ করবে সরকার। উল্লেখ্য, পুলিশে কর্মরতদের জন্য এ ধরনের আইন বর্তমানে চালু রয়েছে।
বুধবার গণমাধ্যমে পাঠানো যৌথ বিবৃতিতে বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের সভাপতি নূরুল ইসলাম এবং আন্তঃমন্ত্রণালয় কর্মচারী অ্যাসোসিয়েশনের সমন্বয়ক নজরুল ইসলাম বলেন, 'কর্মচারীদের জীবনমান উন্নয়ন ও পেশাগত বিকাশের পরিবর্তে নির্যাতনমূলক কালো আইন, ব্যক্তিগত দাসত্ব ও ভয়-ভীতির পরিবেশ তৈরি করে সচিবালয়কে অশান্ত করার অপচেষ্টা চলছে। যার কারণে কর্মচারীদের মধ্যে আতঙ্ক ও ভীতিকর পরিবেশ তৈরি হয়েছে।'
বিবৃতিতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, 'কালা-কানুন কর্মচারীদের ওপর চাপিয়ে দিলে বর্তমান সরকারের বৈষম্যমূলক নীতি ও ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে।'
'১৯৭৯ সালের আইনের পুনরাবৃত্তি হলে সংবিধানের ১৯, ২১, ২৭, ৩১, ৩৭ ও ৩৮ অনুচ্ছেদের এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে,' উল্লেখ করা হয় বিবৃতিতে।
অপরাধ ও প্রস্তাবিত দণ্ড
সরকারি চাকরি আইন সংশোধনের প্রস্তাবিত খসড়ায় তিন ধরনের শাস্তির কথা বলা হয়েছে—(ক) চাকরি থেকে বরখাস্ত, (খ) চাকরি থেকে অব্যাহতি ও (গ) পদাবনতি বা বেতন কমিয়ে দেওয়া।
প্রথমত, কোনো কর্মচারী যদি এমন কোনো কাজে যুক্ত থাকেন যাতে অন্যান্য কর্মচারীদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয় বা শৃঙ্খলা নষ্ট হয় বা অন্য কোনো কর্মচারীর কাজ করতে সমস্যা হয়।
দ্বিতীয়ত, যদি কোনো কর্মচারী ছুটি বা অন্য কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়া কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকেন বা অন্য যেকোনোভাবে কাজ থেকে বিরত থাকেন।
তৃতীয়ত, অন্য কোনো কর্মচারীকে কাজ থেকে বিরত থাকতে প্ররোচনা দেওয়া বা অন্য কোনো উপায়ে কাজ থেকে নিবৃত্ত রাখতে চেষ্টা করা বা অন্য কোনো কর্মচারীকে তার কর্মস্থলে উপস্থিত হতে বা কাজ করতে বাধা দেওয়া।
উল্লিখিত যেকোনো বিষয়ে দোষী কর্মচারীকে শাস্তি দিতে পারবে সরকার।
দুই ধাপে চূড়ান্ত শাস্তি
প্রস্তাবিত খসড়ায় অভিযুক্ত কর্মচারীকে দুই থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ দিনের মধ্যে অভিযোগের জবাব বা ব্যক্তিগত শুনানিতে অংশ নিতে হবে।
উল্লিখিত সময়ে অভিযোগের জবাব না দিলে বা জবাব দেওয়ার পরও অভিযুক্ত ব্যক্তি দোষী সাব্যস্ত হলে কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট কর্মচারীর বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট শাস্তি আরোপ করে তিন দিনের মধ্যে কারণ দর্শানোর সুযোগ দেবে।
এরপর জবাব না দিলে বা জবাব কর্তৃপক্ষের কাছে সন্তোষজনক বিবেচিত না হলে অভিযুক্ত কর্মচারীর ওপর চূড়ান্তভাবে শাস্তি আরোপ করা হবে। তবে শাস্তির বিরুদ্ধে যথাযথ কর্তৃপক্ষ বরাবর সাত দিনের মধ্যে বা প্রযোজ্য ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির বরাবর ৩০ দিনের মধ্যে আপিল করা যাবে।
এতে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতির কাছে আপিলের মাধ্যমে পাওয়া সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে।
কেন আইন সংশোধন
সরকারি চাকরি আইন অনুযায়ী, বর্তমানে যেকোনো কর্মচারীর চাকরির বয়স ২৫ বছর পূর্ণ হলে কারণ দর্শানো ছাড়াই তাকে বাধ্যতামূলক অবসর দিতে পারে সরকার। এর বাইরে কোনো কর্মচারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে গেলে ২০১৮ সালের শৃঙ্খলা ও আপিল বিধিমালা অনুযায়ী দীর্ঘ মেয়াদি তদন্ত প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়।
সরকারের শীর্ষ একজন কর্মকর্তা জানান, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর কিছু সরকারি কর্মচারী যথাযথভাবে কাজে যোগ দেননি। এদের মধ্যে যাদের চাকরি ২৫ বছর পূর্ণ হয়েছে, তাদের অনেককে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো ও তাদের পাসপোর্ট বাতিল করা হয়েছে। যাদের চাকরির ২৫ বছর হয়নি, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে না পারায় কঠোর আইনের শূন্যতা অনুভব করছে সরকার।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, গণঅভ্যুত্থানের পর ক্যাডার কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন পর্যায়ের সরকারি কর্মচারীদের আন্দোলন প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। যথাযথ আইন না থাকায় তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি, এই অবস্থায় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির প্রত্যাশিত উন্নতি হচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে কর্মচারীরা সরকারের নির্দেশ ঠিক মতো মানছেন না বা দায়িত্ব থেকে কৌশলে দূরে থাকছেন।
সরকারি কর্মচারীদের শৃঙ্খলাহীনতায় সরকারি কাজের গতি ধীর হয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণে ১৯৭৯ সালের অধ্যাদেশটি ফেরাতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করা হয়েছে।
Comments