স্টুডিও জিবলি এবং শৈশবের ঘোরলাগা দিনগুলো

স্টুডিও জিবলি
ছবি: সংগৃহীত

আকাশে মাছের মতো উড়ে বেড়ায় বিশালকায় প্রাণী, বাসে উঠে দেখা যায় চালক একটা বিড়াল, আর বনভূমির মাঝে দেখা যায় এক দানবের মতো কিন্তু ভালোবাসাময় সত্তা দাঁড়িয়ে আছে— যে কি না শিশুদের ভয় না পেয়ে ভালোবাসতে শেখায়! ছোটবেলায় বুঝিনি, এই কার্টুনগুলোই জাপানের বিখ্যাত স্টুডিও জিবলির সৃষ্টি। এখন বুঝি, আমার কল্পনার রংগুলোর অনেকটাই জিবলি মুভির রং-তুলিতেই আঁকা হয়েছিল।

জিবলি স্টুডিও: এক কল্পনার মহাবিশ্ব

স্টুডিও জিবলি ১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত এবং এর সৃষ্টির পেছনে রয়েছেন পরিচালক হায়াও মিয়াজাকি। তিনি এমন এক জগত গড়েছেন, যেখানে শিশুর চোখ দিয়ে দেখা যায় বাস্তবতা। কল্পনা সেখানে বাস্তবেরই আরেক রূপ। এই স্টুডিওর প্রতিটি সিনেমা একেকটি জীবন্ত চিত্রকাব্য। মাই নেইবার তোতোরো, স্পিরিটেড অ্যাওয়ে কিংবা কিকিস ডেলিভারি সার্ভিস—সবগুলোতেই একটা সরল বিস্ময় আছে। আর আছে এক গভীর নস্টালজিয়া।

এই সিনেমাগুলো  আসলে শুধু কার্টুন নয়। এগুলো সময়ের ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা এক অনুভূতি, যেখানে বড়রাও নিজেদের ছোটবেলায় বেরিয়ে আসতে পারেন।

আমাদের ছোটবেলায় হাতে গোনা কয়েকটি চ্যানেল ছিল মাত্র। আর সেখানেই একদিন দেখতে পাই অদ্ভুত এক সিনেমা। এক মেয়ে একটা রহস্যময় জগতে হারিয়ে গেছে, তার বাবা-মা শূকর হয়ে গেছে, আর সে এক ভূত-পরী-জাদুতে ভরা গ্যাস হাউসে কাজ করছে। সেটি ছিল স্পিরিটেড অ্যাওয়ে, আমার দেখা প্রথম জিবলি সিনেমা। এই যে একজগতে বাস্তব আর অবাস্তব দুটোই হাত ধরাধরি করে চলে, এটা যেন আমার নিজের কল্পনারই ভাষা ছিল। এরপর যতবার তোতোরো দেখেছি, মন চেয়েছে ঘরের পাশে এমন এক বন থাকুক, যেখানে আমিও গিয়ে নির্ভার চিত্তে এমন শান্তির ঘুম ঘুমাতে পারি।

কেন জিবলি এত প্রভাব ফেলে

জিবলির মুভিগুলোতে প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্ক, নারী স্বাধীনতা, যুদ্ধবিরোধী বার্তা বারবার উঠে আসে। আমার শৈশবেও হয়তো অনেক না পাওয়া ছিল, একাকিত্বও ছিল। কিন্তু তোতোরো বা কিকি যখন আমার সঙ্গী ছিল, তখন মনে হতো, আমি একা নই। এই সিনেমাগুলোর মাধ্যমে আমি শিখেছি, ছোটবেলার কল্পনাও এক ধরনের সাহস। কিন্তু জিবলি আমাকে চিনিয়েছিল 'চিহিরো', 'সান', 'কিকি', কিংবা সোফিদের। তারা ভয় পায় ঠিকই, কিন্তু ভয়ের কাছে হার মানে না। তারা কারো 'প্রিন্সেস' হয়ে আসেনি কারো জন্য অপেক্ষা করতে—তারা নিজেরাই পথ খুঁজে নেয়, নিজেকে রক্ষা করে।

প্রিন্সেস মনোনোকে মুভি দেখার সময় আমি প্রথমবার বুঝেছিলাম—বন কেবল গাছপালা নয়, সেখানে প্রাণ আছে, সম্পর্ক আছে। জিবলি স্টুডিও বারবার আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়, মানুষ প্রকৃতিকে শোষণ করছে। কিন্তু মানুষই আবার রক্ষা করতে পারে প্রকৃতিকে, যদি সে নিজেকে প্রকৃতির অংশ ভাবে।

আমরা সবাই একটুখানি 'হারিয়ে যাওয়া শিশু'

জীবন যতই দ্রুত চলে, বড়দের দায়িত্ব যতই ভারী হোক, জিবলি মনে করিয়ে দেয়, আমাদের প্রত্যেকের ভেতরেই একটুখানি কিশোরী চিহিরো আছে— যে হারিয়ে গেছে, আবার নিজেকে খুঁজছে। আমরা প্রতিদিনই হয়তো সেই জাদুর ট্রেনে চড়ি, যেখানে আমাদের অতীত, ভয়, স্মৃতি, ভালোবাসা সব একসঙ্গে যাত্রা করে। জিবলি সেই ট্রেনের টিকিট দেয় না, সে শুধু জানালার পাশে বসে থাকা আসনটা দেখিয়ে দেয়।

আমি জানি, সময় বদলেছে। এখনকার শিশুরা বড় হচ্ছে ইউটিউব আর অ্যালগরিদমের ভিড়ে। কিন্তু আমি চাই, ওরাও অন্তত একবার চিহিরোর মতো বড় হোক। জীবনে যতবার মনে হবে, 'সব হারিয়ে গেছে', তখনই চিহিরো মনে করিয়ে দেবে, 'ভয় পেও না, তুমি পারবে'।

 

Comments

The Daily Star  | English

Ishraque holds DSCC meeting as 'mayor'

Organisers said the event aimed to ensuring a cleaner Dhaka and improve civic services

1h ago