দুর্নীতি কমাতে ও স্বচ্ছতা বাড়াতে সরকারি ক্রয় আইন সংশোধন

দরপত্রের মূল্যসীমা বাতিল, সব ধরনের সরকারি ক্রয়ের জন্য ই-জিপি বাধ্যতামূলক করা ও এনজিওগুলোকে দরপত্রে অংশ নেওয়ার সুযোগ দিয়ে সরকারের ক্রয় আইন সংশোধন করা হচ্ছে।
'পাবলিক প্রকিউরমেন্ট (সংশোধন) অধ্যাদেশ-২০২৫' শীর্ষক নতুন আইনে প্রকল্প বাজেটে দরপত্রের দাম সরকারের প্রাক্কলনের তুলনায় সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ কম বা বেশি হারে পরিবর্তনের বিধান তুলে নেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ সরকারি ক্রয় কর্তৃপক্ষের (বিপিপিএ) পরিচালক শাহ ইয়ামিন-উল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রকল্প খরচ বেড়ে যাওয়া রোধ ও বাস্তবায়নের সময় খরচের হেরফের এড়াতে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।'
প্রতি বছর জাতীয় বাজেটে প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ রাখা হয় সরকারি ক্রয়ের জন্য।
তিনি আরও বলেন, '২০১৬ সালে পুরোনো পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলস-২০০৮-এ দরপত্রের মূল্যসীমা প্রচলন করা হয়। পরে পেশাগত উদ্বেগের কারণে তা তুলে নেওয়া হয়।'
যদিও অর্ডিন্যান্সে সুনির্দিষ্টভাবে বলা নেই যে বর্তমানে এ জাতীয় কোনো দরসীমা নেই, তবে যে বিধিগুলো প্রণয়ন করা হচ্ছে তা জারির মাধ্যমে স্পষ্ট করা হবে।
গত ৪ মে গেজেটের মাধ্যমে অধ্যাদেশটি জারি হয়। স্বচ্ছতা ও দক্ষতা বাড়াতে সব সরকারি ক্রয়ের জন্য ই-গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্ট (ই-জিপি) পোর্টাল ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
ই-জিপির মাধ্যমে সরকারের মোট কেনাকাটার ৬৫ শতাংশেরও কম হয়। ২০১১ সালে এটি চালু হয়।
শাহ ইয়ামিন-উল ইসলামের মতে, এই অধ্যাদেশে প্রকিউরমেন্ট ক্যাটাগরাইজেশন পদ্ধতিকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।
দীর্ঘদিন ধরে পণ্য, কাজ ও পরিষেবা—এই তিন বিভাগে বিভক্ত নতুন কাঠামোটি 'পরিষেবাগুলো'কে দুটি পৃথক বিভাগ—পরিষেবা ও তথ্যসেবায় ভাগ করা হয়েছে।
এর মধ্যে ক্যাটারিং ও ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের মতো আউটসোর্সড পরিষেবাগুলো আছে। এগুলো ক্রমবর্ধমান চাহিদা ও সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়েছে। এখন এগুলো আলাদাভাবে স্বীকৃত হবে।
তিনি আরও বলেন, 'অধ্যাদেশে জোর দিয়ে বলা হয়েছে যে বাংলাদেশের ক্রয় কাঠামোকে আন্তর্জাতিকমানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করাই এর মূল লক্ষ্য।'
শাহ ইয়ামিন-উল ইসলাম জানান, এটি বিশ্বব্যাংকসহ অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীদের এরকম সুপারিশ ছিল। ২০০১ সাল থেকে সংস্থাগুলো বাংলাদেশের ক্রয় প্রক্রিয়ার সংস্কারে সহায়তা দিচ্ছে।
ক্রয় প্রক্রিয়ায় এসব পরিবর্তনের মাধ্যমে সরকারি প্রকল্পগুলোর কার্যকর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করবে এবং ক্রয় ব্যবস্থার আধুনিকায়ন ও অংশীজনদের আস্থা ফেরাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রকিউরমেন্ট পলিসি কনসালট্যান্ট ফারুক হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সেবার ধরন আলাদা করা একটি মৌলিক কাঠামোগত সংস্কার।'
তার ভাষ্য, 'আগে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলস-২০০৮-তে শুধু "সেবা" শব্দটি ছিল। এ দিয়ে সাধারণত অডিটিং, আর্থিক ব্যবস্থাপনা বা সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টের মতো সেবা বোঝানো হতো।'
'সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে এই ভাবনাটি খুব সংকীর্ণ ছিল।'
ফারুক হোসেন ব্যাখ্যা করে বলেন, 'সেবাগুলো এখন দুই ভাগে বিভক্ত—বুদ্ধিবৃত্তিক সেবা, পরামর্শ, অডিটিং ও সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট এবং অন্যান্য পরিষেবা—যেমন ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট, অপারেশন ও রক্ষণাবেক্ষণ ও কর্মশালা পরিচালনা।'
নতুন আইনে পরিষেবাগুলোকে স্পষ্টভাবে স্বীকৃতি দিয়ে পুরোনো আইনের সমস্যাগুলো সমাধান করে আরও উপযুক্ত ক্রয় ব্যবস্থার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার হলো এনজিওগুলোকে দরদাতা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা।
তিনি আরও বলেন, 'আগে এনজিওগুলোকে কাঠামোগত পার্থক্যের কারণে বাদ দেওয়া হতো। প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত খরচ করার আগে টাকা পায়। ঠিকাদাররা প্রথমে খরচ করেন পরে টাকা পান।'
'এই বৈষম্য অনেক সক্ষম এনজিওকে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক পরিষেবাগুলোর মতো খাতে দরপত্রে অংশ নিতে বাধা দেয়।'
নতুন অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, যথাযথভাবে নিবন্ধিত ও অনুমোদিত এনজিওগুলো এখন সরকারি দরপত্রে অংশ নিতে পারবে। প্রতিযোগিতামূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ের পরিষেবার পথ খুলবে।
এই পরিবর্তনে মানসম্মত দরপত্র তথ্য ব্যবহারে নমনীয়তা দেখানো হয়েছে, বলে মনে করেন ফারুক হোসেন। এটি জটিল অবকাঠামো প্রকল্পগুলোকে সামঞ্জস্যপূর্ণ করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
আরেক উল্লেখযোগ্য নীতিগত পরিবর্তন হলো—দৃশ্যমান পরিষেবার ক্ষেত্রে আলোচনার অনুমতি দেওয়া।
তিনি আরও বলেন, 'আগে বুদ্ধিবৃত্তিক সেবার জন্য দরকষাকষির সুযোগ কম ছিল। এখন, দৃশ্যমান পরিষেবা—যেমন ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট বা পরিচালন সহায়তার জন্য নির্দিষ্ট শর্তে আলোচনার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এটি দীর্ঘদিন ধরে প্রতীক্ষিত ছিল।'
ফারুক হোসেন জানান, সরকার জাতীয় প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রে ১০ শতাংশ মূল্যসীমা ও সীমিত দরপত্রে পাঁচ শতাংশ সীমা সরিয়ে দিয়েছে। ফলে দরদাতারা আরও বাস্তবসম্মত দাম দিতে পারবেন।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান এই পরিবর্তনকে স্বাগত জানিয়েছেন। তার মতে, বড় প্রকল্পে দরপত্র দিতে দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর যৌথ উদ্যোগকে উৎসাহিত করবে।
তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এ ধরনের অংশীদারিত্ব সক্ষমতা বাড়াবে। সততার সঙ্গে কাজ করা গেলে অপচয় কমাবে।'
তবে অপব্যবহার রোধে দরপত্রে অংশ নেওয়া এনজিওগুলোকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে বলে সতর্ক করেন তিনি। যাতে বাণিজ্যিক কার্যক্রমের মাধ্যমে এসব প্রতিষ্ঠানের 'অলাভজনক' মানদণ্ডের অপব্যবহার না হয়।
তার মতে, কঠোর পর্যবেক্ষণ ও প্রাতিষ্ঠানিক শুদ্ধাচার ছাড়া সুপ্রণোদিত আইনেরও অপব্যবহার হতে পারে।
Comments